এদেশের প্রথম নোবেল জয়ী মানুষটির ভাষা ছিল বাংলা। তার সৃষ্ট সাহিত্যের বিপুল সম্ভারও ছিল বাংলা ভাষায়। বাংলা মানে নবজাগরণ যা একসময় সারা দেশকেই পথ দেখিয়েছে। এই বাংলায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হয়েছে বিদ্রোহী কবি নজরুলের নাম স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার ত্যাগ এবং শৌর্য এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। স্বাধীন ভারতের জাতীয় সংগীত এই বাংলা ভাষাতেই রচিত বন্দেমাতরম থেকে জয় হিন্দ এই ধরনের স্লোগানের পেছনে আজকে বাংলা ভাষার অবদান অর্থনীতির দুই নোবেল জয়ীও এই বাংলার মানুষ । অর্থনীতি বা বিজ্ঞানচর্চাতেও বাংলার মনীষার ইতিহাস বিস্ময়কর। এমন ঐতিহ্য ও বর্ণময় অথচ সৃজনশীল ইতিহাস দেশের অন্যত্র দেখা যায় না। অথচ আজ নিজের দেশেই বাংলা ভাষায় কথা বলা বিপজ্জনক হয়ে উঠছে,চরম হেনস্তার শিকার হচ্ছেন বাংলা ভাষায় কথা বলা এ রাজ্যের গরিব খেটে খাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকরা। বিভিন্ন রাজ্যে যুগ যুগ ধরে বসবাসকারী প্রবাসী গরিব বাঙালিরাও হেনস্থা শিকার হচ্ছেন। বিজেপি শাসিত দিল্লি, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, ছত্রিশগড় এবং অসমে চলছে বাঙ্গালীদের হেনস্থার বিশেষ অভিযান। গরিব প্রান্তিক মানুষদের বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য বাংলাদেশী ছাপ লাগিয়ে গ্রেফতার করে ক্যাম্পে রাখা হচ্ছে। কোথাও কোথাও তাঁদের জবরদস্তি করে বলানোর চেষ্টা হচ্ছে যে, তাঁরা বিদেশে। কোথাও কোথাও ভারতীয় নাগরিকদের জোর করে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেওয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এবং বাংলায় তাদের পরিবার পরিজন ভয়ংকর আতঙ্ক, অসহায়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। দেশ জুড়ে বাঙালিদের উপর নির্যাতনের শিকার শুধুমাত্র শুধুমাত্র মুসলমানরাই নয় অসাম থেকে এনআরসির নোটিশ পাচ্ছেন উত্তরবঙ্গের অনেক হিন্দু। যারা এদেশের নাগরিক বাংলায় কথা বলার জন্য নানা রাজ্যে যারা যারা আটক হচ্ছেন তাদের মধ্যেও রয়েছেন গরীব দলিত আদিবাসী প্রান্তিক মানুষ আছেন উদ্বাস্তু পরিবারের আজকের প্রজন্মের অনেকেই অসমের রিটেনশন ক্যাম্পে থাকা বন্দীদের শতকরা ৮০ ভাগই হিন্দু। বিজেপি গরীব মানুষের কাছে আবার কাগজ দেখতে চাইছে। ভোটার কার্ড আধার কার্ডে হবে না। এ দেশের অধিকাংশ গরীব প্রান্তিক মানুষ নানা নথিপত্র দেখাতে পারবেন না । উদ্বাস্তু পরিবারের সদস্যরা বা মতুয়ারা বা বিভিন্ন জনজাতির মানুষেরাও নথিপত্র সব সময় দেখাতে পারবেন না। বিজেপির এই ভয়ংকর অভিযানে সামান্য সংখ্যক মুসলমান বিপদে পড়লেও আসলে বিরাট সংকটে পড়তে চলেছেন হিন্দু উদ্বাস্তু, গরিব মানুষ। বিশেষত, তপশিলি জাতি, উপজাতি ,আদিবাসী জনজাতির প্রান্তিক অংশের মানুষ।
