About Us | Contact Us |

ওয়াকফ সম্পত্তি সংশোধনি বিলের নেপথ্য লক্ষ্য

লিখেছেন : আ,ফ,ম ইকবাল
ওয়াকফ সম্পত্তি সংশোধনি বিলের নেপথ্য লক্ষ্য

যেমনটা মিডিয়ার মাধ্যমে দেশবাসী দেখেছেন, সংসদের চলমান বর্ষাকালীন অধিবেশনে কেন্দ্রীয় সরকার বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট ) ওয়াকফ আইন সংশোধনী বিল-২০২৪ পেশ করেছে। সকল বিরোধীদলীয় সদস্যরাই এই বিলের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। তার চাইতে বড় কথা- সরকারের মিত্রদল টিডিপিও এই বিল সমর্থন করতে অস্বীকার করেছে। টিডিপি সাংসদ জিএম হরিশ বালযোগীর প্রস্তাব অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত বিলটি সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। অর্থাৎ আপাতত বিলটি এক ছত্রাকের দৌলতে সংসদে পাস না হয়ে ঝুলে রইল ঠাণ্ডা বস্তায়। যা মোদিজীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের প্রথম ধাক্কা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। 
        লোকসভায় বিল উত্থাপন করে সংসদিয় দপ্তরের মন্ত্রী কিরেন রিজিজু বলছিলেন, সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে এই সংশোধনী আইনের মাধ্যমে ওয়াকফ বোর্ড সমুহকে প্রদত্ত সীমাহীন ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করা, এর কার্যকারিতা স্বচ্ছ করা  এবং এতে সমাজের সকল অংশের, বিশেষ করে নারী ও মুসলিমদের দুর্বল অংশের অংশগ্রহণ বাড়ানো। কিন্তু বিরোধী দলগুলো একবাক্যে বিশ্বাস করে যে, এর পেছনে সরকারের উদ্দেশ্য সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তৈরি করা এবং ওয়াকফ বোর্ডের জমি দখল করা। শেষ পর্যন্ত যদি সংখ্যার ভিত্তিতে সরকার বিলটি পাস করিয়ে নিতে পারে, তাহলে নিঃসন্দেহে সংখ্যালঘুদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়বে। তাদের হতাশার আরও একটি কারণ হয়ে দাঁড়াবে।  
           ওয়াকফ আইন সংশোধনী বিল-২০২৪ -এর শেষ পরিণতি কি হয়, তা সময়ই বলে দেবে। আমাদের আজকের আলোচনার প্রসঙ্গ সেটি নয়। আমরা বরং আজ যাচাই করে দেখতে চাইব সংসদে এধরনের বিল উত্থাপনের সম্ভাব্য প্রেক্ষাপট কি হতে পারে ? 
           বিলটি সংসদে উত্থাপিত হবার আগেই জানিনা কেমন করে তা পৌঁছে গিয়েছিল, অথবা পৌঁছানো হয়েছিল মিডিয়ার কাছে। তাই বেশ কদিন ধরে সম্ভাব্য সংশোধনী বিল নিয়ে মিডিয়ায় তোলপাড় হচ্ছিল। তখন এই বিষয়ে কিছু পুরনো কাগজপত্র খোঁজাখুঁজি করে যে সুত্র হস্তগত হলো, তা রিতিমত চাঞ্চল্যকর ! 
        ২০১৭ সালের ২২ জুলাই The Hindu কাগজের এক একটি প্রতিবেদন। প্রতিবেদনে বলা হয়- 'মুকেশ আম্বানির বাড়ি অ্যান্টিলিয়া যে জমিতে দাঁড়িয়ে আছে, সেই জমির বিষয়ে তার অবস্থান স্পষ্ট করার জন্য শুক্রবার বম্বে হাইকোর্ট ওয়াকফ বোর্ডকে একটি নোটিশ জারি করেছে।
       প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর এবং বিচারপতি এন এম জামদারের একটি ডিভিশন বেঞ্চ জালনার বাসিন্দা আব্দুল মতিনের করা আবেদনের শুনানি গ্রহণ করছিল। জনাব মতিন তার সম্পত্তি বিক্রিতে ওয়াকফ বোর্ডের অব্যবস্থাপনার অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। আদালতকে জানানো হয় যে, বিষয়টি ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্টে শুনানি হয়েছে। আদালত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে, শেষ পর্যন্ত মামলাটি 'এডজর্ণ' করে দিয়েছে- কেবলমাত্র বোর্ডকে একটি নোটিশ জারি করে'।  
