কথাশিল্পী সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ৯৬তম জন্মদিন আজ।।
তাঁর জন্ম: ১৪ অক্টোবর ১৯৩০, মুর্শিদাবাদ জেলার খোশবাসপুর গ্রামে। মৃত্যু: ৪ সেপ্টেম্বর ২০১২, কলকাতায়।।
স্বাধীনতার পর থেকে গ্রামে-গ্রামে যে বিপুল ভাঙাগড়া ও রূপান্তর ঘটেছে, তার সাক্ষী সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের নিজের মনেই লেখক হিসেবে এক গুরুতর দায়িত্ব পালনের প্রশ্ন উঠেছিল। তিনি মনে করতেন, সাহিত্যের মূল উপজীব্য মানুষ। আর এ দেশে অধিকাংশ মানুষই বাস করেন গ্রামে। তাই এইসব গ্রামীণ মানুষের জীবনকে নাগরিক শিক্ষিত সমাজের মানুষের কাছে সাহিত্যের মাধ্যমে তুলে ধরার গভীর সংগ্রামকে নিজের জীবনের ব্রত করে তুলেছিলেন তিনি।
অনেক শিক্ষিত মানুষের কাছেই গ্রামজীবন নিয়ে সাহিত্য মানেই সেই শরৎচন্দ্র কিংবা তারাশঙ্কর আর বিভূতিভূষণ। এ নিয়ে আর নতুন কী লেখার আছে! এ বিষয়ে সিরাজের অত্যন্ত স্পষ্ট, চাঁছাছোলা অভিমত: ''অনেক আধুনিকতা-মন্য বুদ্ধিবাদী ভাবেন, গ্রাম্য বিষয়বস্তু মানেই অনাধুনিক ব্যাপার এবং গ্রামীণ চরিত্র মানেই সরলতা ও আদিমতার সমাহার‐‐ যা আধুনিক শিল্পের পরিপন্থী। এঁদের বিভ্রমকে করুণা করা যায়।...
মানুষের সরলতা আদিমতা সর্বকালে শহর ও গ্রামে সর্বত্রই লক্ষণীয়। আবার চারিত্রিক জটিলতাও তাই। গ্রামের মানুষ বা নিরক্ষর হলেই যে চরিত্রটি জটিল হবে না, এ কথা ভুল ও যুক্তিহীন। গেঁয়ো গাড়ল যেমন আছে, বিস্তর শহুরে গাড়লও আছ।''
('নির্বাসিত বৃক্ষে ফুটে আছি একা', সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। 'দেশ' পত্রিকা, ১৯৭৬।)
সিরাজ মনে করতেন: ''দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারটাই আসল। প্রকৃত আধুনিকতা থাকে লেখকের মনে। তাঁর চেতনায়‐- চোখে মগজে এবং হৃদয়েও।"
ব্যক্তিগত জীবনে সিরাজ ছিলেন কিছুটা নিভৃতচারী। দিনের অধিকাংশ সময়ই তাঁর কাটত শুধুমাত্র লেখা এবং পড়াশোনা নিয়ে। দেশ-বিদেশের সাহিত্য ছাড়াও ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান, ভাষাতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর ছিল গভীর পাণ্ডিত্য। এসব বিষয়ে পত্রপত্রিকায় চিঠি লিখতেও তিনি দ্বিধা বোধ করতেন না।
দেশ-বিদেশের বহু গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার ও অজস্র সম্মানে ভূষিত তাঁর মতো একজন কথাশিল্পী বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত অন্যদের লেখা অত্যন্ত মনোযোগ-সহকারে পড়তেন এবং সে বিষয়ে তাঁর ভিন্নমত থাকলে বা কোনও ভুল-ত্রুটি চোখে পড়লে তা লিখে জানাতেন। এমনকী, কখনও কখনও এসব বিষয়ে বিতর্কেও জড়িয়েছেন, শুধুমাত্র তথ্যের খাতিরেই।
কিন্তু নিজের সাহিত্যসৃষ্টি সম্পর্কে তিনি ছিলেন আশ্চর্য বিনীত এবং কিছুটা উদাসীনও। বস্তুত নিজের সাহিত্য সম্পর্কে উচ্চকিত হওয়াটা বরাবরই ছিল তাঁর পরিশীলিত রুচির বাইরে। আসলে তিনি মনে করতেন, কালের বিচারেই সাহিত্যের প্রকৃত মূল্যায়ন ঘটে।
তবে সাহিত্যসাধক সিরাজ নিজেই হয়ে উঠেছিলেন কালের কণ্ঠস্বর। আর তাই সিরাজের মৃত্যুর পর দেশের প্রথম শ্রেণির একটি ইংরেজি দৈনিক 'দ্য হিন্দু'-তে সংবাদে লেখা হয়েছিল: 'Bharat has lost its voice. A voice that answered to the name of Syed Mustafa Siraj fell silent as the veteran Bengali writer passed away after a brief illness in Kolkata.' (The Hindu, 5 September 2012)।
মুষ্টিমেয় বিত্তবানের অর্থের দ্যুতিতে উজ্জ্বল 'ইন্ডিয়া' নয়, ৭৬ শতাংশ দরিদ্র মানুষের যে দেশ 'ভারত', সেই দরিদ্র ভারতের কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়েছে সিরাজের সাহিত্যে।