দিল্লির জে জে কলোনি,জয়হিন্দ কলোনী, দিনহাটা, কোচবিহার,দক্ষিণ ২৪ পরগনা,মালদা ,বীরভূম,মুর্শিদাবাদের শ্রমজীবী মানুষ,পেটের দায়ে ভিন রাজ্যে যেতে বাধ্য হওয়া একের পর এক বাঙালি সন্তানকে বিগত কয়েক মাস যাবৎ যে অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে তা যে কোন স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে চূড়ান্ত লজ্জা এবং রাষ্ট্রীয় অপরাধের এক নির্লজ্জ ছবি।জবরদস্তি করে বলানোর চেষ্টা হচ্ছে যে, তাঁরা বিদেশী। কোথাও কোথাও ভারতীয় নাগরিকদের জোর করে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেওয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে এবং বাংলায় তাদের পরিবার পরিজন ভয়ংকর আতঙ্ক, অসহায়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। দেশ জুড়ে বাঙালিদের উপর নির্যাতনের শিকার শুধুমাত্র মুসলমানরাই নয়, অসাম থেকে এনআরসির নোটিশ পাচ্ছেন উত্তরবঙ্গের অনেক হিন্দু। যারা এদেশের নাগরিক, বাংলায় কথা বলার জন্য নানা রাজ্যে যারা যারা আটক হচ্ছেন তাদের মধ্যেও রয়েছেন গরীব দলিত আদিবাসী, প্রান্তিক মানুষ, আছেন উদ্বাস্তু প্রতিবারের আজকের প্রজন্মের অনেকেই। অসমের রিটেনশন ক্যাম্পে থাকা বন্দীদের শতকরা ৮০ ভাগই হিন্দু। বিজেপি গরীব মানুষের কাছে আবার কাগজ দেখতে চাইছে। ভোটার কার্ড, আধার কার্ডে হবে না। এ দেশের অধিকাংশ গরীব প্রান্তিক মানুষ নানা নথিপত্র দেখাতে পারবেন না । উদ্বাস্তু পরিবারের সদস্যরা বা মতুয়ারা বা বিভিন্ন জনজাতির মানুষেরাও নথিপত্র সব সময় দেখাতে পারবেন না। বিজেপির এই ভয়ংকর অভিযানে সামান্য সংখ্যক মুসলমান বিপদে পড়লেও আসলে বিরাট সংকটে পড়তে চলেছেন হিন্দু উদ্বাস্তু, গরিব মানুষ। বিশেষত, তপশিলি জাতি, উপজাতি ,আদিবাসী জনজাতির প্রান্তিক অংশের মানুষ।
এসব কেন হচ্ছে ? আমাদের দেশে অনুপ্রবেশকারী কত ? যে বাংলাদেশি বা রোহিঙ্গাদের কথা বলা হচ্ছে তারাই বা কত সংখ্যায় আমাদের দেশে ঢুকেছে? এসব নিয়ে কোন স্পষ্ট তথ্য আছে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে? এখনো পর্যন্ত এসব নিয়ে কোন স্পষ্ট বক্তব্য সরকারের পক্ষ থেকে পাওয়া যায়নি। তারা নির্দিষ্ট করে বলতেও পারছেন না তো ঠিক কত মানুষ আমাদের দেশে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছেন বা বসবাস করছেন। শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরা বিক্ষিপ্তভাবে কেউ কখনো কুড়ি লাখ, পঞ্চাশ লাখ, এমন কি দুই কোটি পর্যন্ত অবাস্তব হিসেবে দিচ্ছেন যার কোন বাস্তব ভিত্তি নেই।
যেসব রাজ্যে ধরপাকড় চলছে তাদের কর্তৃপক্ষ স্পষ্ট জানাতে পারছেন না যে কত অনুপ্রবেশকারী তার মধ্যে সনাক্ত হয়েছে। দু একটি খুচরো সংখ্যা তাও ইঙ্গিতবহ। ওড়িশার ঝাড়শুগুদা ও হরিয়ানার গুরুগ্রামে কয়েকশো বঙ্গভাষী আটক হয়েছিলেন। তাদের অধিকাংশকেই হেনস্থার পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তারা অধিকাংশই ভারতীয় নাগরিক প্রমাণিত হয়েছেন। জুলাইয়ের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশি পাওয়া গেছে মাত্র ১০ জন। তাহলে কেন?
