প্রস্তাবনা :
আফগানিস্তানে তালিবানদের ক্ষমতায় ফিরে আসা,মার্কিন সেনার চুক্তি মাফিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং সেদেশে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি স্বাভাবিক ভাবে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যথেষ্ট আলোড়ন ফেলেছে। ভারতবর্ষও তার ব্যতিক্রম নয়।প্রতিক্রিয়ায় রূপটি যদি আমরা সাদা চোখে দেখি তাহলে দুধরণের মতামত স্পষ্ট হয়।একটি হল তালিনবানরা জাতীয় মুক্তির লড়াই লড়ছে এবং তারা আমেরিকার মত এক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দখল থেকে আফগানিস্তানকে মুক্ত করেছে।দ্বিতীয়টি হল মার্কিন সৈন্য অপসারণ, সেখানকার সরকারের অবলুপ্তি এবং তালিবানদের ক্ষমতালাভের ফলে সেদেশ আবার তার গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা হারিয়ে অন্ধকার যুগে ফিরে গেল।এই দুই বিপরীতমুখী মতামতের অনুষঙ্গে অনেকে আবার পঞ্জশির উপতক্যায় তালিবানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধরত নর্দান অ্যালায়েন্সকে সমর্থন করে আমেরিকা সহ সবার কাছে মুজাহিদিনদের এই গোষ্ঠীকে সাহায্যের আবেদন করেন।এখনো পর্যন্ত ঘটনাবলীতে এটা স্পষ্টযে তালিবানদের সরকার গঠন আর বিশ্ব শক্তির অনুমোদন সময়ের অপেক্ষা। বর্তমান নিবন্ধে আমরা এই মতামতগুলির বাস্তবতা পরীক্ষা করব এবং সেদেশের বর্তমান পরিস্থিতির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও গৃহযুদ্ধের চরিত্রটি সম্পর্কে মূল্যায়ণ করার চেষ্টা করব।
ইতিহাসের আলোকে আফগানিস্তান :
আফগানিস্তান সম্পর্কে চালু কথা হল শেষ পর্যন্ত কোন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সেদেশে জয়ী হতে পারে না।বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশরা পরাজিত হয়েছিল,এবার লজ্জাজনক অপসারণ ঘটল মার্কিনীদের।আবার একথাও সত্য আফগানিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই বারবার সেদেশ বহিরাগতদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। ব্যাবিলনিয় সম্রাট প্রথম দারায়ুস ৫০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে এবং ম্যাসিডোনিয়ার সম্রাট আলেকজান্ডার ৩২৯ খ্রীস্টপূর্বাব্দে এই ভৌগোলিক অঞ্চল দখল করেন।১১০০ শতাব্দীতে গজনীর সুলতান মামুদ ইরান থেকে ভারতবর্ষ পর্যন্ত সামরিক অভিযান করেন।তবে ১৭০০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত আফগানিস্তান কোন ঐক্যবদ্ধ দেশ ছিল না।এসময় বিভিন্ন আরব শাসকরা এখানকার বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের দখলদারি কায়েম করেন।এই সময়েই এই অঞ্চলের মানুষেরা ইসলাম ধর্মের দ্বারা প্রভাবিত হন বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন।উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় ব্রিটিশরা তৎকালীন ভারতের শাসক হিসাবে আফগানিস্তান দখলের চেষ্টা চালায়।১৮৩৮-৪২,১৮৭৮-৮০ এবং ১৯১৯-২১ সাল পর্যন্ত দফায় দফায় ইন্দো- ব্রিটিশ বনাম আফগান যুদ্ধ হয়।এই যুদ্ধই সম্ভবত ব্রিটিশদের সবচাইতে দীর্ঘযুদ্ধ ও ব্রিটিশরা এই যুদ্ধে পরাজিত হয়।১৯১৯ সালের ১৯ আগস্ট রাওয়ালপিন্ডি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার দিনটিকে আফগানিস্তানের স্বাধীনতা দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়।আমানুল্লা খান রাজা হিসাবে আফগানিস্তানকে একটি আধুনিক দেশ হিসাবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন।
আমরা যদি বিগত একশ বছরের ইতিহাসে চোখ ফেরাই তাহলে দেখতে পাব সংস্কার ও আধুনিকতার সঙ্গে মোল্লাতন্ত্র ও পশ্চাৎপদ সামন্ত বাদী সংস্কৃতির দ্বন্ধ ধারাবাহিক ভাবে চলেছে।১৯১১ সালে মাহমুদ বেগ তারজি তার ' সিরাজ-আল-আখবার' পত্রিকার মাধ্যমে কাবুলে আধুনিকতার প্রশ্নে বিতর্ক শুরু করেন।এ কাজে তাকে যোগ্য সঙ্গত করেন তার পত্নী আসমা রেশমা খানুম।এই দম্পতির কন্যা সোরাইয়া তারজিকে বিবাহ করেন রাজা আমানুল্লা।প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য এই সময় আফগানিস্তানের শিক্ষিত অভিজাতদের মধ্যে তুরস্কের কামাল পাশা আতাতুর্কের সদর্থক প্রভাব ছিল। সেই সময় সংবিধানের ৬৮ নং ধারায় প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়,অনেকগুলো কো- এডুকেশন স্কুল খোলা হয় এবং মহিলাদের পর্দা প্রথা বাধ্যতামূলক নয় ঘোষণা করা হয়।১৯২১ সালে আশমা রেশমা খানুম ও রাণী সোরাইয়া সেদেশে প্রথম মহিলাদের স্কুল খোলেন যার নাম ছিল ' মক্তব- ই- মাশুরাত'।এছাড়া আমানুল্লার এক বোন রাজকুমারী কোবরা নারী সুরক্ষার জন্য ' আঞ্জুমান -ই-হিমায়েতি-ই-নিশান' গড়ে তোলেন।