মুর্শিদাবাদ শহরের চক বাজারের কোন চায়ের দোকানে চা খেতে বসে আপনি লক্ষ্য করলেন আপনার পাশেই হাতে চায়ের কাপ ধরে বসে থাকা মানুষ গুলি নিজেদের মধ্যে এক অচেনা ভাষায় কথা বলছে।সেই ভাষার মাথা মাথা মুণ্ডু কিছুই আপনার বোধগম্য হয়নি। কিন্তু মাথায় ভেতরে ঘুরপাক খেয়েছে হাজার প্রশ্ন।আপনার কৌতুহলী মানসপটে ভেসে উঠছে নানান সম্ভাবনার কথা।
হ্যাঁ এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন অনেকেই হয়েছে ইতিপূর্বে এবং ভবিষ্যতেও হবে অহরহ। আপনার কানে ভেসে আসা ভাষাটি ছিল ফার্সি(কথ্য ফার্সি)।যারা বলছিল তারা মুর্শিদাবাদ শহরে বসবাসকারী ইরানি সম্প্রদায়। ইরানী হলেও এখন তারা প্রত্যেকেই ভারতীয় নাগরিক।তাই তাদের ভারতীয় ইরানীও বলাও যায়।মুর্শিদাবাদে বসবাসকারী এই ইরানিরা আসলে এক যাযাবর জাতি।এবার মুর্শিদাবাদে বসবাসকারী ইরানী যাযাবর সম্প্রদায়ের ভারত তথা মুর্শিদাবাদে আগমনের গল্পে আসা যাক।
মুর্শিদাবাদের এই ইরানীরা কবে তাদের স্বদেশ ত্যাগ করে ভারতে প্রবেশ করেছিল?কেনই বা তাদের দেশত্যাগ করতে হয়েছিল?এসবের কোন প্রামাণ্য ইতিহাস আপনি মুর্শিদাবাদের ইরানীদের কাছে পাবেন না,কিন্তু যা পাবেন তা হল তাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে বংশপরম্পরায় শুনে আসা নানান কিসসা।অবশ্য সেগুলিও ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে তাদের এ ব্যাপারে উদাসীনতায়।
মুর্শিদাবাদে বসবাসকারী কিছু প্রবীণ ইরানিদের কাছে জানা যায় তাদের পূর্বপুরুষরা নাকি নিরাপত্তা জনিত কারণে আজ থেকে প্রায় কয়েকশো বছর পুর্বে ইরান ত্যাগ করে ভারতে প্রবেশ করেছিল।দেশত্যাগী এই ইরানী যাযাবররা তখন থেকেই ভারতবর্ষের নানান প্রান্তে ঘুরতে থাকে।আসলে ভ্রাম্যমাণ জীবনেই তারা অভ্যস্ত ছিল।এভাবেই বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরতে ঘুরতে যাযাবর ইরানী সম্প্রদায় বেশ কয়েকটি গোষ্টিতে বিভক্ত হয়ে সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলায় তখন নবাবী আমলের শেষ পর্যায় চলছে।বাংলার মসনদে তখন নাজাফি বংশের শাসকরা।নাজাফি বংশের শাসকরা আবার হজরত মুহাম্মদ(সাঃ)বংশের ছিলেন।ফলে কারবালার প্রান্তে শহীদদের অনেকেই ছিল নাজাফি বংশের রক্ত সম্পর্কীয়।ফলে মুর্শিদাবাদে মহরমের শোক পালিত হত নবাবী পৃষ্ঠপোষকতায় মহাআড়ম্বরে।ইরানী যাযাবরদের একটি বড় গোষ্ঠী প্রতিবছর মুর্শিদাবাদের মহরমে যোগ দিতে আসত।এবং দশদিন তারা হাজারদুয়ারী সংলগ্ন মাঠে তাঁবু খাটিয়ে থাকত।এই দশদিন নবাবরাই তাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতেন।মহরম শেষ হলেই আবার তাদের যাযাবর জীবন শুরু হয়ে যেত।
ইরানের এই যাযাবর জনগোষ্ঠী মুর্শিদাবাদ বা লালবাগ শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে খুব সম্ভবত নবাব ওয়াসিফ আলি মীর্জার আমল থেকে।প্রথমদিকে দশ থেকে পনেরোটি পরিবার মুর্শিদাবাদে বসতি স্থাপন করে।তাদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ইরানী যাযাবর সম্প্রদায়ের অন্যান্য সদস্যরাও মুর্শিদাবাদে স্থায়ী ভাবে বসবাস করার জন্য আসতে থাকে।পরবর্তী সময়ে নবাবী এস্টেটেই তাঁদের বসবাসের জন্য জায়গা বরাদ্দ করা হয়।বর্তমানে মুর্শিদাবাদ শহরের প্রাণকেন্দ্র চাঁদনীচক ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রায় সাড়ে চারশো থেকে পাঁচশো ইরানী সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করে।
