খোদ কলকাতার বুকে সরকারী আইন কলেজের মাধ্যে আইন পাঠরতা ছাত্রী গণ-ধর্ষিতা হয়েছেন কলেজেরই এক অস্থায়ী কর্মচারী এবং দুজন ছাত্র দ্বারা। খবরে প্রকাশ ওই অস্থায়ী কর্মচারী ওই কলেজের প্রাক্তন ছাত্র, শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের প্রাক্তন নেতা এবং শাসক দলের আনুকুল্যে ওই কলেজে কর্মরত। ঘটনা প্রকাশ পেতেই মানুষ ধিক্কারে ফেটে পড়েছেন। রাজ্যের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা তীর সমালোচনার মুখোমুখি। এই অবস্থায় শাসকদলের এক বিধায়ক প্রকাশ্যে বললেন মেয়েটা ওখানে না গেলে তো এ ঘটনা ঘটতো না। শাসক দলের এক আইনজ্ঞ সাংসদ বললেন যে, বন্ধু যদি বান্ধবীকে ধর্ষণ করে সেক্ষেত্রে প্রশাসন প্রতিরোধ করতে পারে না। কলেজের ভেতরে তো পুলিশ মোতায়েন করা যায় না।
দুটো অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন অসংবেদনশীল মন্তব্য। কিন্তু ওরা মাত্র দু-জন নন। এই মানসিকতা সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েছে।
এই অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক মানসিকতাকে ইংরেজিতে vic-tim blaming বলা হয়ে থাকে। বাংলায় সহজভাবে এই মানসিকতাকে 'নির্যাতিতাও দায়ী' মানসিকতা নামে ব্যাখ্যা করা যায়। নির্যাতিতাকে পরোক্ষে দায়ী করবার এই প্রবণতা আমাদের সমাজের এক দুষ্ট ব্যাধি। এর লক্ষণ হল যৌন হেনস্থার শিকার মেয়েটিকে কোনো না কোনোভাবে ঘটনার জন্য পুরো অথবা আংশিক দায়ী করা। প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষে। যারা এই অসুস্থ মানসিকতার শিকার তারা মনে করেন যে নির্যাতিতা ধর্ষককে উত্তেজিত করেছেন, তিনি যথাযথ প্রতিরোধ করেন নি, তিনি একটু চেষ্টা করলে বা সতর্ক হলে এ ঘটনা এড়াতে পারতেন। যে কোনো যৌন হয়রানি বা নির্যাতন-এর ঘটনা ঘটবার পর প্রাথমিক নিন্দা বা ধিক্কার জানাবার পালা শেষ করেই নির্যাতিতার দোষ খোঁজবার বা তাকে দায়ী করবার চেষ্টা চলতে থাকে। এতে জড়িত থাকেন সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সরকার এবং প্রশাসনের উচ্চপদস্থ আসনে আসীন ব্যক্তিরা।
বেশ কয়েক বছর আগে কলকাতার পার্কস্ট্রীট ধর্ষণকান্ডের পর এই রাজ্যের শাসকদলের এক মহিলা সাংসদ যিনি পেশায় চিকিৎসক নির্দ্বিধায় বলেছিলেন এটা যৌনকর্মী এবং তার খরিদ্দারের মধ্যে বিবাদ। এক নাবালিকা ধর্ষিতা হবার পর বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন দেখতে হবে লাভএ্যাফেয়ার ছিলো কিনা। কিংবা মেয়েটি অন্তস্বত্তা ছিলো কি না। লাভএ্যাফেয়ার থাকলে কি ধর্ষণ আইনসিদ্ধ হয়ে যায়।
ধর্ষিতার পোষাক পরিচ্ছদ কিংবা তার আচার আচরণের সমালোচনার মধ্য দিয়ে আসলে ধর্ষককেই পরোক্ষ সমর্থন করা হয়। এটা হয়তো নির্যাতিতার দোষ যারা খোঁজেন তারা সবসময় বুঝতেও পারেন না। এ প্রবণতা ক্রমবর্ধমান।
এই প্রবণতা আমরা সাধারণত দেখে থাকি সমাজের সর্বস্তরে পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে। তবে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের ঘটনা হলো এ প্রবণতা বিচার বিভাগকেও ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে। উচ্চতর আদালতের বিভিন্ন রায়ে এই নারীবিদ্বেষী মানসিকতার প্রকাশ ঘটেছে। এমন রায়ের সংখ্যা অগণিত তার মধ্যে আমি কয়েকটি উল্লেখ করবো:-
