About Us | Contact Us |

পুরো ওবিসি বিষয়টিকে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে

লিখেছেন : তায়েদুল ইসলাম
পুরো ওবিসি বিষয়টিকে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে

কলকাতা উচ্চ আদালতের ২০২৪ সালের ২২ মে ২০১০ সালের পর স্বীকৃতি প্রাপ্ত সকল ওবিসিকে বাতিল করে দেওয়া রায়ের পর দলিত নেতা সুকৃতি বিশ্বাস ভিডিও পর্যালোচনায় বলেছিলেন মামলা কারীদের গুরু, আইনজীবী, হামলাকারীদের আইনজীবী, সরকার পক্ষের আইনজীবী এবং বিচারপতি সবাই ওবিসি সংরক্ষণ বিরোধী। ন্যায্য বিচার আশা করছি কার কাছে? কিছু দিন পর শীর্ষ আদালতের এক জন আইনজীবী তাঁর চেম্বারে বসে বলেছিলেন আরএসএস এর সবুজ সংকেত না পেলে মুখ্যমন্ত্রী মামলায় যথাযথ ভূমিকা পালন করবেন না। আজকে মনে হচ্ছে তাঁদের মূল্যায়ন ফেলে দেওয়া যায় না। এখনো পর্যন্ত যা অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে রাজ্য সরকার ওবিসি সংরক্ষণ বিষয়টি গুলিয়ে ঘেঁটে দিচ্ছে। শীর্ষ আদালতে মামলা চলাকালীন রাজ্য নতুন করে সমীক্ষা করতে পারে কি না, নতুন বিল আনতে পারে কি না তা নিয়ে আইনজীবীদের মধ্যে মত বিরোধ আছে। শীর্ষ আদালতের নির্দেশ মতো রাজ্য নতুন করে সমীক্ষা করেছে বলায় এক জন আইনজীবী প্রশ্ন করেই বসলেন শীর্ষ আদালতের সে রায়ের কপি কোথায়? তারপরও প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ পশ্চিমবঙ্গ ওবিসি কমিশনের সমীক্ষা রিপোর্ট সহ সুপারিশ শীর্ষ আদালতে জমা দিয়ে শীর্ষ আদালতের রায়ের আগেই রাজ্য নতুন করে বিল আনলেন কেন? সেই বিলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হলে কলকাতা উচ্চ আদালত স্থগিতাদেশ দিয়ে দেয়। যতটুকু জানা গেছে কলকাতা উচ্চ আদালত ২০২৪ সালে রায় দানের সময় যে ধরনের পদ্ধতিগত ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছিল এবারও স্থগিতাদেশ দেওয়ার সময় একই ধরনের পদ্ধতিগত ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছে। নতুন বিলে রাজ্য সরকার ১৪০ টি জনগোষ্ঠীকে ওবিসি স্বীকৃতি দেয়। এই ১৪০ টির মধ্যে পূর্বে বাতিল না করা ৬৬ টি জনগোষ্ঠী আছে। এই ৬৬ জনগোষ্ঠীকে ২০১০ সালের আগে পর্যন্ত স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। এই ৬৬ জনগোষ্ঠীকে কলকাতা উচ্চ আদালত ২০২৪ সালে বাতিল করেনি। তারা এখনো বহাল আছে। তা হলে এই বাতিল না করা গোষ্ঠীগুলিকে নতুন ভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা কেন? । এটা কি জনগণকে ভূল বোঝানো? নাকি ইচ্ছা করে তাদেরকেও বাতিল করার নতুন ফাঁদ তৈরি করা? এতদিন ভর্তি , চাকরি, উচ্চ শিক্ষা সহ সব ক্ষেত্রে ৬৬ টি জনগোষ্ঠীকে ৭% সংরক্ষণের সুবিধা দিয়ে কাজ করা যেত। তা না করে ৬৬ জনগোষ্ঠীকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এতদিন পর এখন আবার বলছে ৬৬ জনগোষ্ঠীর জন্য ৭% সংরক্ষণ দিয়ে কাজ শুরু করবে। এগুলো কি সিদ্ধান্তহীনতা ? না কি পুরো বিষয়টি গুলিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনার অংশ? আবার শোনা যাচ্ছে প্রগ্ৰেসিভ ইন্টেলেকচুয়াল