দুই বাংলাতেই আজ ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে অনিবার্য লড়াইয়ের মুখোমুখি আমরা। একদিকে ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান ঘটলে অন্যদিকেও তার অভিঘাত পৌঁছায়—এ সত্য কে না জানে। ভারতবর্ষ জুড়ে যেমন হিন্দু মৌলবাদী ফ্যাসিস্টদের বর্বরতা দিন দিন সীমা ছাড়াচ্ছে, তেমনই পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে ক্ষুদে ফ্যাসিস্ট মমতা ব্যানার্জীর দল খুন, ধর্ষণ আর চুরি-চামারিকে এক স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত করেছে, যা একটা গোটা প্রজন্মের বেঁচে থাকার স্বপ্নকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। আজ পশ্চিমবঙ্গের এমন কোনো পাড়া নেই, এমন কোনো গলি নেই – যেখানে কান পাতলে শিক্ষিত বেকারদের হাহাকার শোনা যায় না।
পাশাপাশি ধর্মকেন্দ্রিক বিভাজনের রাজনীতি করে বিজেপি এই রাজ্যে ক্রমশ জাঁকিয়ে বসছে। ভাবতে অবাক লাগে, যে দলটি পনেরো বছর আগেও বাংলায় পার্টি অফিস খোলার শক্তি রাখত না, আজ তারা বাঙালির ভাষা-সংস্কৃতিকে চাপা দিয়ে গো-বলয়ের সাংস্কৃতিক দখলদারি চাপিয়ে দিতে চাইছে। বাংলার চিরায়ত ‘পেটটি নাদা, গণেশ দাদা’ ক্রমশ হারিয়ে গিয়ে কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসছে ‘গণপতি বাপ্পা’। কোত্থেকে হনুমান পূজিত হতে শুরু করছে চারদিকে। আমাদের বাংলার শাক্ত পদাবলীতে যে ভোলাভালা, ছাই-ভস্ম মাখা, গাঁজা-ভাঙ খাওয়া কিঞ্চিৎ মেদবহুল শিবের কথা আমরা চিরকাল পড়ে এসেছি, যে শিব ছিলেন একান্তই আমাদের বাংলার, যে শিব বউয়ের ফিরতে দেরি হওয়ার আশঙ্কায় শ্বশুরবাড়ির দরজার বাইরে উৎপাত করেন – বাংলার সেই চিরায়ত শিব হারিয়ে গিয়ে কোত্থেকে উত্তর ভারতীয় মাসেলম্যান শিবের আবির্ভাব হয়ে গেল এই মাটিতে। সেন বংশের পতনের সময় থেকে নিম্নবর্ণ মানুষের সঙ্গে ব্রাহ্মণরা যখন সমঝোতা করতে বাধ্য হলেন, এবং বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিসরে মঙ্গলকাব্যের মধ্যে দিয়ে মনষা, চন্ডীর মতো সাবঅলটার্ণ দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটলো – সেই লৌকিক দেবদেবীরাও ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছে আজ। হারিয়ে যাচ্ছে ওলাবিবি, বনবিবি, বদর, হারিয়ে যাচ্ছে সত্যনারায়ণের নাম – যারা এক সময় বাংলার অব্রাহ্মণ জনগোষ্ঠীর ইতিহাস ও সংস্কৃতির বহনকারী ছিলেন, তাঁদের স্থান দখল করছে উত্তর ভারতের হিন্দি সাংস্কৃতিক প্রতিমা। এই সাংস্কৃতিক উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের পেছনে রয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদী ইতিহাসের পরাজয়কে আড়াল করার প্রবণতা।
বাংলা ভাষাকেও আর আক্রমণের বাইরে রাখা হচ্ছে না আজ। দিল্লিতে বাংলা ভাষায় কথা বলার ‘অপরাধে’ পরিযায়ী শ্রমিকদের গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনা আমরা দেখেছি, যেখানে চার্জশিটে বাংলা ভাষাকে বাংলাদেশি ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যে’দেশের সংবিধানে সমস্ত ভাষার সমানাধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত সেই দেশেই আজ হিন্দি সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের এই নগ্ন আজ সরকারি ফরমানে দাঁত নখ বের করে আক্রমণ করছে বাঙালিকে।
কিন্তু এত কিছুর পরেও পশ্চিমবঙ্গের একদল ইন্টেলেকচুয়াল ক্ষমতার ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে নীরব। কেউ কেউ তো আবার প্রকাশ্যেই বলছেন – প্রতিবাদের কথা মুখে বললে প্রভুরা চটে যাবেন, তাদের তো হাতে রেখে চলতে হয়! আজ পশ্চিমবঙ্গের বড় দুর্দিন, আজ একজন শঙ্খ ঘোষ নেই, যাঁর ডাকে হাজার হাজার মানুষ পথে জড়ো হবেন।
তবুও লড়াই চলে। লড়াই তো থামার নয়। মানুষ, একমাত্র মানুষই সেই মহাকালের রথের ঘোড়া, যে বারবার পুড়ে যাওয়ার পরেও ঘরের চালে নতুন করে বিছিয়ে নেয় খড়, লুট হয়ে যাওয়া মাঠে আবার বপন করে ধানের বীজ। তাই আজ আমাদের একজন জাঁ-পল সার্ত্র কিংবা শঙ্খ ঘোষ না থাকলেও, মানুষ নিজেই মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়ে হাত ধরাধরি করে নিজেদের দুঃসময়কে অতিক্রম করে পৌঁছতে চাইছে সুসময়ের দরজায়। হলেই বা তাঁরা সংখ্যায় কম!
সত্য অনেক সময় সংখ্যালঘুর হাতে জন্ম নেয়—এ ইতিহাসের শিক্ষা। বাংলাদেশে জুলাই গণহত্যার সময়ে আমরা যারা কলকাতায় পথে নেমেছিলাম, তারা ছিলাম সেই বিপন্ন সংখ্যালঘুই। তবু জানতাম আমরা কী বলছি। হাসিনা রেজিমের ১৬ বছরের ফ্যাসিস্ট জমানার বাস্তবতা, শুধু জুলাইতেই ৮৪৪টি খুন, এগারো হাজারের বেশি মানুষকে চিরতরে পঙ্গু করে দেওয়া, রাস্তায় ট্যাঙ্ক নামিয়ে গণহত্যা—এসবই আমাদের জানা ছিল। মুজিব কাল্ট গড়ে বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃতির প্রচেষ্টা, আয়নাঘরের অন্ধকার, কল্পনা চাকমাদের গুম—এসবই সত্য ছিল। তবুও কলকাতায় তখন আমাদের পাশে খুব কম মানুষই দাঁড়িয়েছিলেন।
গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী বাংলাদেশে অল্প সময়ের জন্য হলেও গিয়ে দেখেছি, ভারতের মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় কী বিপুল মিথ্যাচার হচ্ছে। এখানে যা প্রচার করা হচ্ছে, তার ৯০ শতাংশই যে ভুয়ো – তা নিজে চোখে দেখে এসেছি।
কিন্তু তা এটা বলা ভুল হবে যে বাংলাদেশে এখন আর কোনো অনাচার নেই। গণঅভ্যুত্থান হয়েছে—বিপ্লব নয়। যে সমাজব্যবস্থা কাঠামোগতভাবে বদলায়নি, সেখানে সাময়িক অস্থিরতা, ধর্মীয় মৌলবাদীদের সক্রিয়তা বাড়বে—এটাই ইতিহাসের নিয়ম। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। আবার মানুষের ধারাবাহিক সংগ্রাম সেই উপদ্রব কাটিয়েও দেয়– এটাও ইতিহাসেরই শিক্ষা। কোথায় এই অ্যানার্কি দেখা যায়নি? ফরাসি বিপ্লবের স্মৃতি কি আমরা ভুলে গেছি? এমনকি বলশেভিক বিপ্লবের মুহূর্তে জারের প্রাসাদে বিপ্লবী জনতার আছড়ে পড়ার কথাও আমরা জানি।
