কারবালা শুধু ইসলামের ইতিহাস নয়, মানবসভ্যতার ন্যায়-অন্যায়ের দ্বন্দ্বের এক চিরন্তন প্রতীক। কারবালার ইতিহাসে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের এক অলিখিত অধ্যায় হুসাইনি ব্রাহ্মণ। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে ফোরাত নদীর তীরে সংঘটিত সেই মর্মান্তিক যুদ্ধ যেন যুগ যুগ ধরে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সত্যের পক্ষে আত্মত্যাগের আদর্শ হয়ে আছে। অথচ এই ইতিহাসের মাঝে রয়েছে এমন কিছু অলিখিত অধ্যায়, যা কেবল ধর্মের নয়, মানুষের মধ্যকার ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও ঐক্যের শক্তিকে সামনে নিয়ে আসে। তেমনই এক অধ্যায় হলো "হুসাইনি ব্রাহ্মণ" সম্প্রদায়ের কাহিনি—যারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও কারবালায় ইমাম হুসেন (আ.)-এর প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং আত্মত্যাগের নিদর্শন স্থাপন করেছেন বলে কিংবদন্তি প্রচলিত।
উৎপত্তি ও পরিচিতি: মোহিয়ালদের বংশগাথা
"হুসাইনি ব্রাহ্মণ" নামটি শুনলে অনেকের কাছেই তা অবাক করার মতো শোনায়। কারণ নামের মধ্যেই রয়েছে এক আশ্চর্য সমন্বয়—ইমাম হুসেন (আ.)-এর নাম এবং ব্রাহ্মণ পরিচয়। এই সম্প্রদায় মূলত ভারতের পাঞ্জাব ও হরিয়ানার ঐতিহ্যবাহী মোহিয়াল ব্রাহ্মণদের একটি শাখা। মোহিয়ালরা নিজেদের ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভূত বলে মনে করেন, যারা পরবর্তীতে ব্রাহ্মণীয় সংস্কার ও জীবনধারা গ্রহণ করেন। মোহিয়ালদের ভেতরেও বিশেষভাবে "দত্ত" বা "দত্তা" বংশের সদস্যরাই "হুসাইনি ব্রাহ্মণ" নামে পরিচিত। তাদের গোত্র হলো ভারদ্বাজ।
এই সম্প্রদায়ের মূল কাহিনির কেন্দ্রে রয়েছেন রাহাব দত্ত, যিনি ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের (বর্তমানে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া অঞ্চলের) একজন সারস্বত ব্রাহ্মণ ছিলেন। তার সাত পুত্রের সাথে তিনি কারবালার প্রান্তরে ইমাম হুসেনের (আ.) পাশে দাঁড়ানোর জন্য রওনা হন বলে লোককথা প্রচলিত।
কারবালার কাহিনি: ইতিহাস নাকি বিশ্বাসের স্মারক?
রাহাব দত্ত ও তার সাত পুত্রের ভূমিকা:
প্রচলিত কাহিনিতে বলা হয়, রাহাব দত্ত তার সাত পুত্র—পোরু, রাম সিংহ, হারাস রাই, রাই পুন, সাহাস রাই, শের খান এবং ধারু—কে নিয়ে কারবালার যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছান। এখানে দুই ধরনের বক্তব্য পাওয়া যায়:
এক বিবরণে বলা হয়, তারা আশুরার দিন ইমাম হুসেনের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং সবাই শহীদ হন।
অন্য মতে, তারা যুদ্ধের পরপরই কারবালায় পৌঁছান, যেখানে ইমাম হুসেন (আ.)-এর শাহাদতের মর্মান্তিক দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন। এরপর তারা ইমামের বোন বিবি জয়নাবের (রা:) সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাদের ত্যাগ, শোক ও প্রতিজ্ঞা দেখে জয়নাব এতটাই আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েন যে, নিজ হাতে তাদের "হুসাইনি ব্রাহ্মণ" উপাধি দেন। কিছু মতে, তারা মুখতার আল-থাকাফির নেতৃত্বে প্রতিশোধের সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন।
একটি গৌরবময় দায়িত্ব:
আরেকটি বিখ্যাত বর্ণনায় বলা হয়, রাহাব দত্ত ইমাম হুসেন (আ.)-এর শিরোচ্ছেদিত পবিত্র মস্তক ধৌত করেন এবং সমাহিত করার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এ কাজকে এই সম্প্রদায়ে অত্যন্ত পবিত্র ও সম্মানজনক দায়িত্ব বলে বিবেচনা করা হয়।
সাহিত্যিক উল্লেখ ও ঐতিহাসিক বিতর্ক:
ঐতিহাসিক প্রমাণের অভাব:
হুসাইনি ব্রাহ্মণদের এই কাহিনির উল্লেখ প্রাথমিক ইসলামী ইতিহাস, বিশেষ করে বিশ্ববিখ্যাত ইতিহাসবিদ আল-তাবারি, ইবনে আসির বা ইবনে কাসিরের লেখায় পাওয়া যায় না। ফলে একাংশ ঐতিহাসিক ও ইসলামি পণ্ডিত এ ঘটনাকে পুরোপুরি কিংবদন্তি বা সম্প্রদায়ভিত্তিক সৃষ্ট একটি সামাজিক গৌরবের প্রচার বলে মনে করেন। অনেকে এটিকে মধ্যযুগীয় বা মোগল আমলের সময়, বিশেষত উত্তর-পশ্চিম ভারতের শিয়া সম্প্রদায়ের সাথে মোহিয়ালদের সম্পর্ক দৃঢ় করতে উদ্ভূত কাহিনি বলে ব্যাখ্যা করেন।
সাহিত্যিক প্রমাণ:
তবে হুসাইনি ব্রাহ্মণদের কাহিনির প্রভাব ভারতের সাহিত্যেও দৃশ্যমান। উদাহরণস্বরূপ:
হিন্দি-উর্দু সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব মুন্সি প্রেমচন্দের নাটক "কারবালা" (১৯২৪)-এ ভারতের সাতজন যোদ্ধার কারবালার যুদ্ধে অংশগ্রহণের উল্লেখ রয়েছে।
শিশির কুমার মিত্রের "দ্য ভিশন অফ ইন্ডিয়া" (পৃষ্ঠা ১৮৩) এর উল্লেখ রয়েছে।
জাং নামা (আহমেদ পাঞ্জাবি, পৃষ্ঠা ১৭৫-১৭৬)
কথিত কিউমের শহীদ তালিকা, যেখানে ভারতীয়দের অংশগ্রহণের দাবি করা হয়েছে।
আধুনিক যুগে হুসাইনি ব্রাহ্মণদের পরিচিতি ও অবস্থান:
বর্তমানে ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে আছেন হুসাইনি ব্রাহ্মণরা। তাদের মূল অবস্থান হল ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লি, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, কাশ্মীর এবং পাকিস্তানের পাঞ্জাব, সিন্ধু, খাইবার পাখতুনখাওয়া স্থানে।
ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন:
সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো, তারা হিন্দু ধর্মের অনুসারী হয়েও প্রতিবছর মুহাররমের শোকানুষ্ঠান, তাজিয়া মিছিল ও মাতমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এই অংশগ্রহণ নিছক আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং ইমাম হুসেনের (আ.) আত্মত্যাগের প্রতি গভীর শ্রদ্ধার প্রকাশ।
বিখ্যাত হুসাইনি ব্রাহ্মণ ব্যক্তিত্ব:
হুসাইনি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় থেকে উঠে এসেছেন ভারতের বহু খ্যাতনামা ব্যক্তি, যারা সমাজ, রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য ও ইতিহাসচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন যেমন,
সুনীল দত্ত: বলিউডের কিংবদন্তি অভিনেতা ও রাজনীতিবিদ। তিনি একাধিকবার প্রকাশ্যে বলেছেন, "আমার পূর্বপুরুষদের মতো আমিও ইমাম হুসেন (আ.)-এর জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত।"
সঞ্জয় দত্ত: জনপ্রিয় চলচ্চিত্র অভিনেতা, সুনীল দত্তের পুত্র।
সাবির দত্ত: হিন্দু হয়েও উর্দু সাহিত্যের বিশিষ্ট লেখক।
নন্দ কিশোর বিক্রম: সাহিত্যিক, যিনি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির পক্ষে লেখনী চালিয়েছেন।
ড. নম্রতা দত্ত: ইতিহাসের প্রাক্তন অধ্যাপক, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় (জেএনইউ)।
ধর্মীয় সম্প্রীতি ও ঐক্যের অনন্য নিদর্শন:
কেন এই কাহিনি গুরুত্বপূর্ণ?
এই আখ্যানের ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এর সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং নৈতিক গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। কারণ:
১. মানবিক ঐক্যের প্রতীক: ধর্মের সীমানা অতিক্রম করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং সত্যের পক্ষে লড়াইয়ের এই বার্তা ভারতীয় উপমহাদেশের বহু ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনুরণন ঘটায়।
২. সহিষ্ণুতা ও সমন্বয়ের সংস্কৃতি: হুসাইনি ব্রাহ্মণরা প্রমাণ করেছেন, ধর্মীয় বিশ্বাস আলাদা হলেও, অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আত্মত্যাগ সম্ভব।
৩. সার্বজনীন ন্যায়বোধ: ইমাম হুসেনের আত্মত্যাগ শুধু মুসলিম সমাজের নয়, মানবসমাজের সংগ্রামের অঙ্গ। সেই ত্যাগে অংশ নেওয়া বা স্মরণ করা বিশ্বজনীন মূল্যবোধের পরিচায়ক।
৪. ভারতীয় বহুত্ববাদের মডেল: হুসাইনি ব্রাহ্মণদের মতো সম্প্রদায় ভারতীয় সমাজে ধর্মীয় সহাবস্থানের বাস্তব উদাহরণ, যা হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের এক জীবন্ত প্রতিফলন।
পরিশেষে বলা যায়, ইতিহাসের বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে মানবতার জয়গান হুসাইনি ব্রাহ্মণদের কাহিনিকে কেবল ঐতিহাসিক দলিলের ভিত্তিতে যাচাই করলে হয়তো বিভ্রান্তি তৈরি হবে। তবে একে যদি সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের অংশ হিসেবে দেখা যায়, তাহলে এটি ভারতীয় উপমহাদেশের ধর্মীয় সম্প্রীতি, মানবতা এবং নৈতিক ঐক্যের এক গৌরবময় অধ্যায় হয়ে ওঠে।
কারবালার মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে যে বার্তা ইমাম হুসেন (আ.) দিয়েছেন, সেই বার্তা আজও সময়োপযোগী—সত্যের পক্ষে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং মানবতার জয়গানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের ভূমিকা প্রয়োজন। আর হুসাইনি ব্রাহ্মণদের এই কাহিনি, বাস্তব হোক বা প্রতীকী, সেই ঐক্যের এক অনবদ্য স্মারক হয়ে থাকবে।
ছবি প্রতীকী