মজার বিষয় দীর্ঘদিন ধরে ভারতে বসবাস করেও তারা তাদের মাতৃভাষা ফার্সি কে ভোলেনি।ফার্সি দীর্ঘদিন ধরে ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে পরিচিত ছিল।বাংলার নবাবদের প্রশাসনিক এবং কথ্য ভাষাও ছিল।কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বাংলার নবাব সহ সমগ্র নিজামত পরিবার কথ্যভাষা হিসেবে ফার্সির বদলে উর্দুকেই আঁকড়ে ধরেছে।কিন্তু মুর্শিদাবাদ শহরের ইরানীরা আজও পরিবারের এবং গোষ্ঠীর মানুষদের সাথে ফার্সিতেই কথা বলে।অবশ্য তাদের অনেকেই বাংলা,হিন্দি, উর্দু এবং ইংরেজিও শিখেছে প্রয়োজনের তাগিদে।
দীর্ঘদিন ধরে তারা ভারতে থাকলেও তাদের ইরানী সংস্কৃতি তারা ভুলে যায়নি।তাদের খাদ্যাভ্যাসেও ইরানী প্রভাব রয়ে গেছে।মুর্শিদাবাদের ইরানী সম্প্রদায়ের প্রধান খাবার পোলাও জাতীয় ‘পাগুষ্টি’ যা চালের সাথে মাংস,মশলা,ঘি সহযোগে তৈরী করা হয়।এছাড়াও নিজস্ব পদ্ধতিতে রান্না বিরিয়ানি,ঘিয়ে ভাজা রুটি বা পরোটা তাদের খুব প্রিয়।ইরানীদের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসে মাংস খুব গুরুত্বপূর্ণ।মাংস ছাড়া তাদের এক বেলাও চলবেনা।তবে মাছের প্রতি তেমন আগ্রহ না থাকলেও অরুচিও নেই।কখনও সখনও তারা মাছও খায়। তবে তা তাদের সম্পূর্ণ নিজস্ব পদ্ধতিতে রান্না করে।ইরানীরা যেকোনো খাবারেই মাত্রাতিরিক্ত ঝাল খেতে পছন্দ করেন।তারা দীর্ঘদিন ধরে মুর্শিদাবাদ শহরে বসবাস করলেও এখনও তারা স্থানীয় বাঙালী খাদ্যাভ্যাসের সাথে তেমন অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি। ইরানীদের মধ্যে পান খাওয়ার খুব চল রয়েছে। ছোট থেকে বড়, নারী কিম্বা পুরুষ প্রত্যেকেই পান খেতে অভ্যস্ত।পান তাদের সংস্কৃতির একটি অঙ্গে পরিণত হয়েছে।
এবার আসা যাক মুর্শিদাবাদের ইরানী সম্প্রদায়ের সমাজ ব্যবস্থায়।তাদের সমাজ সম্পর্কে জানার পর আপনাদের মনে হতেই পারে তারা এখনও খুব রক্ষনশীল।কিন্ত তাদের এই রক্ষণশীলতাই তাদের ভাষা এবং সংস্কৃতিকে আজ কয়েকশো বছর ধরে রক্ষা করে এসেছে।
মুর্শিদাবাদ শহরে বসবাসকারী ইরানী সম্প্রদায় বিবাহের ক্ষেত্রে এক কঠোর রীতি মেনে চলে। তারা সাধারনত নিজের গোষ্ঠির মধ্যেই বিবাহ করে।তবে ইরানী পুরুষ চাইলে কখনও ইরানী সম্প্রদায়ের বাইরের মেয়েকেও বিয়ের অধিকার পায়।কিন্তু ইরানী নারীদের ক্ষেত্রে তা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।ইরানী সম্প্রদায়ের এক প্রবীণ সদস্য তো বলেই ফেললেন 'হাম বাহার সে লাড়কি লেতে হে লেকিন হামারা লাড়কি বাহার নেহি ভেজতে'।এই কথা থেকেই পরিস্কার হয়ে যায় যে তারা বাইরের মেয়ে এনে তাকে তাদের ইরানী সংস্কৃতি শিখিয়ে পরিয়ে নিতে প্রস্তুত। কিন্তু নিজ গোষ্ঠির মেয়েকে তারা বাইরে অন্য সংস্কৃতি গ্রহণ করার অনুমতি দিতে নারাজ।
