লেখাটা যখন লিখছি ক্যালেন্ডারের পাতায় ৪ ঠা জুলাই। আমার এখন যা বয়স, সেই বয়সেই মুর্শিদাবাদে নির্মম ভাবে খুন করা হয় এক যুবককে, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবকে। পলাশী যুদ্ধ কার দায়? সিরাজদ্দৌলা ব্যক্তি মানুষ হিসেবে কেমন? উনিশ - বিশ শতকে জাতীয়তাবাদের স্ফুরণে সিরাজের চরিত্র যে ভাবে আঁকা হয়েছিল বাংলা সাহিত্যে, তিনি সত্যিই অতটা নায়কোচিত ছিলেন কিনা? সেসব বিতর্কে না গিয়ে ফিরে দেখা যাক শেষ স্বাধীন নবাবের জীবনের শেষ কয়েকটি দিন...
পলাশীর যুদ্ধের দিন (জুন, ১৭৫৭) মীরজাফর তার সৈন্যবাহিনীকে যুদ্ধে যোগদান থেকে বিরত রাখেন। সিরাজের বিশ্বস্ত মীরমদন ও মোহনলাল ব্যুহ রচনা করে যুদ্ধ চালিয়ে যান বীর বিক্রমে। তাদের পরাক্রম ক্লাইভের নেতৃত্বাধীন কোম্পানি সেনাদলকে ভয় পাইয়ে দেয়। মীরমদন যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যাওয়ার পর সিরাজ মনোবল হারিয়ে ফেলেন। মীরজাফর সুকৌশলে মোহনলালের সেনাবাহিনীকে সেদিনের মতো যুদ্ধ থামানোর আদেশ দিয়ে গোপনে ক্লাইভকে আক্রমণের উপদেশ দেন। ফলে ছত্রভঙ্গ নবাবী সেনাদল আকস্মিক আক্রমণে দিশাহারা হয়ে পরে। সন্ধ্যা নামার মুখে পরাজয় নিশ্চিত বুঝে সিরাজ সিদ্ধান্ত নেন, যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে মুর্শিদাবাদ ফিরে যাবেন রাজধানী রক্ষার্থে। এদিকে মুর্শিদাবাদে নবাবের পরাজয়ের খবর এসে পৌঁছালে দলে দলে লোক সব সম্পদ আঁকড়ে রাজধানী ত্যাগ করতে শুরু করেন। সিরাজ পুনরায় সেনাদল গঠন করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। পরদিন সন্ধ্যায় সিরাজ, লুৎফুন্নেসা ও এক বিশ্বস্ত প্রহরী দীন দরিদ্রের ছদ্মবেশে রাজধানী ত্যাগ করেন। সম্ভবত সিরাজের উদ্দেশ্য ছিল জলপথে বিহারে গিয়ে সেখানকার শাসক এবং ফরাসিদের সাহায্যে রাজধানী পুনরুদ্ধার করা। গোপনীয়তা রক্ষার জন্য পাটনা যাওয়ার সুপরিচিত পথ ছেড়ে জলপথে মালদা ঘুরে রাজমহলে পৌঁছাতে চেয়েছিলেন নবাব। ওদিকে পলাশীর প্রান্তরে যুদ্ধের পরেরদিন সকালে ক্লাইভ মীরজাফরকে নির্দেশ দেন সিরাজকে বন্দী করে রাজকোষ অধিকার করতে। রাজধানীতে ফিরে মীরজাফর দেখলেন নবাব নেই, তন্নতন্ন করে চারিদিকে খোঁজ পড়লো। নবাবের বিশ্বস্ত সেনানায়ক মোহনলালকে নবাব বিরোধী সেনানায়ক রায়দুর্লভ হত্যা করলেন। রাজধানী শত্রুশূন্য হলেও সিরাজের খোঁজ না মেলায় মীরজাফর আর ক্লাইভ নিশ্চিন্ত হতে পারছিলেন না। ২৯ শে জুন ক্লাইভ মুর্শিদাবাদ পৌঁছে মীরজাফরকে নবাব পদে অভিষিক্ত করলেন।
ইতিমধ্যে সিরাজের নৌকা মালদায় জলঙ্গী নদী ও গঙ্গার মোহনার কাছে জলাভাবে আটকে গেলো। মনে করা হয় এইসময়ই সিরাজ ধরা পড়েন। কেউ বলেন নৌকা আটকে যাওয়ায় সিরাজ একটা মসজিদে খাদ্যের সন্ধানে যাওয়ায় সেখানে কেউ তাকে চিনে ফেলে সিরাজের সন্ধানে ব্যস্ত থাকা মীর দাউদ ও মীর কাশিমের কাছে খবর দিয়ে দেন, কেউ বলেন সিরাজ রাজমহল পৌঁছানোর পর দানশা নামে এক ফকির তাঁকে চিনিয়ে দেয়, আবার কারো মতে নৌকার মাঝি সিরাজের বেশভূষা দেখে চিনতে না পারলেও পায়ের দিকে তাকিয়ে রাজকীয় জুতো দেখে নবাবকে চিনে ফেলে তাঁকে ধরিয়ে দেয়।
এরপর কী হলো? ক্লাইভ বলে গেছেন, সিরাজকে নিয়ে কী করা হলো তিনি জানতেন না, মীরজাফর তাকে খবর দিয়েছিল সে সিরাজকে হত্যা করেছে। ৩ - ৪ জুলাই বন্দী ও নিগৃহীত সিরাজকে মুর্শিদাবাদে এনে হত্যা করা হয়েছিল। জাফরগঞ্জে মীরজাফরের ভবনে মীরজাফর পুত্র মীরনের তত্ত্বাবধানে সিরাজকে বন্দী করা হয়। এরপর নিজের হাতে সিরাজকে হত্যা করতে কেউই সম্মত হননা। রাজি হলেন কেবল আজন্ম সিরাজের দাদু আলিবর্দির আশ্রয়ে থাকা মহম্মদ বেগ। বন্দী অবস্থায় সিরাজ প্রাণ ভিক্ষা চান। মৃত্যু নিশ্চিত বুঝে শেষ বারের মতো নামাজ পাঠের অনুমতিও চান। কিন্তু তার কোনো আবেদনই শোনা হয়নি। খড়্গাঘাতে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন সিরাজের দেহ যখন আলীবর্দী খানের সমাধিস্থল খোশবাগের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন নাকি তাঁর দেহ কেবলই এক মাংসপিন্ড। সমাধি দেওয়ার আগে হাতির পিঠে তাঁর মৃতদেহ বিজয়োল্লাস করে ঘোরানো হয় সারা মুর্শিদাবাদ শহরে! মা আমিনা বেগম এ দৃশ্য দেখে রাজপথে লুটিয়ে পড়েন। সিরাজের এই হত্যার বিষয়ে তিনি কিছুই জানতেন না বলে ক্লাইভ বলে থাকলেও, তার অনুমতি ছাড়াই মীরজাফর এতো বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা মেনে নেওয়া কঠিন।
খোশবাগে সিরাজকে সমাধিস্থ করার পর বেগম লুৎফান্নেসা মীর জাফর ও মীরনের বিবাহ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁকে প্রথমে বন্দী করা হয়, তারপর তিনি ঢাকায় পালিয়ে যান। সাত বছর পর তিনি মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন, এবং খোশবাগেই থাকতে শুরু করেন। নবাব আলীবর্দী এবং সিরাজের সমাধিসৌধ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোম্পানি প্রতি মাসে তিনশত পঞ্চাশ টাকার অনুদান অনুমোদন করে। ১৭৯০ সালের নভেম্বর মাসে লুৎফুন্নেসার মৃত্যু হয়। খোশবাগে সিরাজউদ্দৌলার কবরের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
এবছর ফেব্রুয়ারি মাসে মুর্শিদাবাদ বেড়াতে গিয়েছিলাম। খোশবাগে দেখেছি সিরাজউদ্দৌলা, আলীবর্দি খান, লুৎফা, আমিনা বেগম, ঘসেটি বেগম সহ তাদের পরিবারের মোট ৩৪ সদস্যের কবর রয়েছে। খোশবাগে বাগান ও জামা মসজিদের অনুকরণে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন নবাব আলিবর্দি খান ১৭৪০ এ। এখানে ১০৮ রকমের গোলাপের চাষ হতো। খোশবাগের স্থানীয় গাইডরা সিরাজের ধরা পড়ার কারণ হিসেবে মাঝির চিনে ফেলার কাহিনীই শোনান। সেখানে রয়েছে সেই মাঝি ও তার স্ত্রী পুত্রের সমাধি। বলা হয় নবাবকে ধরিয়ে দেওয়ার উপহার চাইতে গেলে তাদেরকেও মেরে ফেলা হয়। এখানে এক জায়গায় একসাথে ১৭ জনের সমাধি রয়েছে, গাইডরা জানালেন জাফরগঞ্জ - এ মীরজাফরের বাড়িতে সিরাজ যখন বন্দী তখন খবর পেয়ে ১৭ জন কাছের দূরের আত্মীয় তাকে দেখতে যান, সেই সময় মীরজাফর পুত্র মীরন খাবারে বিষ মিশিয়ে তাদের হত্যা করে যাতে সিংহাসনের আর কোনো উত্তরাধিকার বেঁচে না থাকে। এই ১৭ জনের একজন বাদে কারো পরিচয়ও নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। এছাড়াও এখানে আছে সিরাজের শিশুকন্যার সমাধি, যাকে পাঁচ বছর বয়সে মীরন গঙ্গায় ছুঁড়ে হত্যা করে। আছে লুৎফার শেষ জীবনের ঘর। বলা হয় তিনি শেষ জীবনে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলেন। গাইড আরোও জানালেন এই সমাধিক্ষেত্রে থাকা ৩৪ টি সমাধির মাত্র ২ টি স্বাভাবিক মৃত্যু, আলবর্দি খান ও লুৎফা, বাকি সকলকেই হত্যা করা হয়েছে ব্রিটিশ বা মীরণের দ্বারা। মীরন তিন শতাধিক মানুষকে হত্যা করেছিল বলে মনে করা হয়। মীরন এতো কিছু করেও নবাব হতে পারেননি। ব্রিটিশদের সাথে একটি শিকারে গিয়ে তাকে বোমা মেরে হত্যা করা হয়, মীরজাফর কে জানানো হয় তার পুত্র বজ্রাঘাতে মারা গেছে, তার মৃতদেহও মুর্শিদাবাদ আনা হয়নি, বিহারেই তাকে সমাধি দেওয়া হয়।
তথ্যসূত্র :-
অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, সিরাজদ্দৌলা, ১৮৯৮ https://archive.org/details/dli.bengal.10689.20784/page/n13/mode/2up
সুশীল চৌধুরী, নবাবী আমলে মুর্শিদাবাদ, আনন্দ, ২০০৪
রেহান ফজল, নবাব সিরাজউদ্দৌলা: যার নির্মম হত্যার পর ভারতে ইংরেজদের একচ্ছত্র শাসন প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হয়, BBC News বাংলা,
https://www.bbc.com/bengali/articles/c9r3714x6dpo