About Us | Contact Us |

স্মৃতির শহর মুর্শিদাবাদ

স্মৃতির শহর মুর্শিদাবাদ

না,এখন আর শহরের ত্রিপোলিয়া দরওয়াজা, রৌনক আফজা দরওয়াজা কিম্বা দক্ষিণ দরওয়াজার নহবত খানা থেকে আর সানাইয়ের সুর ভেসে আসেনা।বছরের বিশেষ দিনে শত শত হাতি,ঘোড়া, উটের পিঠে রাজস্ব চাপিয়ে সৈন্য সামন্তদের রাজকীয় জুলুস আর চোখে পড়েনা,

শহরের নও-শকত কিম্বা চাঁদনীচক বাজারে দেখা যায় না আগের সেই অজস্র মানুষের কোলাহল,শুধু চাঁদনীচক কেন? সেদিনের উর্দু বাজার,মিনা বাজার,রাজা বাজার,সিরাজ উদ দৌলা বাজারেরও আজ আর কোনো চিহ্নই অবশিষ্ট নেই। শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বাংলা,বিহার, উড়িষ্যা এই তিনটি দরওয়াজা বুকে অজস্র স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে,শহরের প্রথম নবাবের বাসভবন কুলহেরিয়া অঞ্চল আজ মানুষ আর চিনতে পারেনা,নবাব সরফরাজের নাগিনাবাগের সুরম্য প্রাসাদ, নবাব সিরাজের রাজকীয় মনসুরগঞ্জ বা হীরাঝিল প্রাসাদ আজ মানুষের মন থেকেই হারিয়ে গেছে।

শহরের বুকে প্রাসাদসম যে আস্তাবল ছিল, যে আস্তাবল দেখে লর্ড কার্জনও নবাবের প্রাসাদ ভেবে ভুল করেছিলেন সেই আস্তাবল আজ জরাজীর্ণ হয়ে ধ্বংসের প্রহর গুনছে,শুধু আস্তাবল নয়,নবাবের পিলখানা,দুম্বাখানা, মাদাহ গৌ খানা কিম্বা সুতারখানাও হারিয়ে গেছে কালের করালগ্রাসে।

 মতিঝিলে গৌড়ের সুলতানদের প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ থেকে নিয়ে আসা পাথর দিয়ে নির্মিত মেহের উন নিসা বেগমের রাজকীয় সাং ই দালান প্রাসাদও আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত,আজ নবাবদের কেল্লা নিজামতকেও আর আলাদা করে চেনা যায় না,কেল্লার ভেতরের অজস্র রাজকীয় প্রাসাদ আজ ধূলোয় মিশে গেছে, যেগুলি অবশিষ্ট রয়েছে সেগুলিও দীর্ঘ অবহেলা সহ্য করে ধ্বংসের অপেক্ষায়।কেল্লা নিজামতের শাহি বাবুর্চিখানা থেকে আর পোলাও, কাবাব, শাহি টুকরা,সিমাই কিম্বা অন্য কোনো শাহি খানার খুশবু ভেসে আসেনা। কেল্লার পালকিখানা,তাম্বুলখানা, আবদারখানা, মাইজ খানা, সামা চিরাগখানা, দাওয়াখানা,তোষাখানা, ভিন্দাখানা, বাট্টাখানা, মশালখানা,ত্যূরখানা, কুল্লুমদানখানা সহ আরো অজস্র বিভাগের এখন আর কোনো অস্তিত্বই নেই, 

এখন আর শহরের রাস্তায় কোনো আফতাবিবরদার কে কোনো নবাবজাদার মাথায় চাঁদির ছাতা ধরে হাঁটতে দেখা যায় না,কোনো হুকাবরদারকেও নবাবি জুলুসে নবাবি পালকির সাথে সাথে হাতে হুকা নিয়ে হাঁটতে দেখা যায় না,এখন আর ভিস্তিওয়ালদের চামড়ার ব্যাগ করে কেল্লার নিজমত পরিবার গুলিতে জল দিতেও দেখা যায় না, এখন আর বাবুর্চিখানা থেকে রোজ শাহি খাবার যায় না নিজামত পরিবার গুলিতে। নিজামত পরিবারের কোনো সদস্যদের কেল্লার বাইরে যেতে হলে আস্তাবল থেকে এখন আর কোনো ফিটন গাড়ি তাঁদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় না।

কেল্লার যে মহলসারা এলকা গুলি এক সময় নানান সুগন্ধি ফুলের বাগানে ভরে উঠেছিল  আজ সেই এলাকাটি গভীর জঙ্গলে পরিপূর্ণ, যে মহলসারার প্রাসাদ গুলিতে বেগমরা থাকতেন আজ তা পরিণত হয়েছে বিষধর সাপের আতুড় ঘরে।মহলসারার আমীর মহল প্রাসাদের সামনে বেগমদের হাতিতে ওঠার সিঁড়িটি আজও রয়েছে গেছে, শুধু সেই বেগমদের আর দেখা মেলেনা।

এখন আর নবাব পরিবারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ মানুষ মৃত্যুবরণ করলে কালো পোশাক পরিহিত মানুষদের শোক মিছিল সহযোগে মৃতদেহ সমাধিস্থলে নিয়ে যাওয়া হয় না,নবাব বেগমদের সমাধিস্থল গুলিও আজ কেমন জরাজীর্ণ, অবহেলিত,আগে নবাবদের বাসস্থানের প্রধান প্রবেশ পথে যেখানে সকাল সন্ধ্যা নহবত বাজতো,আজ সেখানে তাঁদের সমাধির গায়ে কর্কশ কন্ঠে কাক ডাকে। 

এক সময় এই শহরে প্রায় সাতশোটি মসজিদ ছিল। আজ সেসব মসজিদের সিংহভাগই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।নামাজের ওয়াক্তে আজ আর চক মসজিদ, বেগম মসজিদ,সফেদ মসজিদ, জুরুদ মসজিদে মানুষ গমগম করে না, 
রমজান মাসের দিন গুলিতে এখন আর সেহরী ও ইফতারের সময় জানান দিতে কেল্লার তোপ ঘাট থেকে তোপ দাগা হয় না।
ঈদের দিন গুলিতে চক মসজিদ আর সেজে ওঠেনা, নামাজিদের মেখে আসা নানান আতরে মসজিদ চত্বর আর ম-ম করেনা,চক মসজিদের সামনের সেই খোলা চত্বরে নবাবের হাতি এসে থামে না,চক মসজিদের শাহি ইমাম ঈদের দিন বাইরে বেরিয়ে এসে নবাবের হাত ধরে মসজিদের ভেতরে নিয়ে যান না।এক সময় শহরের যে সরাইখানা গুলিতে মুসাফিরদের ভিড় উপচে পড়ত, আজ সেই সব সরাইখানাগুলি কোনো এক জাদুকাঠীর ছোঁয়ায় শহর থেকে উবে গেছে।

শহরের নবাব, আমির ওমরাহদের প্রাসাদ গুলিতে এখন আর মুসায়রা, সূত্রা, মুজরার আয়োজন হয়না, সন্ধ্যায় প্রাসাদগুলি থেকে ভেসে আসেনা সারেঙ্গী কিম্বা এসরাজের সুর।

ব্যরা উৎসবের দিন বিকেল বেলায় হাজারদুয়ারিতে আর নবাবের দরবার বসেনা, বেরোয় না কোনো নবাবি জুলুস, ব্যরা উৎসবে ইউরোপীয়রা এখন আর কেল্লায় আসেনা, ফারহাবাগের প্রাসাদ ব্যরার দিন আর সেজে ওঠেনা।মহরমের দিন গুলিতে নিজামত ইমামবাড়ার নহবতখানা থেকে আর কোনো করুণ সুর বাজে না।

এখন আর আমের মরশুমে বাগানগুলি সেজে ওঠে না, নবাবের আম্বাখানা আমের গন্ধে ভরে ওঠেনা, সেখানে আর শোনা যায়না আমতরাসদের কোলাহল।

শহরের ওমরাহগঞ্জে আর আমীর-ওমরাহ্দের প্রসাদগুলি দেখা যায় না, আগের মতো শহরে এখন আর বিদেশী মুসাফিরদের আনাগোনাও চোখে পড়েনা।