শহরে বসবাসকারী ইরানী পরিবার গুলি আবার কতগুলি কাবিলা বা গোষ্ঠীতে বিভক্ত।এবং প্রতিটি কাবিলাতে রয়েছে একজন সর্দার।যিনি সেই কাবিলার অভিভাবক। প্রতিটি কাবিলার সর্দার তার কাবিলার মানুষদের সুবিধে-অসুবিধের দিকে লক্ষ্য রাখেন।এমনকি সর্দাররাই কাবিলার মধ্যে সংঘটিত নানান বিবাদের মীমাংসা করেন।
ইরানিদের সমাজ তো হল এবার তাদের শিক্ষা-দীক্ষায় আসা যাক। মুর্শিদাবাদ শহরে বসবাসকারী ইরানীদের মধ্যে শিক্ষার হার তুলনামূলক ভাবে অনেকটাই কম।আসলে বেশিরভাগ অশিক্ষিত ইরানী বাবা মা তাদের সন্তানদের শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়।অধিকাংশ ইরানী বাচ্চাদের বুনিয়াদী শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় মসজিদের ইমামের কাছে আরবি,ফার্সি ও উর্দু ভাষা এবং কোরান শিক্ষার মাধ্যমে।তবে বর্তমানে মুর্শিদাবাদের বেশ কিছু ইরানী অভিভাবক তাদের ছেলে মেয়েদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে।ফলে কিছু সংখ্যক ইরানী ছেলে মেয়েরা এখন উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য কলেজও যাচ্ছে।
মুর্শিদাবাদ শহরে বসবাসকারী ইরানী সম্প্রদায়কে পেশার ভিত্তিতে দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।কিছু সংখ্যক ইরানী মূল্যবান পাথর ব্যাবসার সাথে জড়িত।এরা মূল্যবান পাথর কিনে সেগুলি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে।মুল্যবান পাথর ব্যাবসায়ী ইরানীদের জীবনযাত্রার মান খুব উন্নত। বর্তমানে এদের অনেকেই অন্যান্য ক্ষেত্রেও অর্থলগ্নি করছে।
এছাড়াও মুর্শিদাবাদে রয়েছে আরও এক শ্রেণীর ইরানী জনগোষ্ঠী। যারা মূলত চশমা বিক্রি করে কোন রকমে জীবিকা নির্বাহ করে।এদের জীবনযাত্রারমান খুব নিম্নমানের।এদের অধিকাংশ মহিলারা মুর্শিদাবাদ শহরের বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান গুলিতে, ট্রেনে,বাসে এবং পুরুষরা জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে চশমা ফেরি করে।
ইরানিদের আর্থিক অবস্থা যেমনই হোকনা কেনো তাদের আত্মসম্মানবোধ যে খুব উঁচুমানের তাদের কথাতেই সে প্রমাণ পাওয়া গেল।তাদেরকেই বলতে শোনা গেল ’হাম ইরানী লোগ কিসিকা গুলামি নেহি করতে’।আপনি মুর্শিদাবাদ শহরে বসবাসকারী ইরানীদের কোন দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করতে কখনও দেখবেন না।সে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা যত করুণই হোক না কেন।
বাংলা তথা মুর্শিদাবাদে যুগে যুগে বহু জাতির মানুষ এসেছে এবং আমাদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে।দীর্ঘ দিন একসাথে থেকে সবার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়েগেছে। এভাবেই হয়তো কোন একদিন মুর্শিদাবাদ শহরে বসবাসকারী ইরানী সম্প্রদায় তাদের স্বকীয়তা ভুলে বাকি বহিরাগত জাতী গুলির মতোই সবার সাথে মিলে-মিশে একাকার হয়ে যাবে। সেদিন হয়ত খুব বেশী দূরে নয়।