       পরবর্তীতে আরও অনুসন্ধান করে বিষয়টির উপর যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপলব্ধ হয়েছে, তাই তুলে ধরার চেষ্টা করছি। মুম্বাইয়ের জনৈক করিম ভাই ইব্রাহিম ১৯৮৬ সালে তাঁর পৈতৃক জমি ওয়াকফ করে তা মহারাষ্ট্র ওয়াকফ বোর্ডের হাতে সমজিয়ে দিয়েছিলেন এই প্রতিশ্রুতি সহ যে, ওয়াকফ বোর্ড যেন এই জমিতে একটি এতিমখানা এবং একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে। 
         ওয়াকফ বোর্ড করিম ভাই ইব্রাহিমের সেই জমি গ্রহণ করে বটে, কিন্তু তাঁর ওয়াদা পালন না করে উল্টো চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে বসে। কোথায় এতিমখানা আর স্কুল তৈরি করবে , সকল ওয়াকফ আইন কানুন উপেক্ষা করে সেই জমিখণ্ড ধনকুবের মুকেশ আম্বানির কাছে বিক্রি করে দেয়। আম্বানি সেই মাটির উপর গড়ে তুলেন নিজের 'রাজমহল', ২৭ তলা বিশিষ্ট অ্যান্টিলিয়া !
         ওয়াকফ আইন অনুসারে কোনো ওয়াকফ প্রপার্টি নিতান্ত আবশ্যকতায় হস্তান্তর করতে হলে চাই সংশ্লিষ্ট বোর্ড সদস্যদের দুই তৃতীয়াংশের মতৈক্য। কিন্তু মহারাষ্ট্র স্টেট ওয়াকফ কমিটি সেই নিয়মের বিপরীত ৯ সদস্য বিশিষ্ট ওয়াকফ বোর্ড কমিটির মাত্র ৫ জন সদস্যের মতামত নিয়ে করিম ভাই ইব্রাহিমের  ওয়াকফকৃত জমি বিক্রি করে দেয়। অত্যন্ত মূল্যবান সেই জমিখণ্ড পেয়ে মুকেশ আম্বানি এর উপর বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল রাজমহল বাকিংহাম প্যালেসের আদলে তাঁর 'অ্যান্টিলিয়া' গড়ে তুলেন।  
          আম্বানির সঙ্গে মহারাষ্ট্র ওয়াকফ বোর্ডের ভূমি হস্তান্তর সংক্রান্ত চুক্তিটি সম্পন্ন হয় ২০০২ সালে। দেশের অর্থনৈতিক রাজধানী মুম্বাই শহরের এই অত্যন্ত মূল্যবান ভূমি খণ্ডের জরিপ এবং মূল্য জানতে ইচ্ছে করছে নিশ্চয়। আসুন, জেনে নিই উল্লিখিত ভূমি খণ্ডের মাপজোখ এবং আম্বানি প্রদত্ত বিনিময় মূল্য। 
           করিম ভাই ইব্রাহিমের ওয়াকফ কৃত যে জমিখণ্ড মহারাষ্ট্র রাজ্যিক ওয়াকফ বোর্ড মুকেশ আম্বানির কাছে বিক্রি করেছিল, তার আয়তন হচ্ছে ৪,৬০০ বর্গমিটার। মুকেশ আম্বানি সেই প্লটটি ক্রয় করেছেন কুল্লে ২১.৫ কোটি টাকার বিনিময়ে। 
        আম্বানির সঙ্গে মহারাষ্ট্র ওয়াকফ বোর্ডের এই চুক্তিটি শুরু থেকেই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। যার ফলে এই ক্রয়বিক্রয় প্রক্রিয়া মুম্বাই হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হয়। যেহেতু বিবাদের সঙ্গে অত্যন্ত প্রভাবশালী ও ধনাঢ্য গোষ্ঠীর স্বার্থ জড়িত রয়েছে, সেই স্বার্থ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়,  সেজন্য আদালত কেবল 'তারিখ-পে-তারিখ' দিয়ে চলেছে।  
        উল্লেখ্য যে, ২০২৩ সালের আগস্ট মাসেও  তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার একটি নোটিশ জারি করে ওয়াকফ বোর্ডের সমস্ত সম্পত্তি সরকারের দখলে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা করেছিল। সেই প্রচেষ্টায় তখন সাফল্য মেলে নি। যার পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে এবার ওয়াকফ আইন সংশোধনের অজুহাতে সেই পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হয়েছে।
