About Us | Contact Us |

SIR আইন: নিরাপত্তার অজুহাত না কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের নতুন হাতিয়ার?

SIR আইন: নিরাপত্তার অজুহাত না কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের নতুন হাতিয়ার?

 

কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবিত SIR (Special Internal Regulation) কাঠামো সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ, বিহার এবং আসামে যথেষ্ট বিতর্ক ও আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। সরকারের যুক্তি হচ্ছে 'অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও অবৈধ অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ'। কিন্তু বাস্তবে এই আইন এমনভাবে ব্যবহৃত হতে পারে, যা দেশের ফেডারাল কাঠামো, বহু-সংস্কৃতির বাস্তুতন্ত্র এবং মানুষের মৌলিক অধিকারের উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে। বিশেষত ছাত্রসমাজ, শ্রমজীবী মানুষ, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই আইনের অপব্যাখ্যা যে কতটা ক্ষতিকর হতে পারে, তা আমরা অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখেছি।

 

পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই নিয়ন্ত্রণ কাঠামো মূলত অভিবাসন প্রশ্নকে কেন্দ্র করে আলোচিত হলেও, এর রাজনৈতিক ব্যবহার আরও গভীর। কেন্দ্র যখন রাজ্য সরকারকে পাশ কাটিয়ে জনগণের জীবনের ওপর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তখন তা ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে দুর্বল করে। SIR কার্যকর হলে নিরাপত্তার নামে রাজ্য-স্বায়ত্তশাসন, শ্রমনীতি, শিক্ষানীতির ক্ষেত্রেও কেন্দ্রের ইচ্ছাই প্রধান হয়ে দাঁড়াতে পারে। তরুণ প্রজন্মের সামনে যে স্বাধীনভাবে পড়াশোনা, কথা বলা, প্রশ্ন তোলা ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নেওয়ার স্পেস আছে সেটাও সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।

 

বিহার ও আসামের জটিল সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় এ ধরনের আইন আরও বিপজ্জনক। এখানে বহু দশক ধরে অভিবাসন, নাগরিকত্ব, ভাষা-পরিচয়ের প্রশ্ন রাজনৈতিকভাবে বহুগুণ বেশি স্পর্শকাতর। SIR সেই উত্তেজনাকে আরও প্রজ্বলিত করতে পারে। প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত যদি স্বচ্ছ না হয়, যদি অভিবাসন শনাক্তকরণ বৈজ্ঞানিক ও মানবিক পদ্ধতিতে না হয়, তবে নিরীহ মানুষও রাজনীতির শিকার হতে পারে, যার দৃষ্টান্ত আমরা NRC'র অভিজ্ঞতায় ইতিমধ্যেই দেখেছি।

 

তবে সমালোচনার মধ্যেও কিছু বাস্তব দিক অস্বীকার করা যায় না। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে বহু বছর ধরে একটি বাস্তবতা ছিল যে বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে এসে লুকিয়ে বসবাস করা মানুষের একটা অংশ ভারতের নাগরিক সুবিধা ভোগ করছিল। অনেকেই জাল নথি ব্যবহার করে সরকারি স্কিমের সুবিধা পাচ্ছিলেন, যার ফলে প্রকৃত ভারতীয় দরিদ্র নাগরিকের প্রাপ্য বরাদ্দ কমে যেত। রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, রেশনিং, শিক্ষা সহ নানা পরিসেবায় এর চাপ পড়ত। এই প্রেক্ষিতে রাষ্ট্র যদি সত্যিই সুশৃঙ্খল ও বৈজ্ঞানিক উপায়ে অভিবাসন যাচাই করে, প্রকৃত নাগরিকদের পরিচয় সুরক্ষিত রাখে এবং রাষ্ট্রের সম্পদ যথাযথভাবে বণ্টন করে।

 

কিন্তু এখানেই প্রধান প্রশ্ন যে "আইন থাকলেই কি ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়?" না! ন্যায় নিশ্চিত হয় প্রয়োগের ধরনে। পশ্চিমবঙ্গের অবৈধ অভিবাসীদের মধ্যে অনেকেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম এখানে থেকে গেছেন, সমাজ ও শ্রমবাজারের একটি অংশ হয়ে উঠেছেন। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁদের জন্য পুনর্বাসন, আইনগত পথ খোলা রাখা, বৈধীকরণের সুযোগ দেওয়া, এসবই সঠিক পথ। রাষ্ট্র যদি কেবল নিরাপত্তার যুক্তিতে কঠোর নজরদারি চালায় কিন্তু পুনর্বাসন, শ্রম-অধিকার, মানবাধিকারের প্রশ্নে উদাসীন থাকে, তবে যে সমস্যাটি সমাধান করতে চায়, সেটাই আরও গভীরে গিয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করবে।

 

সুতরাং SIR নিয়ে প্রকৃত প্রশ্ন হওয়া উচিত যে, "এই আইন কি জনগণের নিরাপত্তা, ন্যায়সংগত বণ্টন ও স্বচ্ছ শাসন প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হবে, নাকি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসিদ্ধির আরেকটি কেন্দ্রিক ব্যবস্থা?" অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন আছে, কিন্তু সেই নিয়ন্ত্রণের মূল দর্শন হতে হবে মানবিকতা, বৈজ্ঞানিক তথ্য, এবং ফেডারাল গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা। রাষ্ট্র যদি সত্যিই মানুষের অধিকার ও মর্যাদাকে প্রাধান্য দিয়ে, বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে বৈধ–অবৈধ পৃথক করে এবং প্রান্তিক মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, সেটাই হবে উন্নত ভারতের উপযুক্ত পথ। আর যদি এর আড়ালে ভয়ের রাজনীতি, ধর্মীয় মেরুকরণ বা কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা ফিরে আসে তাহলে ছাত্রসমাজ ও সচেতন নাগরিকদের কাছে তা প্রতিরোধ করার নৈতিক দায়বদ্ধতা থেকেই যায়।

ঐন্দ্রিলা হালদার
ঐন্দ্রিলা হালদার

প্রাবন্ধিক