About Us | Contact Us |

ইলিশ ও রাজনীতিকরা

ইলিশ ও রাজনীতিকরা

“মাছের রাজা ইলিশ।”

তাই রাজারাজড়া তো বটেই, রাজনীতিকদের জীবনের সঙ্গেও বোধহয় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে ইলিশ। কত রাজনীতিকের যে প্রিয় খাদ্য ইলিশ, তা বোধহয় বলে শেষ করা যাবে না! আসলে এই ‘রাজকীয়’ মাছের মোহে, কিংবা স্বাদে-রূপে মুগ্ধ হননি এমন কে-ই বা আছেন! আমার ছোটবেলার স্মৃতি বলে, যে কংগ্রেস নেতা এবং প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির বাড়ির সরস্বতী পুজোয় গোবিন্দভোগ চাল আর সোনামুগের ডাল দিয়ে খিচুড়ির সঙ্গে ইলিশ ভাজাটা ছিল ‘মাস্ট’। প্রিয়রঞ্জনরা আদতে ছিলেন পূর্ববঙ্গের লোক। বরিশাল থেকে চলে এসে থাকতেন উত্তরবঙ্গের কালিয়াগঞ্জে। উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ থেকে ছাত্র রাজনীতির সূত্র ধরে তাঁর কলকাতায় আগমন এবং ক্রমে ক্রমে কংগ্রেস রাজনীতির ‘মহীরুহ’ হয়ে ওঠা। খাঁটি ‘বাঙাল’ প্রিয়রঞ্জন ফুটবলে মোহনবাগানের সমর্থক হলেও পূর্ববঙ্গীয় অভ্যাস অনুযায়ী বসন্ত পঞ্চমীতে সরস্বতী পুজোর দিন বাড়িতে জোড়া ইলিশ আসাটা ছিল ‘বাধ্যতামূলক’।

সরস্বতী পুজোয় প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির বাড়িতে পাত পেড়ে বসে খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ খাননি, ডানপন্থী রাজনীতিতে এমন কম চরিত্রই খুঁজে পাওয়া যাবে। প্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্যায় থেকে এখনও সাংসদ সৌগত রায়, ‘প্রিয়রঞ্জন ঘনিষ্ঠ’ বলে একদা পরিচিত প্রদীপ ভট্টাচার্য, মালা রায়, নির্বেদ রায়, আব্দুল মান্নান কিংবা সদ্য গেরুয়া শিবিরে চলে যাওয়া তাপস রায়— কে আসেননি সরস্বতী পুজোয় গাওয়া ঘি দিয়ে খিচুড়ি আর ইলিশ মাছের রসাস্বাদন করতে! আসলে কংগ্রেস বা তৃণমূল কিংবা বিজেপি এইরকম ভাগাভাগি করে ‘ইলিশ প্রেম’টা ঠিক বোঝা যাবে না। ১৯৭৭-এ কংগ্রেস সরকার পতনের পরে এবং প্রথম বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হওয়ার সময় গেরুয়া শিবিরের যে বিধায়ক তাঁর অসাধারণ বাগ্মিতা দিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করেছিলেন, সেই হরিপদ ভারতীও নাকি ইলিশ মাছ খেতে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। জনশ্রুতি অনুযায়ী বিবেকানন্দ যেমন মৃত্যুর দিন অর্থাৎ ৪ঠা জুলাই ১৯০২, দুপুরবেলাতেও ইলিশ মাছ দিয়ে পরিপাটি করে ভাত খেয়েছিলেন, তেমনই হৃদরোগে অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়ার আগের দিন হরিপদ ভারতীও নাকি একাধিক ইলিশ মাছের পেটি খেয়েছিলেন। 

প্রথমে কাউন্সিলর, পরে সিপিএমের দাপুটে মন্ত্রী শ্যামল চক্রবর্তীকে হারিয়ে বিধায়ক হওয়া পরেশ পালেরও তো ‘সিগনেচার ইভেন্ট’ ছিল পূর্ব কলকাতায় ইলিশ উৎসব। একদা যুবনেতা, সেখান থেকে রাজ্য যুব কংগ্রেসের সভাপতি পরেশ পাল চিরকালই ‘চমকপ্রদ’ কিছু করতে ভালোবাসেন। সেই সুবাদেই তিনি যেমন পূর্ব কলকাতায় ‘গণবিবাহ’ বা ‘সুভাষ মেলা’র আয়োজন করতেন এবং করে চলেছেন, ঠিক তেমনই তাঁর ‘ইলিশ উৎসব’ও ছিল নজরকাড়া। পূর্ব কলকাতায় পরেশ পালের ইলিশ উৎসবে রাজনীতিকরা তো বটেই, বলিউডের সেলিব্রিটি, কখনও-সখনও পদ্মা পাড়ের ক্রিকেটাররাও হাজির হয়ে গিয়েছেন। ‘ভোজনরসিক’ বলে পরিচিত আর এক ডানপন্থী রাজনীতিক মুকুল রায়ও ইলিশ খেতে এবং খাওয়াতে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। এখন অতীতের ‘ছায়া হয়ে যাওয়া’ মুকুল রায়ের আতিথেয়তাকে যাঁরা মনে রেখেছেন, রাজনীতিকরা এবং সাংবাদিককুল, তাঁরা সবাই স্বীকার করবেন, ‘মুকুলদা’র আয়োজন মানেই বিশাল সাইজের ইলিশের পেটি আর গলদা চিংড়ি থাকবেই। তৃণমূল থেকে বিজেপিতে গিয়েছেন, আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলে ফিরেছেন, কিন্তু যত দিন সুস্থ ছিলেন, কাঁচরাপাড়ার রেল ইয়ার্ডের রাজনীতি থেকে উঠে আসা মুকুল রায়ের আতিথেয়তায় কোনও ছেদ পড়েনি। প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি এবং মুকুল রায়ের মধ্যে একটা অদ্ভুত মিল ছিল, বিরোধী গোষ্ঠীর কোনও রাজনীতিক দেখা করতে এলে আপ্যায়ন এবং খাওয়া-দাওয়ার বহর বেড়ে যেত। এখনও আমার স্মৃতিতে টাটকা আছে, তিক্ত লড়াইয়ের পর সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতির পদে জিতে কলকাতায় ফেরার পরের দিনই যখন প্রিয়রঞ্জন ফোন পেয়েছেন কলকাতার ময়দানে তাঁর সবচেয়ে বড় ‘শত্রু’ দেখা করতে চান, তখন দক্ষিণ কলকাতার বাড়িতে তাঁকে ডেকে সোজা আপ্যায়ন করে নিয়ে গিয়েছেন অধুনা লুপ্ত হয়ে যাওয়া পার্ক স্ট্রিটের স্কাইরুম রেস্তোরাঁয় ‘স্মোকড হিলসা’ খাওয়াতে। প্রিয়রঞ্জন হাসতে হাসতে বলতেন, “শত্রুতাকে বন্ধুত্বে বদলে দিতে ইলিশের জুড়ি নেই!” ঠিক তেমনই মুকুল রায় গেরুয়া শিবিরে যাওয়ার পর যখন নিজের রাজনৈতিক ঘুঁটি সাজাচ্ছেন, তখন বিরোধী শিবিরের কেউ দেখা করতে এলে দুপুরে মধ্যাহ্ন ভোজনে ইলিশ থাকতই। আর বিকেলে চায়ের সঙ্গে ‘আপনজন’ থেকে নিয়ে আসা ফিশ ফ্রাই। 

ইলিশে অবশ্য কে-ই বা না মুগ্ধ হয়েছেন! খোদ রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “ইলিশ মাছ অমনি দিব্যি থাকে, ধরলেই মারা যায়। প্রতিভাও ঠিক তাই, তাকে বাঁধলেই সর্বনাশ!” এতটা খাদ্যরসিক ছিলেন বলেই তো রবীন্দ্রনাথ ইলিশকে প্রতিভার সঙ্গে তুলনা করতে পেরেছেন। গুরু রামকৃষ্ণও ইলিশে মুগ্ধ ছিলেন, কিন্তু বিবেকানন্দের ‘ইলিশ প্রেম’ বোধহয় অন্য উচ্চতার ছিল। পদ্মাপাড় দিয়ে তিনি হাঁটছেন, ইলিশ বিক্রি হচ্ছে দেখে এক টাকায় ১৬টা ইলিশ কেনা হল। কিন্তু স্বামীজীর ইচ্ছে হয়েছে কচু দিয়ে ইলিশ খাবেন। খোঁজ খোঁজ, কোথায় পাওয়া যাবে কচু শাক এবং কচুর লতি। বাজারে নেই, কোথাও নেই কচু। অনেক খুঁজে এক চাষির ঘরে জানা গেল কচু শাক আছে। চাষি কচু শাক দিতে রাজি, কিন্তু একটাই শর্ত, স্বামী বিবেকানন্দকে তাঁকে দীক্ষা দিতে হবে। স্বামীজী বললেন, “তথাস্তু! আমি দীক্ষা দিয়েই কচু শাক নেব।” আর সেই কচু দিয়েই রাঁধা হল পদ্মাপাড়ের ইলিশ। মৃত্যুর ঠিক এক বছর আগে ১৯০১ সালের ৬ জুলাই বেলুড় মঠে বসে ইলিশ দেখতে দেখতে বিবেকানন্দ এক চিঠিতে তাঁর মার্কিনি ভক্ত ক্রিস্টেনকে লিখেছিলেন, “আমাদের ইলিশ তোমাদের আমেরিকান ইলিশের চেয়ে বহুগুণে উৎকৃষ্ট।” ইলিশের প্রতি টান বিবেকানন্দের জীবনের ছত্রে ছত্রে জড়িয়ে আছে। 