এগুলি কোনটাই কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় । বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের বাংলাদেশী বলে তাড়িয়ে দেওয়া, এনসিআর, এনপিআর,সিএএ,এস আই আর, প্রতিটি পদক্ষেপই একটি বৃহত্তর পরিকল্পনার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
জন্মলগ্ন থেকেই আরএসএস, হিন্দু মহাসভা, জনসংঘ এদের স্বপ্ন ছিল ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গড়ার। পাকিস্তানের মতোই একটি উগ্র, ধর্মান্ধ, সভ্যতা, যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞান বিবর্জিত একটি অন্ধকার সমাজ এবং রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন অধরা থেকে যায় এই তথাকথিত উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের কারণ স্বাধীন ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে দেখতে চেয়েছিল এ দেশের হিন্দু-মুসলমান-শিখ- জৈন-বৌদ্ধ- নাস্তিক সহ বৃহত্তর অংশ। সব ধর্ম,সব ভাষা, সংস্কৃতি,খাদ্যাভ্যাসের সমান মর্যাদা ও অধিকার সুরক্ষিত হয়েছে স্বাধীন ভারতের সংবিধানে ফলে হিন্দি-হিন্দু- হিন্দুস্তানের স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে ব্রিটিশদের পদলেহনকারী আরএসএস সহ উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর। এখন ১৫ বছর সরকার চালানোর গ্যারান্টি পেয়ে এই পুরনো পরিকল্পনা গুলোকেই বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে এগোচ্ছে এরা। বিজেপি, আরএসএ-র হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক মতাদর্শের একেবারে মূলে আছে মুসলিম বিদ্বেষ। সারা দেশে ১৪ শতাংশ মুসলিমদের বিরুদ্ধে ৮৫ শতাংশ হিন্দুদের খেপিয়ে তোলাই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির রণনীতি। নানান কৌশলে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও ঘৃণা যত ছড়ানো যাবে ততই হিন্দুদের মুসলিমদের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ করা যাবে এবং বিভাজনকে ভোট বাক্সে প্রতিফলিত করে ক্ষমতা নিশ্চিত করা যাবে।
আমাদের দেশের পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে রয়েছে বাংলাদেশের সীমান্ত। স্বাধীনতার আগে থেকেই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে এই রাজ্যগুলির মানুষের যাতায়াত ছিল, আত্মীয়তা ছিল। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ত্রিপুরা এবং অসমেও হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বিরাট সংখ্যক বাংলাভাষী মানুষের বাস। তাদের ধর্ম যাই হোক না কেন ভাষা বাংলা। দু দেশের মানুষেরই আত্মীয়-স্বজন দুই দেশেই থেকে যাওয়ায় তাদের মধ্যে যোগাযোগ, আসা-যাওয়া,অস্বাভাবিক ছিল না। এটা ঠিক, স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন হওয়ার পরেও বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের ভারতে আসা বন্ধ হয়নি। তবে বাংলাদেশের মুসলিমরা দলে দলে নিজেদের ভিটে মাটি ছেড়ে ভারতে চলে আসছেন চরম অনিশ্চয়তাকে সঙ্গী করে এটা নিতান্তই কষ্ট কল্পনা। এই তথ্য পরিসংখ্যানহীন অবাস্তব কষ্ট কল্পনাকে সম্বল করে হিন্দুত্ববাদীরা 'উইচ হান্টিং' এর মত বাংলাদেশি খুঁজে বেড়াচ্ছে, অনুপ্রবেশের আওয়াজ তুলেছে। এ রাজ্যে ক্ষমতায় আসতে গেলে হিন্দুদের জোটবদ্ধ করতে হবে। তীব্র মুসলিমবিদ্বেষ, মুসলিমদের মধ্যে আতঙ্ক না তৈরি করতে পারলে সেটা সম্ভব নয়। সেই কারণেই বাংলাদেশী খোঁজার এমন হিস্টিরিয়াগ্রস্ততার মূলে রয়েছে এক রাজনৈতিক অভিসন্ধি। আসল বাংলাদেশীদের বদলে বাংলাভাষী মুসলিমদের ধরে থানায় নির্যাতন করছে তারপর ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠাচ্ছে। আসলে তারা এ রাজ্যের মুসলিমদের বাংলাদেশি তকমা দিয়ে বিতাড়িত করতে চাইছে। মনে করছে এমন আবহে বাংলার ক্ষমতা দখল করা যাবে।
এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতেই হবে কারণ এই আক্রমণ শুধু বাংলা ভাষার উপরেই নয়, বাঙালি শ্রমজীবী মানুষের উপরেও। এই মুহূর্তের ভারতে দাঁড়িয়ে আমরা দেখছি, মানুষের অর্জিত অধিকার খর্ব হচ্ছে, শ্রমিকের অধিকার খর্ব হচ্ছে, মানুষ কথা বলার অধিকার হারাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে শুধু প্রতিবাদ নয় সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে এ দেশ, এ রাজ্য ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়াবে ।