এই সংস্কার কিন্তু মোল্লাতন্ত্রকে রাজার বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল।এই বিক্ষোভকে মদত দেয় ব্রিটিশরা কারণ আমানুল্লার শাসনকে অস্থির করা তার লক্ষ্য ছিল।আমানুল্লা ও তার পত্নীর ইউরোপ ভ্রমনের সময়ে পর্দা ছাড়া ছবি তোলা,ইউরোপীয় রাজন্যবর্গের সাথে রাণীর ছবি ব্রিটিশরা সুকৌশলে আফগানিস্তানে ছড়িয়ে দেয়।তখন সেদেশের রক্ষণশীল অংশ এক যুদ্ধবাজ সামন্ত নায়কের ( হাবিবুল্লাহ কালাকানি) নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে আমানুল্লাকে ক্ষমতাচ্যুত করে।তারা মেয়েদের স্কুল বন্ধ করে,পর্দা প্রথা বাধ্যতামূলক করে এবং সংস্কারগুলিকে বাতিল করে।শেষ পর্যন্ত রাজতন্ত্র টিকে যায় কিন্তু আধুনিকীকরণের গতি রুদ্ধ হয়।
এর পর আমানুল্লা খানের বিরুদ্ধে জাহির শাহ যুদ্ধ করে ক্ষমতা দখল করে ও রাজা হিসাবে প্রায়৪০ বছর শাসন করেন।এখানে একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে প্রতিবেশী সোভিয়েত ইউনিয়নের কারণে কমিউনিস্ট মতাদর্শ নিয়ে আলোচনা সেদেশে বলশেভিক বিপ্লব পরবর্তী সময় থেকেই ছিল । ১৯৫৩ সালে জাহির খানের তুতো ভাই মহম্মদ দাউদ খান সে দেশের প্রধানমন্ত্রী হন এবং তিনিও মতাদর্শগত ভাবে আধুনিকতার পক্ষে ছিলেন।গত শতাব্দীর ষাটের দশক ছিল সারা পৃথিবীতে গণ আন্দোলন ও ছাত্র আন্দোলনের উর্বর সময়।সারা পৃথিবীর ছাত্র আন্দোলন আফগানিস্তানের যুবকদের এক নতুন পৃথিবীর জন্য উদ্বেল করে তুলেছিল।১৯৬৫ সালে সেখানে কমুনিস্ট দল ' পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান ' গড়ে ওঠে।নূর মহম্মদ তারাকি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও বারবাক কামাল উপ সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন।ঐ একই সময়ে ডাঃ আনাহিতা রাবজাদার নেতৃত্বে সেদেশে ' ডেমোক্রেটিক উওমেন অর্গানাইজেশন অব আফগানিস্তান ' তৈরি হয়।
১৯৭৩ সালে আফগান রাজতন্ত্রের বিলোপ ঘটে এবং দাউদ খান আফগান প্রজাতন্ত্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট হন। দাউদ খান ছিলেন লিবারেল ডেমোক্র্যাট এবং তিনি সাক্ষরতার হার,শিক্ষার বিসৃতার,জনগণের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নে আন্তরিক আগ্রহী ছিলেন। আবার বৈদেশিক ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরাণের সঙ্গে সমন্বয় করে চলতে চাইতেন।আভ্যন্তরীন ক্ষেত্রে তিনি কমিউনিস্ট বিরোধী হিসাবে পরিচিত ছিলেন।দাউদ খানের শাসনকালে কমিউনিস্টরা তাদের প্রভাব বাড়াতে থাকে।১৯৭৮ সালের ১৮ এপ্রিল শ্রমিক নেতা মীর আকবর খাইবার খুন হন।জনগণের সন্দেহ ছিল দাউদ খান প্রশাসন এই খুনের পিছনে আছে।সেদিন কাবুলের রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ তাদের প্রিয় নেতাকে শেষ বিদায় জানাতে সমবেত হয়।আতঙ্কিত দাউদ খান প্রশাসন পিডিপিএ নেতাদের পাইকারি হারে গ্রেপ্তার করতে শুরু করে।ফল হয় উল্টো।২৮ এপ্রিল সেনা অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখল করে।
বিপ্লব ১৯৭৮ :
১৯৭৮ সালে আফগানিস্তানে বামপন্থীদের ক্ষমতা লাভ অবশ্যই এক দিকবদলের সূচনা করে।এই ঘটনা ব্রিটেন ও আমেরিকাকে হতচকিত করে তোলে।জনগনের স্বতঃস্ফূর্ততাকে লক্ষ্য করে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে লেখা হয় -- " 150,000 persons.... marched to honour the new flag.... the participants appeared genuinely enthusiastic "।এই নতুন সরকার ছিল ধর্মনিরপেক্ষ, আধুনিক ও তার কর্মসূচীতে সমাজতন্ত্রী ভাবনার ছাপ ছিল স্পষ্ট। তবে তাদের ক্ষমতালাভের পেছনে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ মদতের কোন প্রমাণ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায় নি।তবে ঠান্ডা যুদ্ধের সেই সময়ে আফগানিস্তান ছিল সোভিয়েত সরকারের মিত্র দেশ।বামপন্থীদের ক্ষমতা লাভের আগে আফগানিস্তান ছিল পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশগুলির মধ্যে একটি। দেড় কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র কুড়ি লক্ষ শহরবাসী।অবশিষ্ট এক কোটি তিরিশ লাখ গ্রামীণ জনগনের মধ্যে ১৫ লক্ষ মানুষ তখনও প্রাক- সামন্ততান্ত্রিক যাযাবর জীবন যাপন করে।জনসংখ্যার ৯৫% নিরক্ষর। মোট জমির ৮৮% অনাবাদী।আবাদযোগ্য জমির ৪৫% এর মালিকানা মাত্র ৫% জমির মালিকের হাতে।গ্রামীণ জনগণের এক তৃতীয়াংশ ভূমিহীন মজুর বা ভাগচাষী। গ্রামের দরিদ্র কৃষক সকলেই মহাজনী ঋণের নাগপাশে বাঁধা। ১৯৭৮ সালে আফগানিস্তানের কোন গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না।দেশে মোট শিল্প শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৫০ হাজারের কম।জিডিপির মাত্র ১৭% আসত শিল্প থেকে।
খুব অল্প সময়ের মধ্যে নতুন বামপন্থী সরকার সেদেশে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়-- (১) কৃষি জমির সিলিং বেঁধে দেওয়া হল।উদ্বৃত্ত জমি গরীব কৃষকদের মধ্যে বন্টন করা হল।প্রথম বছরেই আট লক্ষ একর জমি ১,৩২,০০০ পরিবারের মধ্যে বন্টন করা হয়।গরীব কৃষকদের মহাজনী ঋণ থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।(২) শিল্প কারখানাগুলির জাতীয়করণ করা হয়।১৯৭৮ সালে জাতীয় আয়ের ৩% আসত খনিজ শিল্প থেকে, ১৯৮৮ সালে সেটা বেড়ে হল ১০%।প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যে একশোর বেশি নতুন শিল্প কারখানা হল।(৩) নারীশিক্ষা, নিরক্ষরতা দূরীকরণ অগ্রাধিকারের ক্ষেত্র হিসাবে বিবেচিত হল।বরপণ নিষিদ্ধ হয়।মেয়েদের নিজেদের পছন্দ মত বিয়ে করার অধিকার স্বীকৃতি পায়।কয়েকবছরের মধ্যে দেখা গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অর্ধেক মহিলা।এছাড়া চিকিৎসকদের ৪০%,শিক্ষকদের ৭০% ও সরকারি আধিকারিকদের ৩০% মহিলা।(৪) সেচ ও পানীয় জলের দায়িত্ব হল রাষ্ট্রের। হাসপাতালে বেড বাড়ল ৮৪%, ডাক্তার বাড়লো ৪৫%।এই ভাবে এক আধুনিক দেশ তৈরির ভিত তৈরি হল।
অপারেশন সাইক্লোন :
১৯৭৮ সালে বামপন্থীরা সেদেশে যে সংস্কারের সূচনা করে তার সামনে বছর পূর্তির আগেই ভয়ংকর প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয় সৌজন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেদেশের বামপন্থী সংস্কার ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ক্ষমতাসীন পিডিপিএ নেতৃত্বের ক্রমবর্ধমান সখ্যতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আশঙ্কিত করে তোলে।১৯৭৯ সালের ৩ জুলাই আমেরিকান জনগনকে না জানিয়ে ও কংগ্রেসকে পাশ কাটিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টার আফগানিস্তানের জনপ্রিয় সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ৫০০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের গোপন পরিকল্পনা করে যার সাংকেতিক নাম ছিল ' অপারেশন সাইক্লোন '।এই পরিকল্পনা রচনা করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা নেন তীব্র কমিউনিস্ট বিরোধী, পোলিশ উদ্বাস্তু তথা মার্কিন রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা উপদেষ্টা বিগনিউ ব্রেজনস্কি।তিনি মার্কিন সরকারকে বোঝান যদি আফগানিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করে সেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নকে টেনে আনা যায় তবে তা রাশিয়ার জন্য আরেক ভিয়েতনাম তৈরি হবে।মার্কিন পরিকল্পনাকে সাকার করার জন্য আফগানিস্তানের সামন্ত প্রভু ও ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তিগুলিকে একত্রিত করে সেদেশে এক গৃহযুদ্ধের সূচনা করা হয়।
আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা সি আইএ দ্বারা পরিচালিত সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও ব্যয়সাপেক্ষ এই অভিযান ' ডলার জেহাদ ' নামে পরিচিত। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের এই পরিকল্পনায় পাকিস্তানের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সেদেশের দেওবন্দী মাদ্রাসা গুলোই ছিল আফগানিস্তানের ছাত্রদের ইসলামিক শিক্ষা কেন্দ্র। সত্তরের দশকে এসে সৌদি আর্থিক অনুদানের সঙ্গে সঙ্গে সৌদি ওয়াহাবি মতবাদের প্রভাব এই মাদ্রাসাগুলোকেও গ্রাস করল।এই মাদ্রাসাগুলো ব্যবহৃত হতে লাগলো মৌলবাদের গর্ভগৃহ হিসাবে।আফগান সমাজের জাতিগত বৈচিত্র্যর কারণে আফগান বামপন্থী সরকার বিরোধী জেহাদি সংগঠনগুলো অনেকগুলি উপধারায় বিভক্ত ছিল।সিআইএ - এর আর্থিক মদতে এবং পাক আইএসআই- এর নেতৃত্বে আফগান মুজাহিদিনদের সাতটি ভিন্ন মুখী ধারাকে একছত্র ছায়ায় আনা হয়।তাদের এই ধর্মযুদ্ধে অংশ নেবার জন্য মধ্য প্রাচ্যের প্রায় চল্লিশ হাজার যোদ্ধা নিয়ে এক মুজাহিদিন বাহিনী গঠিত হয়।এই বাহিনী পরবর্তী কালে ওসামা বিন লাদেনের আল কায়দায় পরিণত হয়।এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যাদের মদত করেছিল তাদের ভাবনা চিন্তার একটা সামান্য পরিচয় জেনে নেওয়া দরকার।আফগানিস্তানের মৌলবাদী ধর্মান্ধ শক্তির অন্যতম নেতা ছিলেন কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলাম ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক বুরহুদ্দিন রব্বানি।তিনি সেদেশে ১৯৭২ সালে জামাত-ই-ইসলামি প্রতিষ্ঠা করেন।