আসলে ইলিশ মানেই যে রাজকীয়তা, যে অনিবার্য আকর্ষণ, তাকে বাঙালি কবে ভুলতে পেরেছে? আজকের বাংলাদেশ যতই পূর্ব পাকিস্তান হওয়ার পথে হাঁটুক না কেন, কী করে আমরা ভুলে যাব ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি অস্মিতাকে মনে করিয়ে দেওয়া সেই বিখ্যাত ছড়াকে, “ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা, বোয়াল মাছে দাড়ি/ইয়াহিয়া খান ভিক্ষা করে, শেখ মুজিবের বাড়ি।” বাঙালি যে চিরকাল নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে, সেদিনের পাকিস্তানেও পাঞ্জাবি আধিপত্যবাদকে নস্যাৎ করে নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব আর বাঙালি অস্মিতাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল, এই ছড়া তো তারই প্রমাণ। ভুলে গেলে চলবে না, সৈয়দ মুজতবা আলি, আর এক রবীন্দ্র ভক্ত বাঙালি মুসলিম একবার ইলিশের নিন্দা করায় তাঁর এক পাঞ্জাবি বন্ধু অধ্যাপকের সঙ্গে কথোপকথনই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ইলিশের নিন্দা, তা হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালি কোনওদিন সহ্য করতে পারেনি। 

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত যেমন তাঁর ‘আইকনিক’ ‘ইলশে গুঁড়ি’ কবিতা লিখে বর্ষা, বাঙালির ইলিশ প্রেম, প্রকৃতির অবর্ণনীয় সৌন্দর্য— এই সব কিছুকে অমর করে দিয়েছেন, তেমনই বুদ্ধদেব বসু থেকে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় তাঁদের লেখায় বারবার ইলিশের প্রসঙ্গ এনেছেন। উত্তর কলকাতার বরানগরের বাসিন্দা, যাঁর বাড়ির কাছে গঙ্গার ঘাটেও একসময় চমৎকার রুপোলি ইলিশ উঠত, সেই সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় যখন বাঙালিকে ‘রসেবশে’ থাকার সহবত শেখাচ্ছেন, তখন রবিবার বাড়িতে ইলিশ নিয়ে এলে গোটা বাড়ি কেমন ‘ইলিশময়’ হয়ে থাকে, তার অসাধারণ বর্ণনা দিয়েছিলেন। ফ্রিজ খুললেই ‘ইলিশ ইলিশ গন্ধ’, দুপুরে খাওয়ার পর হাত ধুয়ে ফেললেও ইলিশের তেল দিয়ে ভাত মাখার অদৃশ্য স্পর্শ যেন জড়িয়ে থাকে শরীরের সর্বত্র, দোরের সামনে বসে থাকা বিড়ালের হাসিখুশি মুখ, ডিগবাজি খাওয়া বলে দেয় মার্জারও আজ মুগ্ধ ইলিশে। ওই বঙ্গের ‘আইকনিক’ লেখক শওকত ওসমানের পুত্র এককালের সেলিব্রিটি বিজ্ঞাপন চিত্র নির্মাতা জঁ নিসার ওসমান তো সেই কারণেই কোন যুগে বিখ্যাত বিজ্ঞাপনের স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘মাছের রাজা ইলিশ, বাতির রাজা ফিলিপস’। ওসমান ভাইয়ের বানানো বহুজাতিকের সেই বিজ্ঞাপন আজও হয়তো পদ্মাপাড়ের সবাই ভুলে যাননি। 

এই যে ইলিশকে নিয়ে উন্মাদনা, ঘটি-বাঙালের লড়াইতে পূর্ববঙ্গ থেকে চলে আসা ছিন্নমূল মানুষদের গর্ব আর হারিয়ে যাওয়া সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে ইলিশের ‘সুপারস্টার’ হয়ে যাওয়া, এই সব কিছুকে কীভাবেই বা ব্যাখ্যা করা যায়? সত্যিই তো মাছের রাজাই ইলিশ! তাকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন! মারাঠিতে তাকে বলা হয় ‘পলা’, কন্নড়ে ‘পালিয়া’, তামিলে ‘ওলাম’, তেলেগুতে ‘পোলাম’, আর সিন্ধুদেশে ‘পাল্লা’। যে নামেই ডাকুন না কেন, ইলিশের আবেদনকে কে কবে উপেক্ষা করতে পেরেছে? খেয়ালি সম্রাট, যিনি রাজধানী স্থানান্তর করে নিজের এবং প্রজাদের জীবনেও সর্বনাশ ডেকে এনেছিলেন, সেই তুঘলক, যাঁর সৃষ্টিছাড়া আচরণকে আজও মনে রাখা হয় ‘তুঘলকী’ কাণ্ডকারখান প্রবাদ বাক্যের মধ্যে দিয়ে, সেই সুলতানও তো মৃত্যুর আগের দিন পেটপুরে পাল্লা অর্থাৎ ইলিশ খেয়েছিলেন। এতটাই ইলিশের টান!

সুমন ভট্টাচার্য
সুমন ভট্টাচার্য

বিশিষ্ট সাংবাদিক

গল্প হলেও সত্যি

04 July, 2025 | : মীর রাকেশ রৌশান

স্মৃতির শহর মুর্শিদাবাদ

04 July, 2025 | : ফারুক আব্দুল্লাহ