About Us | Contact Us |

মানুষ কি শুধু মানুষের জন্য ?

লিখেছেন : আ,ফ,ম ইকবাল
মানুষ কি শুধু মানুষের জন্য ?

'মানুষ মানুষের জন্য'- এক চরম সত্যকথন। মানুষ যদি মানুষের জন্য হলোনা, তাহলে কেন তার মনুষ্য জীবন ?  
     কিন্তু আরও খানিকটা ব্যাপক অর্থে চিন্তা করলে আমরা ভাবতে বাধ্য হই- মানুষ কি শুধু মানুষের জন্য ? নিশ্চিতভাবে তার উত্তর আসবে- না। মানুষ কেবলমাত্র মানুষের জন্য নয়। মানুষ এমন ক্ষুদ্র জীব নয় যে সে শুধু মানুষের জন্যই ভাববে, মানুষের জন্যই তার সকল কর্ম সকল ধর্ম সকল ধ্যান নিবিষ্ট করে রাখবে। প্রকৃতার্থে মানুষ এই সংকীর্ণতার অনেক উর্ধ্বে। হ্যাঁ, এই সংকীর্ণতা থেকে উর্ধ্বে অবস্থান করে যখন ব্যাপকভাবে সারা সৃষ্টিজগতের জন্য ভাবতে এবং তার কর্ম ও ধ্যানধারণাকে পরিচালিত করতে পারবে, তখনই হবে তার মানব জীবন স্বার্থক ও সফল।  
     কথাগুলো কেন বলতে হচ্ছে এভাবে ? আমরা, অর্থাৎ মানুষ নামক প্রজাতি আজ বড্ড স্বার্থপর হয়ে উঠছি। প্রথমত আমরা নিজেদের পরিমণ্ডলকে এতোটাই সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে নিয়েছি যে শুধুমাত্র নিজের আর নিজের পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই নিজেদের পরিব্যাপ্ত করে রেখেছি। 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে'- নিশ্চিতভাবে এটি মানুষের চিরন্তন প্রাথমিক চাহিদা। কিন্তু যখন এই চাওয়াটা পরম হয়ে পড়ে, তখন মানুষ বড় একা, ভীষন স্বার্থপর।  আমার পরিজন, আমার প্রতিবেশী, আমার আমার সমাজ, আমার স্বদেশ ভাবনা যদি আমার মধ্যে ক্রিয়াশীল না থাকে, তাহলে আমাতে আর অবলা প্রাণীদের মধ্যে তফাৎ কোথায় ? গর্তে বসবাসকারী একটি ইঁদুর ও তার নিজের আর বাচ্চাদের খাবার যোগাড় করতে নিত্য এবং নিয়মিত নিজেকে পরিব্যাপ্ত রাখে।  
     সৃষ্টি জগতের দিকে লক্ষ্য করলে আমরা স্পষ্টতই অনুভব করতে পারি যে জগতের সকল সৃষ্ট প্রাণীকুলকে সৃষ্টি করা হয়েছে কোনো না কোনো ভাবে মানুষের কল্যাণের জন্য। মানুষের উপকার এবং উপভোগের জন্য। এবং হয়তো এই কারণেই কেবলমাত্র মানুষকে দেয়া হয়েছে সৃষ্টির অনন্য গুণ রেশন্যালিটি বা বিচারবুদ্ধি। যার মাধ্যমে একটি বিরাট হাতীকেও মানুষ পোষ মানিয়ে নিজেদের আবশ্যক কাজকর্মে ব্যবহার করতে পারে। সমুদ্রের গভীরে অবস্থান করা বিশালাকার তিমি মাছকে শিকার করে নিজেদের আবশ্যকতা অনুসারে ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু কোনো বন্যপ্রাণী কি কখনও কোনো মানুষকে ধরে নিয়েছে তাদের কোনো প্রয়োজন মেটানোর জন্য ? তর্কের খাতিরে কেউ বলতে পারেন মানুষখেকো বাঘ তো কখনও ধরে নিয়ে যায় ! হ্যাঁ, কখনো তা হয়, কিন্তু সে শুধু অভুক্ত প্রাণীর সাময়িক উদরপূর্তির নিমিত্তে। ব্যবহারের জন্য নয়। যেমন মানুষ বন্য ঘোড়াকে ধরে এনে পোষ মানিয়ে তাকে দিয়ে গাড়ি টানায়।  
     এবার কথা হলো এই যে যাবতীয় প্রাণী তথা জীবজন্তুর সেবা মানুষ গ্রহণ করে থাকে, নিজেদের ভুরিভোজন থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনে নানা প্রয়োজনীয়তায় কোনো না কোনোভাবে জীবজন্তু, গাছপালা ইত্যাদি ব্যবহারিক জীবনে উপভোগ করে থাকে, সেই সৃষ্টি জগতের প্রতি কি এই উপভোগের বাইরে আর কোনো দায়ভার বা করণীয় নেই ? যদি নাই বা থাকবে, তাহলে মানুষ স্রষ্টার প্রতিনিধি বা খলিফা হতে পারে কেমন করে ? মানুষ কেবলমাত্র মানুষের জন্যই যদি জীবন ধারণ করবে, তাহলে কি করে এমন স্বার্থপর প্রজাতি সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে দাবি করতে পারে ? 
       কিন্ত সেই বিবেকবান মানুষ পৃথিবীতে এসে কি বিবেক দ্বারা পরিচালিত হয়েছে? না, বেশির ভাগই হয়নি। মানুষ নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে ধরেই নিয়েছে পৃথিবীটা তার একার। বিগত সময়ে যেমন আমরা করোনা থেকে বাঁচতে সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ কামনা করেছি। পৃথিবীর অন্য জীবেরা হয়তো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য প্রার্থনা করেছে। ওই সব জীবের ভাষা তার সৃষ্টিকর্তা ঠিকই বুঝেছেন। আমরা মানুষেরা তা বুঝিনি। 
     মানুষের কারণে পৃথিবী থেকে বহু জীবের অস্থিত্ব বিলুপ্ত হয়েছে। আমরা বোমা বানিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে, কারখানা বানিয়ে বায়ু দূষণ করেছি। পানি দূষিত করেছি। বহু জীবকে হত্যা করেছি। ধর্মের নামে বর্ণের নামে নিজেরা হানাহানি করছি। একে অপরকে খুন করে নৃশংস উল্লাস করছি ! আমরা মানুষেরা একবারও কি ভেবেছি আমাদের কারণে যে সকল জীবের অস্থিত্ব বিপন্ন হচ্ছে তাদের ও আমাদের সৃষ্টিকর্তা একই। না, তা ভাবনি। সেই অবকাশই নেই আমাদের। 
      নগরায়নের নামে আমরা গাছপালা কেটে ধ্বংস করে চলেছি। পাখীর আবাস ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছি। নদী ভরাট করছি। সমুদ্রে হানা দিয়েছি। আমরা মানুষেরা কি করিনি ! ফলে পৃথিবী এখন বিপর্যস্ত।  
      মনে পড়ে আয়লান কুর্দির দুনিয়া কাঁপানো সেই ছবির কথা। যে নিস্পাপ শিশুটির নিথর মরদেহ পড়েছিল সমুদ্র সৈকতে। মনে পড়ে বোমার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত সিরীয় সেই শিশুটির কথা- আহত হয়ে যে বলেছিল ‘আমি ঈশ্বরকে সব বলে দেবো’। হয়তো অন্যান্য জীবেরা সে রকম কথাই ঈশ্বরকে বলেছে- তাদের সৃষ্টিকর্তাকে বলেছে। আমরা মানুষে তাদের ভাষা জানি না বলে বুঝিনি। 
      সর্বাধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমুন্নত মানুষ কি শুধু মানুষ হত্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে ? 
আমাদেরই জন্য সৃষ্ট সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলায় সুশোভিত এই পৃথিবীতে মানুষ যেন সুস্থ, স্বাচ্ছন্দ্য ও সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে পারে- এজন্য যা যা প্রয়োজন, সব কিছুই বিশ্বস্রষ্টা বিছিয়ে দিয়েছিলেন এই  বিশ্বের পরতে পরতে। অথচ মানুষ স্রষ্টার দেয়া উপহার, এই নয়নাভিরাম পরিবেশকে নিজের হাতেই নষ্ট করেছে। তাই স্রষ্টাও মাঝে মাঝে মানুষের টুঁটি চেপে ধরছেন। মানুষকে ঘরবন্দি করে প্রকৃতির মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। বিগত দুটি বছরে মানুষ ঘরবন্দি থাকায় মিল ফ্যাক্টরির কালো ধোঁয়ায় নীল আকাশ কালো হয় নি। বাতাসে ভাসেনি রাসায়নিক বিষ। নোংরা হয়নি নদী-সাগরে পানি। তাই সাগরের প্রাণীরা আজকাল অনেকটা স্বচ্ছন্দে খেলা করতে পারছে সমুদ্রের তীর ঘেঁষে ঘেঁষে। সমুদ্রসৈকতে নতুন করে ফুটছে সাগর লতা। মানুষ ছাড়াও যে পৃথিবী সুন্দর থাকতে পারে, বিধাতা যেন করোনাভাইরাসের মাধ্যমে তাই-ই দেখিয়ে দিয়েছেন। 
     এখন আমাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই সুন্দর পৃথিবীতে আমরা যদি সুন্দর হয়ে থাকতে চাই, তাহলে অবশ্যই আমাদের হৃদয়কে করতে হবে পরিশুদ্ধ। সহনশীলতা গড়ে তুলতে হবে মানুষ পশুপাখি উদ্ভিদ লতাগুল্ম কীট পতঙ্গ সকল সৃষ্ট প্রাণীকুলের প্রতি। শপথ নিতে হবে- হত্যা নয়, পৃথিবীর সকল সৃষ্টির প্রতি আমরা হবো সহানুভূতিশীল, সংবেদনশীল, দায়িত্ববান।
       আমি সর্বদা মনুষ্যত্বে বিশ্বাসী। মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব ফিরে আসুক, সেই প্রত্যয় ব্যক্ত করে থাকি সবসময়ই। মানুষ কেবল মানুষের জন্য- এই ক্ষুদ্র ভাবধারার উর্ধ্বে উঠে তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে আমাদের ধ্যানধারণা, আমাদের কর্ম এবং তার বাস্তবায়নে। পরিশেষে তাই এটুকুই কামনা ব্যক্ত করি- মানুষ হয়ে উঠুন জীব শ্রেষ্ঠ, সকল জীবের প্রতি সহানুভূতিশীল। মানুষের পরিচয় হয়ে উঠুক মানুষ হিসেবে- যে হবে জ্ঞানতই মানুষ।

আ,ফ,ম ইকবাল
আ,ফ,ম ইকবাল

বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও সমাজ-চিন্তক