দাউদের সময় তিনি দেশত্যাগ করে পাকিস্তান - আফগানিস্তান সীমান্তের উদ্বাস্তু শিবিরগুলিতে মুজাহিদিনদের প্রশিক্ষণ দিতেন।রব্বানি ছিলেন বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহের ঘোষিত সমর্থক এবং নারী স্বাধীনতা ও শিক্ষার তীব্র বিরোধী। রব্বানির অন্যতম সহচর ছিলেন গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার যিনি স্কুলের ছাত্রীদের উপর অ্যাসিড মারার জন্য কুখ্যাত ছিলেন।এরা মেয়েদের কি চোখে দেখতেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় যখন মুজাহিদিন সরকার পরবর্তীতে ঘোষনা করে মেয়েরা স্কুলে যাবে না তার কারণ শিক্ষায়তন আসলে বেশ্যালয়।আধুনিক সমরাস্ত্র সজ্জিত মুজাহিদিনদের গৃহযুদ্ধ বামপন্থী সরকারকে দুর্বল করে দেয়।এই অবস্থায় সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট লিওনেদ ব্রেজনেভের নির্দেশে তার সামরিক বাহিনী আফগানিস্তানে প্রবেশ করে।এই সিদ্ধান্ত ছিল আত্মঘাতী কারণ গোটা বিশ্বের কাছে সোভিয়েত বহিরাগত শক্তি হিসাবে প্রতিভাত হয়।গৃহযুদ্ধ আরো তীব্র হশ এবং পেরেস্ত্রোইকার জমানায় গর্বাচভ ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত বাহিনী প্রত্যাহার করে।১৯৯২ সালে কাবুলে বামপন্থী সরকারের পতন হয়।রাষ্ট্রপুঞ্জের ভবন থেকে বার করে এনে বামপন্থী রাষ্ট্রপতি নাজিবুল্লাকে ফাঁসিতে ঝোঁলানো হয়।
তালিবানের জন্মকথা :
'তালিব' কথাটির আরবীয় ভাষায় অর্থ 'শিক্ষার্থী'।পাস্তুন ভাষায় তালিবের বহুবচন ' তালিবান'।নাজিবুল্লাহ সরকারের পতনের পর আফগান মুজাহিদিনদের ঐক্যের পর্ব সমাপ্ত হয়।রব্বানি,হেকমতিয়ার ও নর্দান অ্যালায়েন্সের মাসুদ গোষ্ঠীর মধ্যে গৃহযুদ্ধ চলে ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। এই সময় থেকেই আফগানিস্তানে তালিবানদের উত্থান শুরু হয়।দক্ষিণ আফগানিস্তানের কান্দাহারের পাশে মোল্লা ওমর নামের একজন প্রাক্তন মুজাহিদিন এক মাদ্রাসা চালাত।তার ছাত্ররাই তালিবান নামে পরিচিত ছিল।
পাখতুন উপজাতি অধ্যুষিত এইসব পশ্চাতপদ এলাকায় প্রশাসনের কোন অস্তিত্ব না থাকার কারণে অবাধে আফিম চাষ ও চোরা চালান ছিল এইসব এলাকার অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড। পৃথিবীর মোট আফিমের ৯৩% এ দেশে উৎপন্ন হয়।আর জিডিপির অর্ধেকের বেশি আসে এই অবৈধ উৎপাদন থেকে।চোরাচালান,লুঠ,খুন,অপহরণঅশিক্ষিত গ্রামীণ উপজাতিগুলোর জীবনের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।তখন আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে সক্রিয় হয় মোল্লা ওমর ও তার ছাত্ররা।প্রথমে এদের আর্থিক সমর্থন জোগায় কুয়েত্তা ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি তাদের মাল পরিবহনের নিরাপত্তার জন্য। ক্রমে স্থানীয় ভূস্বামী, জমির মালিক,মহাজন,ব্যবসায়ী-- সবাই এই জেহাদি ইসলাম ও পাখতুনওয়ালি সংস্কৃতির (আত্মমর্যাদা, সাহস,বদলা ও আতিথেয়তা) মেলবন্ধনে গড়ে ওঠা নতুন তালিবান শক্তিকে তাদের সম্পদ ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য সমস্ত রকম সমর্থন দিল।মাত্র তিনমাসের মধ্যে প্রায় বিনা বাধায় তালিবানরা দক্ষিণ আফগানিস্তানের বারোটা প্রদেশ দখল করে ফেলল।পাকিস্তান সরকার ও ইসলামিক আন্তর্জাতিক সংগঠন আল কায়দার পূর্ণ সহযোগিতা নিয়ে ১৯৯৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তালিবান কাবুলের দখল নিল।তালিবানি শাসন মানে ছিল মধ্যযুগীয় অন্ধকার।আফগানিস্তানের সমাজ ব্যবস্থায় মধ্যযুগীয় সামন্ত সম্পর্কের বিরুদ্ধে যে কোন প্রতিস্পর্ধাকে সে ধর্মীয় অনুশাসনের কঠোরতায় দমন করে।
ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের গল্প :
ঘটনা প্রবাহ থেকে এটা পরিষ্কার আফগানরা কোন আন্তর্জাতিক জেহাদ শুরু করে নি।আমেরিকার সেই সময়ের পররাষ্ট্রনীতির সমর্থন নিয়ে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সি আই এ আন্তর্জাতিক জিহাদের ধাত্রীর ভূমিকা পালন করেছিল।চেচনিয়া,সৌদি আরব,মিশর,জর্ডান,উজবেকিস্থান এবং উত্তর আফ্রিকান দেশগুলির মত মুসলিম দেশ থেকে অশিক্ষিত অথবা অল্পশিক্ষিত যুবকদের নিয়ে এক জেহাদি বাহিনী তৈরি করা হয় যাতে তারা ' ধর্মহীন ' কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের ' ইসলাম ' বাঁচাতে একটি ' পবিত্র যুদ্ধ ' শুরু করতে পারে।সৌদি ওয়াহাবি আর সালাফি প্রচারকদের মাধ্যমে তাদের মগজ ধোলাই করা হয়।পাকিস্তানের উপজাতীয় অঞ্চলগুলিতে তাদের জন্য শিবির তৈরি করা হয়েছিল। মার্কিন সামরিক শিল্প তাদের অবিরাম অস্ত্র জোগায় এবং মার্কিন করদাতাদের টাকায় তালিবান সহ সমস্ত জেহাদি গোষ্ঠী পুষ্ট হয়।এই নীতি শেষ পর্যন্ত ওসামা বিন লাদেনের আল-কায়দা বা মোল্লা ওমরের তালিবানের মত ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের জন্ম দেয়।বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে বহু আলোচিত তবু একটা পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করা যেতে পারে।নোবেল জয়ী প্রখ্যাত ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী স্যার মার্টিন এওয়ান্স তার বইতে উল্লেখ করেছেন-- ' আফগান আরব গেরিলা যাদের মধ্যে প্রধান ছিল আলকায়দা তারা পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আই এস আই এর মাধ্যমে সি আই এ -র থেকে সব ধরণের সাহায্য পেয়েছিল।প্রায় ৩৫ হাজার আরবের সন্ত্রাসবাদীকে পাকিস্তানে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে সি আই এ- র দেওয়া অর্থ ও সমরাস্ত্রের সাহায্যে। লাদেনের দীর্ঘ দিনের সহকর্মী মৌলবী জালালউদ্দিন হক্কানি ও গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার সরাসরি আই এস আই এর সাহায্য পেয়েছিল '।
এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের আঘাত (৯/১১) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নড়িয়ে দেয়।তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাবলু বুশ ওসামা বিন লাদেনকে তাদের হাতে তুলে দেবার জন্য চরম পত্র দেন।কাবুলের তালিবান সরকার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার হামলায় লাদেনের জড়িত থাকার প্রমাণ চায় এবং বলে বিচারের পর তারা লাদেনকে অপরাধী হলে মার্কিনীদের হাতে তুলে দেবে।যদিও আন্তর্জাতিক মহলে সুপার হিরোর ইমেজ পুনঃ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বুশ সেই আবেদন অগ্রাহ্য করে সেদেশে বোমা বর্ষণ করে ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর। সাত দিন পর কাবুল জানায় বোমা বর্ষণ বন্ধ হলে তারা লাদেনকে কোন তৃতীয় দেশের হাতে তুলে দেবে।কিন্তু বুশের অভিযান বন্ধ হয় নি।ডিসেম্বরের মধ্যে তালিবানরা পরাভূত হয়।মোল্লা ওমর পালিয়ে যানএমনকি তখন লাদেনকেও খুঁজে পাওয়া যায় নি।মার্কিনদের আধিপত্যকে ন্যায্যতা দিতে জাতিপুঞ্জ হস্তক্ষেপ করে এবং হামিদ করজাইকে আফগানিস্তানের অন্তর্বত্নীকালীন সরকারের প্রধান করা হয়।২০০২ সালের এপ্রিল মাসে জর্জ বুশ ঘোষণা করেন -- " By helping to build an Afghanistan that is free from this evil and is a better place in which to live, we are working in the best traditions of George Marshall "।
আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রকল্পিত গণতন্ত্রের স্বরূপ :
অনেকে বলার চেষ্টা করছেন আফগানিস্তানে তালিবানদের ক্ষমতালাভের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিভাবকত্বে গড়ে ওঠা ' গণতান্ত্রিক মডেল' টা ধ্বংস হয়ে গেল।একটি স্বাধীন দেশকে পরাধীন বানিয়ে সেখানে একটি পুতুল সরকার বসিয়ে দেশচালনা কোন গণতন্ত্রের লক্ষ্মণ তা জবাব দেওয়ার দায় অবশ্য গণতন্ত্রের এই স্বঘোষিত বন্ধুদের নেই তবুও আলোচনার এই পর্বে খুব সংক্ষেপে আমরা গত কুড়ি বছরে আফগানিস্তানের অবস্থাটা ঠিক কি দাঁড়িয়েছে তা দেখে নেব।
প্রথমে একটা কথা জোরের সঙ্গে বলা দরকার গত কুড়ি বছরে আফগানিস্তানে কোন শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় নি।বন্দুকের গুলি,বোমা,কামান আর যুদ্ধ বিমানের দাপাদাপি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কুড়ি বছরে তালিবানদের সামরিক ভাবে উৎখাত করতে এবং তালিবানদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য সরকারি আফগানবাহিনী তৈরি করতে ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে।এই আফগান ন্যাশানাল আর্মিতে তিন লক্ষ সেনা ছিল।একটি আমেরিকান গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে ৩,৪৮৭ জন আমেরিকান সৈন্য মারা গেছে।আফগানিস্তানে পুনর্গঠন কাজের সঙ্গে যুক্ত বেসরকারি কনট্রাকটর মারা গেছেন ৪,০০০ জন,যাদের মধ্যে সিংহভাগ বিদেশি। সরকারি আফগান সেনার মধ্যে মৃতের সংখ্যা ৮৪,০০০ এর বেশি।তাদের ভাষ্য অনুযায়ী ' বিরোধী পক্ষ ' ( পড়ুন তালিবান) মারা গেছে ৯০,০০০। আর এই রক্তাক্ত যুদ্ধক্ষেত্রে দু-পক্ষের বাইরে সাধারণ মানুষ ( সিভিলিয়ান) মারা গেছেন ৮,৭৫,০০০।বাসভূমি থেকে সংঘর্ষের কারণে উচ্ছেদ হয়েছেন ৩৫ লাখ মানুষ। তাই বিগত সময়ে আফগানিস্তানে শান্তি বিরাজ করত বলে যে প্রচার করা হচ্ছে তা সর্বৈব মিথ্যা।
আফগানিস্তানে ২০০১-১১ সময় পর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ বিধ্বস্ত অঞ্চলের পুনর্গঠনের কাজে ১৪৪.৯৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠার কাজে ৩৬.২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করে।আফগানিস্তান পুনর্গঠনের কাজের মূল্যায়ণ করতে গিয়ে স্পেশাল ইন্সপেক্টর জেনারেল মন্তব্য করেছেন এই বিপুল টাকার অন্তত ২০% পকেটস্থ করেছে স্থানীয় অফিসাররা।আবার মার্কিন সংবাদপত্রকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ করজাই মন্তব্য করেছিলেন মার্কিন কনট্রাক্টররা একটা বড়ো অংশের টাকা কমিশন হিসাবে খেয়ে নিচ্ছে।তাই টাকার অঙ্ক যাই হোক না কেন সেদেশের গ্রাম ও দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে পুনর্গঠন কাজ কিছুই হয় নি।বরং প্রথম সুযোগেই তালিবানরা এই জায়গাগুলো পুনরুদ্ধার করেছে।
আফগানিস্তানের অর্থনীতিরও কোন উন্নতি হয় নি বরং আজ তার আরো ভঙ্গুর অবস্থা। ২০১৫-১৯ সময়পর্বে সেদেশে গড় জিডিপির পরিমাণ ছিল ২.৫%।২০২০ সালে জিডিপির বৃদ্ধি ছিল মাইনাস ২.৮%।এই সময় পর্বে বেকারির হার ৩৭.৯%।তবে আমেরিকা যখন আফগানিস্তানের বিভিন্ন অংশে তাদের সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করছিল তখন তাতে প্রচুর আফগান যুবক কাজ করার জন্য (২০০১-১০) বেকারির হার কম ছিল।বিশ্বব্যাঙ্কের প্রতিবেদন অনুসারে আজ আফগানিস্তানের নিজস্ব অর্থনীতি বলতে কিছু নেই, পুরোটাই বিদেশি অনুদান ও ঋণ নির্ভর। ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী সেদেশের জিডিপির ২২ শতাংশ বিদেশি এজেন্সি নির্ভর। এই বেহাল অর্থনীতির কারণে সিংহভাগ আফগান আজ হতদরিদ্র।
এবার আসা যাক বর্তমানে সর্বাধিক আলোচিত নারী শিক্ষা ও নারী স্বাধীনতার প্রশ্নটি নিয়ে।একথা অনস্বীকার্য যে গত কুড়ি বছরে আফগানিস্তানে নারী শিক্ষা ও স্বাধীনতার প্রশ্নে কোন বাধা নিষেধ ছিল না।তালিবান শাসনে মেয়েদের উপর যে মধ্যযুগীয় বর্বরতা দেখা গেছে তার তুলনায় অবস্থা অনেক ভালো।কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সত্যি যে এই ভালোটা মূলত কাবুল সহ সেদেশের শহরগুলোতে সীমাবদ্ধ ছিল। এই সময় সেদেশে ৭০-৮০% নাবালিকা অবস্থায় বলপূর্বক বিয়ে দেওয়া হয়।৯০% গার্হস্থ্য হিংসার শিকার।গ্রামাঞ্চলে সাক্ষর মেয়েদের হার মাত্র ২০%।আর যদি মানব উন্নয়ন সূচকে দেশটাকে বিচার করা হয় তবে ছবিটা ভয়ঙ্কর। ২০০১ সালে ১৮৯ টি দেশের মধ্যে আফগানিস্তানের স্থান ছিল ১৬২ যা আজ ১৬৯।তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে রফতানি করা গণতন্ত্রে সাধারণ আফগানের কোন ভালো হয় নি।
গত কুড়ি বছরে আফগানিস্তানে যে সমস্ত নির্বাচন হয়েছে তাতে ধারাবাহিক ভাবে গণতান্ত্রিক নীতি ও মূল্যবোধকে লুণ্ঠন করা হয়েছে।২০০১ সালের ২১ ডিসেম্বর হামিদ করজাইকে সেদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান বানায় আমেরিকা ও ব্রিটেন।এরপর ২০০৪ সালে লোকদেখানো একতরফা নির্বাচনে ৮০ লক্ষ ভোট পড়ে।সেই সময় কারা এই ৮০ লক্ষ ভোট দিয়েছিল তা নিয়ে তীব্র বিতর্ক ওঠে। তখন সেদেশের লোকসংখ্যা ছিল ২ কোটি ১৬ লক্ষ ৬৯ হাজার ৮৮ জন।নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ রাষ্ট্রপুঞ্জের পক্ষ থেকেও স্বীকৃতি পায়।২০০৯ সালে হামিদ কারজাই পুনঃনির্বাচিত হওয়ার সময়েও দেশজুড়ে ছাপ্পা ভোটের অভিযোগ ওঠে।২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে যখন আশরাফ গণি নির্বাচিত হন তখন গন্ডগোল এতটাই চরমে ওঠে যে মার্কিন স্বরাষ্ট্র সচিব জন কেরির মধ্যস্থতায় ফল ঘোষণা হয়।মোদ্দা কথা হল এই সব পুতুল সরকারকে আফগানরা কখনোই নিজেদের স্বাধীন, সার্বভৌম সরকার বলে মেনে নেয় নি।
মার্কিন সেনার ফিরে যাওয়া- এক সুচারু চিত্রনাট্য :
মার্কিন সেনার প্রত্যাবর্তন,আধুনিক অস্ত্রে সমৃদ্ধ তিন লাখ আফগান সরকারি সেনার বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ এবং তালিবানদের বিজয় যাদের হতচকিত করে তুলেছে তারা বাস্তব পরিস্থিতিটা একেবারেই উপলব্ধি করতে পারছেন না।সমস্ত বিষয়টাই এক সুচারু চিত্রনাট্য যা লেখা শুরু হয়েছিল অনেকদিন আগে থেকেই। আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা হাত উঠিয়ে নেওয়ার কথা প্রথম ভাবতে শুরু করে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময় থেকে।কিন্তু পরামর্শদাতাদের চাপে তিনি পরিকল্পনা থেকে পিছিয়ে আসেন।বরং ক্রমাগত তালিবান হানার মুখে দাঁড়িয়ে তিনি সেদেশে আরো ১৭,০০০ সেনা পাঠান।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান থেকে সরে আসার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয় ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারিতে ( তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প) যখন কাতারের দোহা শেরাটন হোটেলে মার্কিন প্রশাসন ও তালিবানদের মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।তালিবান মিডিয়া প্রধান এই চুক্তি প্রসঙ্গে তাদের উল্লাস প্রকাশ করে বলেন-- ' the defeat of the arrogance of white house in the face of the white turban'।এই চুক্তি স্বাক্ষর করেন আমেরিকার পক্ষে জালমে খলিলজাদ ও তালিবানদের পক্ষে আব্দুল গণি বেরাদর।চুক্তির শিরোনাম ছিল-- "Agreement for bringing peace to Afghanistan between the Islamic Emirate of Afghanistan which is not recognised by the united states as a state and is known as the Taliban and the United States of America '।চার পাতার এই দলিলটিতে কোন রকম অস্পষ্টতা না রেখে বলা হয় আগামী ১৪ মাসের মধ্যে আমেরিকা সেদেশ থেকে সেনা সরিয়ে নেবে এবং তালিবানদের ক্ষমতায় আসা নিশ্চিত করবে।এই দলিল সারা পৃথিবীর কাছে জানা ছিল এবং পরিস্থিতির অনিবার্যতা বুঝেই প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি প্রচুর টাকা পয়সা নিয়ে আগেই দেশ ছেড়ে পলাতক হয়েছেন।এই চুক্তিকে সম্পূর্ণ ভাবে সমর্থন করে চিন,পাকিস্তান ও রাশিয়া।রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদেরও এই চুক্তি নিয়ে কোন বিরোধিতা ছিল না।সবচেয়ে বড়ে কথা হল এই আলোচনায় মার্কিন মদদপুষ্ট আফগান সরকারকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি।এই চুক্তি সম্পাদনের পর কাবুল স্থিত আমেরিকান দূতাবাস থেকে টুইট করে বলা হয় আফগানিস্তানের শান্তি ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য আজকের দিনটি সব অর্থেই ঐতিহাসিক। এই চুক্তি ছাড়া আমেরিকার আর কোন পন্থাই ছিল না।আমেরিকান নাগরিকের করের অর্থ যথেচ্ছ ভাবে খরচ করে ও প্রচুর আমেরিকান সৈন্যের প্রাণের বিনিময়ে আমেরিকা এই অঞ্চলে কোন সাফল্যই অর্জন করতে পারে নি।যে আমেরিকা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অন্তহীন যুদ্ধের কথা বলে তারাই দোহাতে হাক্কানি নেটওয়ার্কের সঙ্গে সমঝোতা করে যারা আমেরিকার ঘোষিত সন্ত্রাসবাদী গোষ্টী তালিকার উপরের দিকের নাম।এই চুক্তিতে আমেরিকা যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার মধ্যে রয়েছে আগামী দিনে তালিবান জমানা যাতে কোন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার সন্মুখীন না হয় তার ব্যবস্থা করা,তালিবান সরকারকে রাষ্ট্রপুঞ্জের স্বীকৃতি দান,অর্থনৈতিক সাহায্য প্রভৃতি। এককথায় খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় তালিবানরা কাবুলের মসনদে বসল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়ের তাৎপর্য :
একথা জলের মত স্পষ্ট যে সামরিক শক্তির সাহায্যে অন্য দেশে ' গণতন্ত্র ' রফতানির মার্কিন প্রকল্পের আবার পরাজয় ঘটেছে। একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠে গেছে ' এক মেরু' বিশ্বের প্রতিভূ ' আমেরিকান শতকের ' স্থায়িত্ব নিয়ে।১৯৪১ সালে ' লাইফ ' পত্রিকায় হেনরি লুস প্রথম ' আমেরিকান শতক ' কথাটা ব্যবহার করেন। এই আধিপত্য কামী ধারণা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এক আগ্রাসী পররাষ্ট্র নীতি নিতে প্ররোচিত করে।ঠান্ডা
যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক অবসানের পর ১৯৯৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির এক নতুন তত্ত্বায়ন হয় যার নাম 'Project for the New American Century '।এই তত্ত্বের সমর্থকরা ' neoconservative '( নিউকন) নামে পরিচিত। এই মডেলের উপর বড়ো আঘাত আফগানিস্তানে মার্কিন ব্যর্থতা।বিখ্যাত ঐতিহাসিক উইলিয়াম ডালম্পিয়ের এই পরাজয়কে ভিয়েতনামের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড়ো 'Foreign Policy Failure ' আখ্যা দিয়েছেন।
ইতিহাসের পাতায় যদি আমরা চোখ ফেরাই তবে দেখতে পাব কোরিয়া যুদ্ধের (১৯৫০-৫৩) সময়ে প্রথমে চিনের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় সাড়া দেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান।পরে ৫৪,০০০ মার্কিন সেনা ও কয়েক লক্ষ কোরিয় জনগনের মৃত্যুর পর পরাভূত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শান্তি আলোচনায় সায় দিয়ে দেশে ফেরে।ভিয়েতনামে তাদের শোচনীয় পরিণতির কথাও কারো অজানা নয়।' wespon of mass destruction ' এর বাহানা তুলে ইরাক আক্রমণ (২০০৩) এর নীট ফল থেকেছে শূন্য বরং ঐ গোটা অঞ্চলে আইসিসের মত মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির উত্থান ঘটেছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অন্তহীন যুদ্ধের কি পরিণতি হল তা বোঝার জন্য আফগানিস্তান যথেষ্ট। প্রসঙ্গ ক্রমে এ তথ্যটাও উল্লেখ করা দরকার যে 'War on Terror ' এ এখনো পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৬.৪ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে এবং তারা আজ পৃথিবীর সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত দেশ।কিন্তু অনেকে আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়ের সঙ্গে ভিয়েতনামের ঘটনার তুলনা করছেন যা কখনো সত্যি নয়।ভিয়েতনামের রাজধানী সায়গনের পতন ছিল অবশ্যই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পরাজয়ের প্রতীক কিন্তু একই সঙ্গে তা ছিল ভিয়েতনামের জনগনের মুক্তি যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে জয়লাভ করে তারা সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তিকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছিল। কিন্তু আফগানিস্তানে তালিবানের ক্ষমতা দখল সেখানকার জনগণের জন্য মুক্তির বার্তা বয়ে আনছে না।মধ্য এশিয়ায় মার্কিনীদের একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের নীল নকশা এখানে পরাজিত হল,আপাতত এটুকুই বলা যায়।
শেষ বিচারে আজকের আফগানিস্তান :
কাবুলে পট পরিবর্তন আফগানিস্তানের মানুষের কাছে এক দুঃখজনক অধ্যায়ের সমাপ্তি এবং অন্য এক দুঃখজনক অধ্যায়ের সূচনা হিসাবে ব্যক্ত করা যেতে পারে।এই মুহূর্তে ভয়,অনিশ্চয়তা ও বিশৃঙ্খলাই সেখানে নিয়ম।তালিবান নিজে তার অর্জিত ক্ষমতার নেশায় মত্ত হয়ে রয়েছে এবং যুদ্ধের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির বিভাজন তালিবানকে অভ্যন্তরীণ বিবাদে জড়িয়ে ফেলেছে। গনি সরকারের পতনের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির শুধু পরাজয়ই হয় নি বরং আমেরিকা ও তার মিত্র শক্তির রাজনৈতিক,সামরিক ও আদর্শগত দিক দিয়েও অবমাননা হয়েছে।তালিবান যতই ক্ষমাসুন্দর ভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করুক, তার আসল মূর্তি আফগানিস্তানের জনগণের জানা হয়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যেই মহিলা এবং সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে ছাঁটাই করা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে।তালিবানরা এক ' অন্তর্ভুক্তিমূলক' সরকার গঠনের কথা বলেছে যা গত কুড়ি বছর ধরে কারজাই ও গনি সরকারেরও প্রতিশ্রুতি ছিল। এবারো তার বাস্তবায়নের কোন আশা নেই। তালিবান তার কাজের ধরনের কিছু পরিবর্তন করেছে কিন্তু তাদের মুখপাত্র জবিবুল্লাহ মুজাহিদ বলেছেন তালিবানদের মতাদর্শ ও মৌলিক বিশ্বাসের কোন পরিবর্তন হয় নি।
সাম্রাজ্যবাদী সাহায্যের উপর নির্ভরশীল একটি অর্থনীতি এবং পূর্ববর্তী জমানা থেকে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্র তালিবানরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। দেশীয় আয়ের অভাব এবং কৃষি ও শিল্পের ধ্বংস প্রাপ্তির ফলে তালিবানদের বেঁচে থাকতে হবে কোন না কোন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মুখাপেক্ষী হয়ে।বিগত বিশ বছরে তালিবানের প্রধান শ্লোগান ছিল বিদেশি দখলদারির অবসান ও ইসলামি শরিয়া আইনের উপর ভিত্তি করে সরকার গঠন।তাই এক উগ্র ধর্মীয় শাসনব্যবস্থা সময়ের অপেক্ষা। সেই শাসনে ব্যক্তিগত,সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার কোন অস্তিত্ব থাকবে না জাতিগত উগ্রতা আগামী শাসনের এক বৈশিষ্ট্য হবে।মূলতঃ পাখতুনদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হবে।উজবেক, তাজিক ও সুন্নি হাজারার মত সংখ্যা লঘু গোষ্টীগুলি এবারো জাতিগত নিপীড়নের শিকার হবে।এছাড়া তালিবানদের নিজেদের মধ্যে বিরোধ ( কোয়েটা শুরা ও পেশোয়ার শুরা) নতুন মাত্রা পাবে।এই বিরোধের কারণে তালিবানরা এখনো সম্পূর্ণ সরকার বানাতে পারে নি।এককথায় গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি বজায় থাকবে।পরিস্থিতি পাল্টাতে পারে আফগান জনতার মুক্তি সংগ্রাম। সেই সংগ্রামকে নেতৃত্ব দেওয়ার মত শক্তি আপাতভাবে দুর্বল তবে পরিস্থিতির সঠিক পর্যালোচনা ও প্রতিক্রিয়াশীল দের মধ্যেকার লড়াইয়ের সুযোগে বিপ্লবী শক্তির বিকাশের সম্ভাবনা যথেষ্ট।
তথ্যসূত্র কৃতজ্ঞতাঃ দি ইকনমিস্ট,ওয়াশিংটন পোস্ট, ফ্রন্টলাইন,দি হিন্দু এবং নিউজ পোর্টাল নাগরিক ডট,ইস্টার্ন টাইমস,পিপলস ম্যাগাজিন ও নিউজক্লিকে সাম্প্রতিক সময়ে আফগানিস্তান নিয়ে যে সমস্ত লেখাপত্র প্রকাশিত হয়েছে তার থেকে বিভিন্ন তথ্য এই রচনায় ব্যবহার করা হয়েছে।