এই প্রেক্ষাপটে আমি যাঁর কথা আলাদা করে বলতে চাই তিনি ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান—যিনি বছরের পর বছর বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। যখন সবাই নীরব, তখনই তিনি ছিলেন সবচেয়ে উন্মুক্ত কণ্ঠ। হাসিনা রেজিমের ফ্যাসিস্ট জমানায় যখন অধিকাংশ শিল্পীই মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন, সেই গলা টিপে ধরে দম বন্ধ করা সময়েই এই মানুষটা একের পর এক গানে, কবিতায়, কথায় বিদ্রুপের চপেটাঘাত করেছেন সেই স্বৈরাচারকে– একবার নয়, বারংবার, লাগাতার, বছরের পর বছর। জুলাই গণহত্যার সময়ে গোলাগুলির ভেতরেও কার্ফ্যু ভেদ করে তাঁর রাস্তায় নামার দৃশ্য বারবার দেখেছি আমরা। আজ তো গোটা বাংলাদেশ হাসিনা রেজিমের বিরুদ্ধে কথা বলছে। কিন্তু ঝড়-বাদলের রাতে কজন ছিলেন ফারজানা ওয়াহিদ সায়ানদের পাশে? তিনি, বা তাঁর মতো মানুষেরা তো তখন এক বিপন্ন সংখ্যালঘুই ছিলেন বাংলাদেশের মাটিতে।
৫ আগস্ট পরবর্তী ইন্টারিম জমানাতেও ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান যে ক্ষমতা কাঠামোর বাইরেই থেকে গিয়েছেন শুধু নয়, ইন্টারিম জমানাতেও মানবাধিকারের যেকোনো অবমাননার বিরুদ্ধে আজও সমান সরব থেকেছেন তিনি। সে হতে পারে মেয়েদের সিগারেট খাওয়া নিয়ে পিতৃতান্ত্রিক ফতোয়ার বিরোধিতা করা, হতে পারে কলকাতার আর.জি. কর আন্দোলনের সংহতিতে গান গাওয়া, হতে পারে সংখ্যালঘুদের অবমাননার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, হতে পারে ইস্কুল-কলেজে গান-বাজনার পক্ষে আন্দোলনে সরাসরি পথে নেমে গান গাওয়া, হতে পারে প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার মানুষের পক্ষে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করা, হতে পারে মহিলা ফুটবলারদের পক্ষে অবস্থান নেওয়া, হতে পারে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসনের অবসান চাওয়া – সব প্রশ্নেই আজও সমান সরব তিনি। তবে নিশ্চিয়ই তিনি একা নন, আরো অন্যান্য অনেকেই নিশ্চ্যই আছেন। তবে এই লেখাটা ওঁকে নিয়েই লিখিছি, তাই ওঁর কথাটা বিশেষ ভাবে বলতে চাই। আর মনে বলতে চাই, আজও কি ওঁরা সংখ্যালঘু নন? আজও কি ওঁদের মতো মানবাধিকারের পক্ষে থাকা মানুষের থেকে মব জাস্টিস, মব লিঞ্চিং এবং ফান্ডামেন্টালিজমের পক্ষে থাকা মানুষের সংখ্যা বেশি নয়? উত্তর তো আমাদের সকলেরই জানা। ফারজানা ওয়াহিদ সায়ানরা চিরকালই সংখ্যালঘুই থাকেন – কারণ তাঁরা ক্ষমতার পাশাপাশি নয়, দাঁড়িয়ে থাকেন ক্ষমতার মুখোমুখি, অর্থাৎ উল্টো দিকে।
সম্প্রতি বাউল আবুল সরকারের গ্রেপ্তারির বিরোধিতা করে এবং বাউল মানুষদের ওপর আক্রমণের প্রতিবাদে ঢাকা শহরে একটা মশাল মিছিলে। সেখানেও হাঁটতে দেখা গিয়েছে তাঁকে।
"স্বরাজসাধন" প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় লিখছেন – “যদি এইরকম উদ্যোগকে আমরা আয়তনে ছোটো বলে অবজ্ঞা করি তবে গীতার সেই কথাটা যেন মনে আনি – স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ৷ সত্যের জোর আয়তনে নয়, তার আপনাতেই৷”
গ্যালিলিও যখন বললেন সূর্য স্থির, পৃথিবী ঘুরছে – তখন কেউ তো তা শুনলেনই না, উল্টে মারধোর করে জোর করে গ্যালিলিওকে দিয়ে মিথ্যে কথা বলিয়ে নেওয়া হয়েছে।
মার্ক্স-এঙ্গেলস ১৮৪৮ সালের পৃথিবীটাকে যে চোখে দেখেছিলেন এবং তাকে তার ইতিহাসের যাত্রাপথের সঙ্গে মিলিয়ে ভবিষ্যতের যে গন্তব্যের অবশ্যম্ভাবীতাকে নির্দেশ করেছিলেন তখন-তখনই কজন তাতে কর্ণপাত করেছিলেন?
বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় এসে লেনিন যখন রাশিয়ার নতুন অবস্থাটা চিনে ফেলে বললেন রাশিয়ায় পুঁজিবাদ একচেটিয়া পুঁজিবাদের জন্ম দিয়েছে এবং তার আর নতুন করে কিছু দেওয়ার নেই, তখন দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের আপোষপন্থী নেতারা সমানে বলে গিয়েছেন – মার্ক্স তো বলেছেন ইউরোপে এখন পুঁজির বিকাশ চলছে, ফলে এখন বিপ্লবের ঝামেলা না নেওয়াই ভালো। লেনিনও সেদিন সংখ্যালঘুই ছিলেন এবং সেখান থেকেই শুরু করে ইতিহাসের চাকাটাকে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন।
ফিরে যাই রবীন্দ্রনাথে, ওই "স্বরাজসাধন" প্রবন্ধেরই আর এক জায়গায় রবীন্দ্রনাথ লিখছেন – "মনের চর্চা যাদের কম গোঁড়ামি তাদেরই বেশি, সামান্য পরিমাণ নূতনত্বেও তাদের বাধে।" লেনিনও এই সত্যটাকেই উপলব্ধি করে কমিউনিস্ট পার্টিকে সতর্ক করে বলেছিলেন – "Better fewer, but better"।
আজকের এই অনেক কিছুই না থাকা সময়েও যে মানুষেরা এখনো ‘আঁধার রাতের একলা পাগল’ হয়ে চলার পথে আলো ধরেন পথিককে, তাঁদেরই একজন ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান। যিনি বারবার একা হয়ে গিয়েছেন, আবার সমস্ত লড়াই শেষে মিশে গিয়েছেন ‘জনতার মুখরিত সখ্যে’। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদেরও এক বা একাধিক সায়ানকে প্রয়োজন আজ।
আজ দুই বাংলার মানুষই ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামিল—সংখ্যায় কম হলেও। ইতিহাসই বলে—সংখ্যায় কম হওয়া সত্যের দুর্বলতা নয়। বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহের জন্য লড়েছিলেন সংখ্যালঘু হয়েই। সত্য প্রথমে সংখ্যালঘুর মধ্যেই অঙ্কুরিত হয়, তারপর সেই যে স্ফুলিঙ্গের জন্য দেয়, কালক্রমে সেই স্ফুলিঙ্গই পরিণত হয় দাবানলে—এটাই ইতিহাসের অভিজ্ঞতা।
তাই,
"স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ৷"
(সত্যের জোর আয়তনে নয়, তার আপনাতেই৷)
তাই,
"Better fewer, but better." (ভি.আই. লেনিন)
তাই,
"কোনো কথারই মৃত্যু হয় না। আমরা আজ যা বলছি, হয়তো আজই তা মানুষ গ্রহণ করছে না। কিন্তু তা বলে আমাদের সে প্রচার ব্যর্থ হচ্ছে না। আমাদের কথাগুলো মানুষের মধ্যে থেকে যাচ্ছে।" – চারু মজুমদার।
লিখেছেন :