অফ বেঙ্গল বলে স্বঘোষিত একটি অংশ ৬৬টি গোষ্ঠীর স্বীকৃতি বাতিল করার জন্য কলকাতা উচ্চ আদালতে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মনে হচ্ছে এই সিদ্ধান্তও ওবিসি সংরক্ষণ বিষয়টিকে গুলিয়ে দেওয়ার অংশ। যেমন ২০১০ সাল থেকে স্বীকৃতি প্রাপ্ত গোষ্ঠীগুলির অবস্থা অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলে গেছে তেমনি ৬৬ গোষ্ঠীর অবস্থাও অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলিয়ে দিতে চাইছে। যে সামান্য অংশ ওবিসি সংরক্ষণ পাওয়ার ব্যবস্থা আছে সেটাকেও বন্ধ করে দিতে চাইছে। ওবিসিদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী লড়াই লাগিয়ে দিতে চাইছে। 
এরই ফাঁকে আর্থিক ভাবে দূর্বল ব্যক্তিদের (EWS) জন্য সংরক্ষণকে তুলে ধরা হচ্ছে। সংরক্ষণের মূল ভাবনাকেই ভুলিয়ে দিতে চাইছে। সংরক্ষণের প্রধান লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হল শাসন ব্যবস্থায় সকল সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্ব। সংরক্ষণ দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচি নয়। আর্থিক ভাবে দুর্বলদের উন্নয়ন এর জন্য দেশের সংবিধানে আইনে অনেক ব্যবস্থা আছে। আরও নতুন নতুন আইন, কর্মসূচি গ্ৰহণ করা যেতে পারে। কিন্তু সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে সে কাজে ব্যবহার করা চালাকি ছাড়া আর কিছু নয়। ক্রমশ কাস্ট, ট্রাইব, ক্লাস ভিত্তিক সংরক্ষণ তুলে দিয়ে শুধুমাত্র আর্থিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে সংরক্ষণ চালু করার দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে এ সব করা হচ্ছে। অর্থাৎ অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্বমূলক কর্মসূচিকে দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচিতে পরিবর্তন করার লক্ষ্যে আমরা এগোচ্ছি। এখানে প্রতিযোগিতা হবে অসম প্রতিদ্বন্দ্বিদের মধ্যে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে কথিত উচ্চ বর্ণের ছেলেমেয়েদের সাথে পিছিয়ে রাখা সমাজের ছেলেমেয়েদের। ফলে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাবে তারাই যারা দীর্ঘদিন ধরে সমাজের সব ক্ষেত্রে সংখ্যা অনুপাতে অনেক বেশি সংরক্ষণ ভোগ করে আসছে।
উচ্চ বর্ণের মধ্যে কৃষক সম্প্রদায়গুলি হল পতিদার, মারাঠা, জাঠ ইত্যাদি। এই জাতগুলি সরকারি চাকরি ও উচ্চ শিক্ষায় নিজেদের জাতের জন্য সংরক্ষণের দাবি তুলেছিল অনেক আগেই। নিজেদের জাতের উন্নতির জন্য তারা মহারাষ্ট্রে মারাঠা আন্দোলন, গুজরাটে পতিদার আন্দোলন এবং উত্তর ভারতে জাঠ আন্দোলন গড়ে তোলে। সব আন্দোলনই সময়ে সময়ে হিংস্র হয়ে ওঠে এবং গণআন্দোলনের রুপ নেয়। প্রথম দিকে এগুলি বিজেপি বিরোধী ছিল। আসলে সবই ছিল বিজেপির পূর্ব পরিকল্পিত ছক। প্রথম থেকেই বিজেপির ভিত্তি হল  উচ্চ বর্ণের অগ্ৰবর্তী অংশ। এই ভিত্তিকে উচ্চ বর্ণের কৃষক অংশের মধ্যেও প্রসার করার জন্য অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া বর্গ - র কৌশল বের করে এবং তাদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে।   