১। মথুরা রেপ কেস- আমি প্রথমেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে মামলার উল্লেখ করবো তা আইনের ইতিহাসে মথুরা রেপ কেস নামে স্বীকৃত। (Tukaram Vs. State of Maharasthra-AIR 1979 s.c. 185)
১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ মধুরা নামে এক আদিবাসী মহিলাকে থানায় আটক করে দুজন পুলিশ কনষ্টেবল থানার বাথরুমে তাকে ধর্ষণ করেন। ধর্ষিতা মহিলার শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন ছিলো না, তার পুরোনো যৌন সংসর্গের ইঙ্গিত ছিলো। অতএব দায়রা বিচারক সিদ্ধান্তে পৌঁছোলেন যে যৌন সংসর্গ হলেও তা ছিলো স্বেচ্ছায়। দায়রা জজ তার রায়ে আরো কিছু মন্তব্য করেন যা অনভিপ্রেত ছিলো। বম্বে হাইকোর্ট অবশ্য এই রায় মানেন নি। আসামীরা দোষী সাব্যস্ত হয় অপরাধীরা আপীল করলে ভারতের সুপ্রীম কোর্ট কিছু অবাস্তব বিষয়ের নিরিখে আসামীদের নির্দোষ ঘোষণা করেন। বিচারপতিরা বলেন যে যদি নির্যাতিতাকে জোর করে ধরে নিয়ে যেতো তবে তার সাধারণ প্রতিক্রিয়া হতো ঝটকা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নেওয়া এবং চীৎকার করা। যেহেতু সে যথাযথ প্রতিবাদ না করে ধর্ষকদের সঙ্গে থানার ভিতরের ঘরে গেছিলো ধরে নিতে হবে তার সম্মতি ছিলো। শিউরে উঠল সমগ্র দেশ। ভারতের খ্যাতনামা আইনজীবিরা সরাসরি প্রধান বিচারপতিকে চিঠি লিখে প্রতিবাদ জানান। এখানে বিচারপতিরা ধর্ষিতার ব্যবহারের অসঙ্গতিকে বিচার করতে বসলেন অপরাধের নয়।
২। প্রতাপ মিশ্রের মামলা (Pratap Mishra and oth ers Vs. State of Orissa AIR 1977 S.C. 1307) উড়িষ্যার নন্দন কাননে স্বামীর সাথে বেড়াতে গিয়ে গণধর্ষিতা হলেন এক গর্ভবর্তী মহিলা। আসামীরা তার স্বামীকে দূরে আটকে রেখে তার উপর উপর্যুপরি ধর্ষণ করে। ঘটনার কিছুদিন পর ধর্ষিতার গর্ভপাত হয়। বিচার চলাকালীন ভারতের সুপ্রীম কোর্ট অন্যান্য সাক্ষ্যপ্রমাণ বিশ্লেষণ করবার পর এটাও উল্লেখ করলেন যে ধর্ষিতা সম্ভবত তার পুরুষ সঙ্গীর স্ত্রী নন, তার রক্ষিতা। আরো বললেন বলপ্রয়োগের তেমন কোনো প্রমাণ নেই, গর্ভপাত সঙ্গে সঙ্গে ঘটেনি, ঘটেছে কয়েকদিন পর সুতরাং সম্ভবত যৌন সংসর্গ হয়েছে হলার সম্মতিতে। সুপ্রীম কোর্ট আরো উল্লেখ করলেন যে প্রথমবার ধর্ষণের পর দ্বিতীয় ধর্ষক ঘরে ঢোকার আগে ভদ্রমহিলা অন্তত পাঁচ মিনিট সময় পেয়েছিলেন তবুও তিনি দরজা বন্ধ করেন নি। সুতরাং তার সম্মতি ছিলো। ধর্ষণের পর ধর্ষিতা কেমন ব্যবহার করবেন সেটা আদালতের বিষয় হয়ে উঠলো। আবার সেই ইঙ্গিত ধর্ষিতাও পরোক্ষে দায়ী।
এমন উদাহরণ অজস্র। বিশেষত বিভিন্ন হাইকোর্ট বারে বারে ধর্ষিতার ব্যবহার আচার আচরণ অকারণে আতস কাঁচের তলায় ফেলেছেন। তবে সমাজ সচেতনতা যতো বেড়েছে বিচার বিভাগে এই ধরনের মানসিকতার বদল ঘটেছে ঠিকই কিন্তু বিভিন্ন হাইকোর্টের রায়ে বার বার এই stereotype বা বদ্ধমূল ধারণা ফুটে উঠেছে।