এখন আর বিকেলে শহরের রাজপথে নবাবের ফিটন গাড়ি নবাবকে নিয়ে ছোটে না।এখন আর নেওয়ারা উৎসব হয় না,ভাগীরথীর বুকেও আর ভাসতে দেখা যায় না নবাব-বেগমদের স্টিমার কিম্বা ময়ূরপঙ্খী নৌকা, 

হজারদুয়ারির ঘড়ি ঘরের ঘণ্টার আওয়াজ এখন আর বাজে না,কেল্লার প্রধান ফটক যে দক্ষিণ দরওয়াজা কঠোর নিরাপত্তায় মোড়া থাকতো,আজ সেই দরওয়াজা সবার জন্য সব সময় উন্মুক্ত।

এখন আর মুর্শিদাবাদ স্টেশনে নবাবের স্পেশাল বগি এসে থামে না,মুর্শিদাবাদের রাস্তায় নবাবের স্টুডিবেকার কিম্বা ফোর্ডের গাড়ি আর দেখতে পাওয়া যায় না।

সেদিনের গৌরবময় মুর্শিদাবাদ শহর আজ তাঁর সব জৌলুশ হারিয়ে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে।শহর জুড়ে এখন পাক খায় শুধুই হাহাকার।তবে মুর্শিদাবাদ শহরের এমন মলিন দশা হঠাৎ করে হয়নি, শহরের অসুখ দীর্ঘ দিনের।

ঊনবিংশ শতকের প্রথমদিকে মুর্শিদাবাদে আসা এক পর্যটক জর্জ ভাইকাউন্ট ভ্যালেন্সিয়া মুর্শিদাবাদ শহর দেখে মুগ্ধ হতে পারেননি।তিনি তাঁর ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় উল্লেখ করেছেন যে, শহরের বাড়ি গুলি খুবই সাধারণ, তাছাড়া নবাবের প্রাসাদও চোখে পড়ার মতো নয়।এছাড়াও তিনি কেল্লায় বহু প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ পড়ে থাকতেও দেখেছেন।

১৮৪২ সালে প্রকাশিত এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার সপ্তম সংস্করণ পঞ্চদশ খন্ডে মুর্শিদাবাদ শহরের বর্ণনা দেয়া আছে, সেখানে বলা হয়েছে,

মুর্শিদাবাদ শহরের রাস্তাগুলো সরু ও অসুবিধাজনক, এমনকি সেই রাস্তা দিয়ে ইউরোপীয় ঘোড়ার গাড়ি চলাচলের জন্যও উপযুক্ত নয়, শহরের বাড়িগুলির অবস্থাও খুব খারাপ,অধিকাংশ বাড়িই একতলা এবং টালির ছাদযুক্ত। নবাবের প্রাসাদ এতটাই সাধারণ যে তা চোখেই পড়ে না। শহরে বাজারের দিক থেকে একটি দীর্ঘ, সরু, আঁকাবাঁকা রাস্তা বেরিয়েছে, যার দুই পাশে নিম্নমানের বাড়ি ও কুঁড়েঘর। এই রাস্তা থেকে যে রাস্তা বেরিয়েছে তা আরও সরু ও জঘন্য। জল নিষ্কাশনের জন্য পূর্বে নির্মিত নালাগুলো নষ্ট হয়ে ভেঙে যাওয়ায় ভারী বৃষ্টিপাতের পর এই রাস্তাগুলি চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে এবং দুর্গন্ধযুক্ত পচা গন্ধ ছড়াতে থাকে।

একজন ফরাসি পর্যটক, লেখক, আলোকচিত্রশিল্পী ও ভূগোলবিদ লুই রুশলে উনবিংশ শতকের প্রায় শেষের দিকে মুর্শিদাবাদ ভ্রমণে আসেন তাঁর বর্ণনাতেও মুর্শিদাবাদ শহরের অত্যন্ত করুন চিত্র ফুটে উঠেছে,