        কেন্দ্রীয় সরকার ওয়াকফ আইন সংশোধনী বিল-২০২৪ এর মাধ্যমে মোট ৪৪টি সংশোধনী আনতে চাইছে। সরকার বলছে যে,  এই বিল আনার উদ্দেশ্য হচ্ছে ওয়াকফ সম্পত্তির উন্নত ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার ব্যবস্থা করা। ওয়াকফ আইনের নাম পরিবর্তন করে তা করা হবে ‘United Waqf Management, Empowerment, Efficiency and Development Act, 1995’. অর্থাৎ একীভূত ওয়াকফ ব্যবস্থাপনা, ক্ষমতায়ন, দক্ষতা ও উন্নয়ন আইন ১৯৯৫।   
        কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিল এবং রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডে মুসলিম ও অমুসলিমদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব থাকবে বলে সংশোধনী আনতে চাওয়া হচ্ছে। যে সম্পত্তি কেবল একটি সম্প্রদায়ের মানুষের বদান্যতায় গড়ে উঠেছে, তার পরিচালনায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধির  অন্তর্ভুক্তিকরণের পেছনে কী কারণ থাকতে পারে, তা প্রশ্নবোধক চিহ্ন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে যে এই সংশোধনী কি মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর সরাসরি আক্রমণ নয় ?   
         সে যাই হোক, আগেই যেমনটা বলেছি, প্রস্তাবিত ওয়াকফ সংশোধনী বিলের উপর বিস্তৃত আলোচনা এই আলোচনার উদ্দেশ্য নয়। 
আলোচ্য বিষয় প্রস্তাবিত বিলের পেছনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। উপরোক্ত আলোচনার পর কেবল কিছু কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। দেশবাসী দেখেছেন তিনটি বিতর্কিত কৃষি আইন নিয়ে কিভাবে কৃষকদের বছরব্যাপী আন্দোলন করতে হয়েছে। বছরাধিক সময় ধরে চলা সেই আন্দোলনের সময় প্রায় ছয় শতাধিক কৃষক শহীদ হয়েছিলেন। তারপর সরকারের সম্বিত ফিরে এসেছিল। সরকার তিনটি আইনই সংসদের মাধ্যমে বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল। 
        কিন্তু, যেসব পরিপ্রেক্ষিত তিন কৃষি আইনের পেছনে লুকিয়ে বিরাজ করছিল, তা অনেকেরই নজরে আসে নি। কৃষি আইনের মাধ্যমে কর্পোরেট সংস্থাগুলোর জন্য কৃষিজাত সামগ্রীর বাজার খুলে দেয়ার ব্যবস্থা করবার আগেই বিভিন্ন রাজ্যে গড়ে উঠেছিল আদানির কোল্ড স্টোরেজ এবং বিশাল বিশাল ভান্ডার। অর্থাৎ কৃষি আইনের লক্ষ্য ছিল এক বিশেষ কর্পোরেট হাউসের ফায়দা পৌঁছানো, যা আখেরে ফেল হয়ে যায়। 
        ঠিক তেমনি ওয়াকফ আইন সংশোধনী বিলের পেছনেও কোনো বিশেষ কর্পোরেট মিত্রের সম্পত্তির নিরাপত্তা প্রদান মূল উদ্দেশ্য নয়তো ? দেশের বিদ্বৎমহলে এই প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে বারবার। 
        একটি প্রচলিত প্রবচন দিয়ে এই লেখা সমাপ্ত করতে চাইছি, সাম্প্রতিক একটি দাওয়াতের কথা মনে করে। কারো নুন খেলে তার গুণ গাইতে হয় ! 
         
তথ্যসূত্রঃ  
https://www.indiatoday.in/magazine/nation/story/20101213-maharashtra-fantasy-home-in-wakf-trouble-745012-2010-12-02

আ,ফ,ম ইকবাল
আ,ফ,ম ইকবাল

বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও সমাজ-চিন্তক