সবচেয়ে বেশি যে ধারণা নারীর সম্ভ্রমের উপর আঘাত নামিয়ে এনেছে তা হলো বিচারপতিরা মনে করেন ধর্ষক যদি ধর্ষিতাকে বিবাহ করে বা করতে রাজী থাকে তাহলে তার অপরাধ লঘু করে দেখা যেতে পারে।
সে বিষয়ে আলোচনার আগে victim blaming এর ক্ষেত্রে সুপ্রীম কোর্টের পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গীর আলোচনা জরুরী। এই ক্ষেত্রে আমি মূলতঃ অপর্ণা বাটের মামলার উল্লেখ করবো (Aparna Bhat vs. the state of M.P. AIR 2021 S.C. 1492) মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্টের এক রায়ে বিচলিত আইনজীবী অপর্ণা ভাট সুপ্রীম কোর্টে আপীল করেন। ২০.০৪.২০২০ তারিখে রাত প্রায় ২-৩০ মিনিটের সময় অভিযুক্ত তার প্রতিবেশীনির ঘরে ঢোকে এবং তাকে যৌন হেনস্থা করে। মামলা রুজু হয়। অভিযুক্ত মধ্যপ্রদেশে হাইকোর্টে আগাম জামিনের আবেদন করে। মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্ট আগামী জামিনের আবেদন মঞ্জুর করে শর্ত দিলেন। যে অভিযুক্ত তার স্ত্রীকে নিয়ে অভিযোগকারিনীর বাড়িতে যাবে এক বাক্স মিষ্টি এবং রাখি নিয়ে এবং নির্যাতিতাকে আবেদন করবে তাকে রাখি পরিয়ে আশীর্বাদ করতে এবং অভিযুক্ত প্রতিশ্রুতি দেবে সে সারাজীবন অভিযোগকারীনিকে বোন হিসাবে দেখবে। সে অভিযোগকারীনিকে ১১০০০/-টাকা এবং তার ছেলের জন্য আরো পাঁচ হাজার টাকা দেবে।
এই আদেশের প্রতি সমাজসেবী আইনজীবি অপর্ণা ভাট সুপ্রীম কোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
এই মামলার আলোচনা প্রসঙ্গে সুপ্রীম কোর্ট আরো কিছু মামলার উল্লেখ করেন। ২০২০ সালে কর্ণাটক হাইকোর্ট ধর্ষণের মামলায় আগাম জামিনের দরখাস্তের শুনানীর সময় জামিন মঞ্জুর করবার যুক্তি হিসেবে উল্লেখ করেন যে, নির্যাতিতা তার অভিযোগে বলেন যে তিনি রাত এগারোটায় তার অফিসে গেছিলেন। তিনি এটাও বলেন যে তিনি কোনো অভিযুক্তের সাথে মদ পানে আপত্তি করেন নি। তিনি ধর্ষকের সাথে বাকি রাত কাটিয়েছিলেন এবং তিনি বলেছেন যে ঘটনা ঘটাবার পর তিনি ক্লান্তিবশত ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এই ব্যাখ্যা একজন মহিলার শোভা পায় না। এদেশের মহিলারা এরকম আচরণ করেন না। (Rakesh B Vs. State of Karnatak)
সুপ্রীম কোর্ট আরো একগুচ্ছ মামলার উল্লেখ করলেন যেখানে ধর্ষিতাকে বিয়ে করবে এই শর্তে ধর্ষকের জামিন হয় তার মধ্যে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায় Sopikul Sk Safikul Islam Vs. State মামলা যেখানে নাবালিকা ধর্ষিতা ইতিমধ্যে সাবালিকা হয়েছেন এবং ধর্ষক তাকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছেন। সুতরাং অভিযুক্তকে জামিন দেওয়া হলো। POCSO আইনের মতো গুরুতর অপরাধের গুরুত্ব লঘু করা হয়। এ বিষয়ে পথিকৃৎ অবশ্য এলাহাবাদ হাইকোর্ট।
সুপ্রীম কোর্ট বিরক্তির সাথে উল্লেখ করলেন vikash Garg vs. State of Haryana মামলায় পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার হাইকোর্টের দৃষ্টিভঙ্গীর যেখানে জামিনের যুক্তি হিসাবে হাইকোর্ট ধর্ষিতার 'casual relationship', 'pro-miscuous attitude' 'voyeuristic mind' ইত্যাদি শব্দবন্ধ ব্যবহার করলেন।
এই মামলায় সুপ্রীম কোর্ট কিছু কঠিন নির্দেশ দিয়েছিলেন তার মধ্যে ছিলো "(d) Bail Condition and orders should avoid reflecting streotypical or patriar-chal motions about women and their place in society, and must strictly be in accordance with the requirements of the Cr. P.C. in other words, discussion about the dress, behaviour, or past 'conduct' or 'morals' of the prosecutrix should not enter the verdict granting bail;
(e) The courts while adjudicating cases involving gender related crimes, should not suggest or mandate mendiation between the accused and the survivor, or any form of compromise as it is beyond their powers and jurisdiction;
(f).........;
(g) especially should not use any words, spoken or written that would under-mine or shake the confidence of the survivor in the fairness and impartiality of the court
সুপ্রীম কোর্ট আরো বললেন মামলা চলাকালীন বিচারকেরা পুরানো বদ্ধমুল ধারণা যথা (১) মহিলারা সাধারণতঃ দুর্বল এবং তাদের রক্ষণাবেক্ষণ দরকার হয়; (২) মহিলারা স্বাধীনভাবে স্বতন্ত্র সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম; (৩) পুরুষ হচ্ছে পরিবারের প্রধান; (৪) আমাদের সংস্কৃতি অনুযায়ী মহিলারা বাধ্য এবং নম্র হবেন; (৫) তারা সতীত্ব রক্ষা করে চলবেন; (৬) মাতৃত্বই মহিলাদের সর্ব্বোচ্চ কামনা এবং এটাই তার দায়িত্ব এবং কর্তব্য; (৭) তার সন্তানদের দেখাশোনা করাই মহিলাদের একমাত্র কাজ; (৮) রাতে একা বেরোনো বা অশালীন পোশাক মহিলাদের উপর আক্রমণের প্রধান কারণ; (৯) মহিলাদের ধূমপান বা মদ্যপান তাদের উপর আক্রমণের কারণ হয়ে ওঠে; (১) মহিলারা অকারণে নাটক করেন সুতরাং তাদের বক্তব্য সতর্কভাবে বিবেচনা করা দরকার এবং (১১) শারীরিক আঘাত না থাকলে সম্মতি ধরে নেওয়া যেতে পারে ইত্যাদি উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকবেন।
মথুরা রেপ কেসে ভারতের সুপ্রীম কোর্টের গায়ে যে নারীবিদ্বেষী দূরপনেয় কলঙ্ক লেগে ছিলো অপর্ণা ভাটের মামলায় সুপ্রীম কোর্ট তা মুছে ফেললেন। এই পদ্ধতি অবশ্য অনেক আগেই শুরু হয়েছিলো। এই মামলার রায়ে সুপ্রীম কোর্টের লিঙ্গ বৈষম্য বিরোধী অবস্থান চূড়ান্ত রূপ পেল। আমাদের দুর্ভাগ্য সুপ্রীম কোর্টের এই স্পষ্ট নির্দেশ সত্ত্বেও আমরা দেখছি ভারতের বিভিন্ন কোর্ট ধর্ষক ধর্ষিতাকে বিয়ে করবে এই শর্তে ধর্ষকের জামিন মঞ্জুর করছেন।
আধুনিক পরিণত ভারতের বিচারব্যবস্থা অতি দ্রুত এই নারীবিদ্বেষী এবং মধ্যযুগীয় পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণার অবসান ঘটিয়ে আধুনিক হয়ে উঠবেন এটা আশা করা উচিত।
মহিলারা স্বাধীন এবং স্বনির্ভর। তিনি কোথায় যাবেন, কখন যাবেন, কি পোষাক পরবেন কি আচরণ করবেন সেটা তার স্বেচ্ছাধীন। তাকে আক্রমণ, নির্যাতন বা হেনস্থা করার অধিকার কারো নেই। যদি কেউ করে তবে তাকে তার কৃতকর্মের যথাযথ সাজা দিতে হবে।
এতদসত্ত্বেও মেয়েটা যাবে, যেখানে খুশী যখন খুশী।
ঋণ: সোসাল জাস্টিস