তিনি তাঁর ভ্রমণ অভিজ্ঞতার বইতে উল্লেখ করেছেন যে,এই মুর্শিদাবাদ শহরটি বাংলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর, যা ভাগীরথীর দুই তীরেই ধরে কয়েক মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। শহরের অধিকাংশই কুঁড়েঘর সেগুলির  চেহারাও অত্যন্ত জীর্ণ। ঘরের দেয়ালগুলো খুঁটির সাথে বাঁধা খড়ের চাটাই দিয়ে তৈরি, আর ছাউনি পাম পাতার তৈরি।অনেক ঘরের ছাওনি আবার অনেকটা বৃষ্টির জলের আঘাতে ভেঙে পড়েছে। শহরের রাস্তা কাদা আর জলজ আগাছায় পরিপূর্ণ, সেখানে একটি পা ফেলাও কঠিন, পা পিছলে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে সবসময়।এই কুঁড়েঘরের ফাঁকে ফাঁকে উঁচু  ইটের দালান চোখে পড়ে। তার সঙ্গে আছে কিছু অদ্ভুত নকশার বিশাল দালান, যেগুলিতে রাজকীয় স্তম্ভ সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে,আর মোঘল-ধাঁচের খিলানযুক্ত জানালাগুলোকে ঘিরে রেখেছে। এই সব দালানগুলি স্যাঁতসেঁতে  হওয়ার কারণে ঘন কালচে রং ধারণ করেছে।শেষে, তিনি উল্লেখ করেন যে, মুর্শিদাবাদ শহর সহ বাংলার অন্যান্য শহরগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ, আর তা রাজস্থান বা হিন্দুস্তানের অন্যান্য শহরগুলোর চেয়ে অনেক পিছিয়ে। কারণ সেখানে সুন্দর বাজার, দারুণ সব বসতবাড়ি আর রাজকীয় প্রাসাদ আছে।

আসলে বক্সার যুদ্ধের পর কোম্পানির দেওয়ানী লাভের ফলে নবাবদের অর্ধেক ক্ষমতা কমে যায়, বিশেষ করে বাংলা সুবার অর্থনৈতিক ক্ষমতা সম্পূর্ণ চলে যায় ইংরেজ কোম্পানির হাতে,নবাবরা তখন আর্থিক ভাবে কোম্পানির অধীন হয়ে পড়েছিলেন, অন্যদিকে কোম্পানিও এই সুযোগের সদ ব্যবহার করে। নানা বাহানায় নবাবদের প্রাপ্য ভাতা ক্রমশ কমিয়ে দিতে শুরু করে।ফলে নবাবদের বহু দুর্দশার ও বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয়েছিল।অন্যদিকে ততদিনে কাশিমবাজার বন্দরও বন্ধ হয়ে যায়,ইংরেজদের হাত ধরে কলকাতা নতুন শহর হিসেবে গড়ে উঠছিল। কলকাতার উত্থানই মুর্শিদাবাদের পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল ভীষণ ভাবে। মুর্শিদাবাদের বহু জমিদার বড় বড় ব্যাংকার,ব্যবসায়ী সব কলকাতায় গিয়ে বসবাস করতে শুরু করে দিয়েছিল,ফলে অষ্টাদশ শতকের প্রায় শেষের দিক এক কথায় বাংলা বিহার উড়িষ্যার রাজধানী শহর মুর্শিদাবাদের পতন শুরু হয়ে এবং খুব দ্রুত এই শহর তাঁর জৌলুশ হারিয়ে জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে।পরিবেশ পরিস্থিতি এক সময় যে মুর্শিদাবাদকে খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছিল খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে পরিবর্তিত পরিস্থিতিই এই শহরের ধ্বংস ডেকে আনে।আর তখন থেকেই মুর্শিদাবাদ পরিণত হয় এক উপেক্ষিত শহরে।

ফারুক আব্দুল্লাহ
ফারুক আব্দুল্লাহ

ইতিহাস অন্বেষক

গল্প হলেও সত্যি

04 July, 2025 | : মীর রাকেশ রৌশান

স্মৃতির শহর মুর্শিদাবাদ

04 July, 2025 | : ফারুক আব্দুল্লাহ