যদি একদিন হঠাৎ করে আপনি ঘুম থেকে উঠে দেখেন, সমাজ আপনাকে একঘরে করে দিয়েছে, আপনাকে এখন আর সমাজের তথাকথিত “সাধারণ” একজন মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে না, তখন আপনার কী অনুভূতি হবে? আপনার মনে যে চাপ, যে অপ্রকাশিত আক্ষেপ, যে কষ্ট দীর্ঘদিন ধরে জমে রয়েছে, তা বের হওয়ার জন্য হাহাকার করে, কিন্তু সেই চাপ কোনোভাবে বাইরেও আসতে পারে না, কারণ পাশে কাউকে পাওয়া যায় না, যে আপনাকে বুঝবে। এমনকি, আপনার পরিবারের সদস্যরাও আপনাকে আগের মতো “স্বাভাবিক” ভাবে ভাবতে পারছে না; আপনার কথা, আপনার বোধ-বিশ্বাস, আপনার প্রতিটি অনুভূতি যেন জলের মতো পরিষ্কার হয়ে উঠলেও তারা সেগুলো বুঝতে পারছে না। এবং আপনি এখন যেন একটি ভিন্ন শ্রেণির মানুষ! একেবারেই নতুন পৃথিবী, নতুন পরিচয়, নতুন সামাজিক অবস্থান! তখন ভাবুন তো, আপনি কতদিন এই পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে পারবেন?
কিন্তু, এই ঘটনা একমাত্র আপনার সাথে ঘটে না, বরং এটি আমাদের সমাজে যুগের পর যুগ চলমান একটি ঘটনা, যা অনেক রূপে প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষ করে, আমাদের সমাজের সেইসব মানুষদের মধ্যে যারা রূপান্তরিত নারী বা হিজড়ে হিসেবে পরিচিত। আমরা কখনো তাঁদের নিয়ে গভীরভাবে ভাবি না, কখনো তাঁদের অবস্থা নিয়ে চিন্তা করি না। তাঁদের শুধু দেখলেই অনেক সময় বিরক্তি প্রকাশ করি, তাঁদের উপস্থিতি আমাদের কাছে অস্বস্তিকর মনে হয়, অথচ কখনো কি আমরা তাঁদের জীবন ও সংগ্রাম জানার চেষ্টা করি? কখনো কি আমরা জানার চেষ্টা করি, তাঁরা কীভাবে নিজেদের সংগ্রামে এগিয়ে চলেছে, তাঁদের জীবনের পরতে পরতে কী ধরনের যন্ত্রণার মোকাবিলা করতে হয়?
২০১৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত, কৌশিক গাঙ্গুলী পরিচালিত নগরকীর্তন এমন একটি চলচ্চিত্র, যা আপনাকে একটি অজানা, অবর্ণনীয় বাস্তবতার সাথে পরিচয় করায়—এমন একটি বাস্তবতা, যা আপনি হয়তো কখনো অনুভব করেননি, অথচ সেটাই আপনার আশেপাশে প্রতিনিয়ত ঘটছে। সিনেমার মূল চরিত্র, পরিমল, একজন পুরুষ, যিনি পুটি হয়ে ওঠার পথ ধরেন। এই পরিবর্তন, এই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং তাঁর সংগ্রাম আপনাকে চোখে জল এনে দিতে বাধ্য করবে, এবং এটি আপনাকে এমন কিছু প্রশ্ন করতে উত্সাহিত করবে, যেগুলোর উত্তর হয়তো আপনার কাছে আগে কখনো খুঁজে পাওয়া হয়নি। এই সিনেমার মাধ্যমে আপনি জানতে পারবেন, বাস্তবতার যে চিত্র আপনাদের কাছে কখনো অজানা ছিল, তা কিন্তু গভীরভাবে আপনার পাশেই ঘটে যাচ্ছে।
এছাড়া, সিনেমার প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি সংলাপ এতটাই নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যে তা নিছক অভিনয় মনে হয় না। বরং, এটা যেন বাস্তবের একটি অংশ হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিটি চরিত্রের অভিনয়, তাদের চোখের ভাষা, তাদের অভিব্যক্তি—এগুলোই মূলত সিনেমাটির গভীরতা প্রকাশ করে। এই সিনেমার একেকটি দৃশ্য যেন একটি চিত্রকল্প, যা আপনাকে বলছে, “এটা বাস্তব।” এখানে সংলাপের চেয়ে চোখের ভাষা এবং অভিব্যক্তির মাধ্যমে যে মেসেজ দেওয়া হয়েছে, তা অনেক বেশি কার্যকরী।
এই সমস্ত কিছু শেষপর্যন্ত আপনাকে নিয়ে যাবে সেই জায়গায়, যেখানে আপনি বুঝতে পারবেন, নগরকীর্তন শুধুমাত্র এক মানুষের গল্প নয়, এটি একটি গোটা সমাজের অন্তর্নিহিত কষ্টের প্রতিফলন। এই সিনেমা সেই সমাজের বিপক্ষে একটি বড় ধাক্কা, যেখানকার একদিকে অর্ধনারীশ্বরের পূজা করা হয়, অথচ অন্যদিকে রূপান্তরিত নারীদের অপমানিত করা হয়, তাদেরকে অবজ্ঞা করা হয়, তাদের স্বীকৃতি ও সম্মান দেওয়া তো দূরের কথা, বরং তাঁদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষই চলে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে, সমাজের কোনো ধরনের ন্যূনতম সম্মান তাঁরা পাওয়ার যোগ্য কি না—এটা তো আমরা ভাবতেই পারি না!
কিন্তু এই সিনেমা আপনাকে চোখ খুলে দেবে, আপনাকে এমন কিছু দেখাবে যা আগে কখনো আপনি জানতেন না। এর মাধ্যমে আপনি উপলব্ধি করবেন, যে পৃথিবীতে আপনার মতো মানুষ থাকলেও, তাদের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধগুলো, তাদের জীবন সংগ্রাম কখনো থামে না—এটা এক দীর্ঘ চলমান প্রক্রিয়া।
এটি সেই সমাজের জন্য এক বড় ধরনের প্রতিবাদ, যে সমাজে একদিকে নারীবাদী আন্দোলন চলছে, একদিকে মানুষ অধিকার দাবি করছে, কিন্তু ঠিক তখনই, সেই সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত মানুষদের—যারা রূপান্তরিত নারী বা হিজড়ে, তাদের সম্মান দেওয়ার কোনো চিন্তা বা দৃষ্টিভঙ্গি থাকে না। অথচ সেই সমাজে নাকি অর্ধনারীশ্বরের পূজো করা হয়! নগরকীর্তন আমাদের দেখায়, যে সমাজ চোখ বন্ধ রাখে, সেই সমাজেই সবচেয়ে বেশি অন্ধকার থাকে।