বিজেপি সংবিধানের তোয়াক্কা না করে " অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া বর্গ" র জন্য ১০% সংরক্ষণের আইন করে। এখানে ঢুকে যায় মারাঠা, পতিদার, জাঠ প্রভৃতি উচ্চ বর্ণের কৃষক গোষ্ঠীগুলি আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়ার অজুহাতে। তাই আর্থিক ভাবে দুর্বলদের জন্য সংরক্ষণ বিজেপির এজেন্ডা। আমরা ওবিসি -রা দীর্ঘ মেয়াদী ফলাফল এর কথা না ভেবে ইডবলুএস সার্টিফিকেট নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছি। শেষ বিচারে ওবিসি সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বর্তমান বিজেপি শাসক দল তথাকথিত ইকনোমিক্যালি উইকার সেকশনস বা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অংশের জন্য সংরক্ষণ নীতি চালু করেছে যা শুধুমাত্র বিশেষ অধিকার প্রাপ্ত জাতিগুলোর ( এস সি, এস টি, ওবিসি নয় এমন) ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যেহেতু সংবিধান অর্থনৈতিক অবস্থার ভিত্তিতে সংরক্ষণকে স্বীকৃতি দেয় না, সেহেতু বর্তমান বিজেপি সরকার এই বিধানকে পাশ করানোর জন্য নিজেদের স্বভাব সিদ্ধ ঔদ্ধত্যে সংবিধানের ১০৩ তম সংযোজন পাশ করে। সংবিধানের মৌলিক কাঠামো নিয়ে কাটাছেঁড়া করেছে। এই সংযোজন সংবিধান বিরোধী হওয়া সত্বেও দেশের শীর্ষ আদালত অনুমোদন করেছে। ই ডব্লিউ এস নির্ধারণের সময় প্রতিবছর ইচ্ছামত বাৎসরিক আয় এবং অন্যান্য মানদণ্ডকে এমনভাবে পরিবর্তন করা হচ্ছে যাতে এসসিএসটি ওবিসি এবং অন্যান্য অংশের খুব সাধারণ গরিব মানুষগুলোকে দারিদ্র্যসীমার উপরে বিবেচনা করা যায় কিন্তু বিশেষ অধিকার প্রাপ্ত জাতি বা উঁচু বর্ণের ক্ষেত্রে  সচ্ছল পরিবারকেও দারিদ্র্যসীমার মধ্যে বিবেচনা করা যায়। "বর্তমান মাপকাঠি হল বাৎসরিক আয়ের সীমা আট লক্ষ টাকা এবং একটা হাজার বর্গফুট ঘরের মালিকানা। এখানে দেখা যাচ্ছে দৈনিক ৭৫ টাকার বেশি উপার্জন করা একটা পরিবারকে দারিদ্র্যসীমার উপরে বিচার করা হল। কিন্তু বিশেষ অধিকার প্রাপ্ত জাতির একটা পরিবার দৈনিক ২২২২ টাকা উপার্জন করলেও সেটাকে বিবেচনা করা হল অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হিসাবে। এই ভাবে নিপীড়নমূলক জাত ব্যবস্থা থেকে ঐতিহাসিকভাবে সুবিধা পেয়ে আসা সম্প্রদায়গুলোর কাছে আরও সুবিধা পৌঁছে দিয়ে সামাজিক ন্যায়ের ধারণাটাকেই গুলিয়ে দিয়েছে। সংরক্ষণের জন্য অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতার বেমানান মানদণ্ডটাকে বৈধ করে দিয়েছে এই সংযোজন। আরও ক্ষতিকর যেটা ঘটেছে সেটা হল জাতভিত্তিক সংরক্ষণের ধারণাটাকে ধ্বংস করার জন্য পথ প্রস্তুত করতে সরকারকে সাহায্য করেছে সুপ্রিম কোর্ট।" ১ রাজ্য সরকারও সেই পথ তৈরি করার জন্য সাহায্যকারীর ভূমিকা পালন করে চলেছে। 

তথ্যসূত্র :

 ১. সংরক্ষণ স্ফুলিঙ্গ ও আগুন, আনন্দ তেলতুম্বে , অনুবাদ সৌমেন মৌলিক, "মাতৃভূমি" পত্রিকার একটি উপস্থাপনা। 

তায়েদুল ইসলাম
তায়েদুল ইসলাম

বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী