About Us | Contact Us |

গাছের কথা

লিখেছেন : কামিল এস-স্কি
গাছের কথা

স্তেফানো মান্‌কুসো আর আলেস্‌সান্দ্রা ভিয়োলার ,"সবুঝ সবুজ: উদ্ভিদদের বোধ ও বুদ্ধির বিস্ময়কর ইতিহাস আর বিজ্ঞান” বই থেকে, ফ্লরেন্স ২০১৩ 
(from Stefano Mancuso and Alessandra Viola’s book „Brilliant Green: The Surprising History and Science of Plant Intelligence”, Florence 2013)

গাছপালার কথা ভাবতে গিয়ে আমরা আমাদের অভ্যাসের জোরে তাদেরকে দুটো গুণ থেকে বঞ্চিত করে দেখি; আমরা মনে করি যে তারা চলন আর অনুভব করতে অক্ষম। আবার এই দুটো গুণ আমরা খুব উঁচু দরে মানি বলে তার অভাব আমাদের বিচারে ভারি দুর্বলতার লক্ষণ। তবুও সাধারণ বিচারের উজানে উদ্ভিদবৃন্দ চলনে এবং অনুভবে মোটেই অক্ষম নয়। আদতে এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের চিন্তার সাথে জুড়ে গেছে প্রাচীন গ্রীসে আরিস্তোতেলেসের দ্বারা প্রবর্তিত শতকে শতকে চর্চিত বদ্ধমূল সাংস্কৃতিক কাঠামোতেই। আরিস্তোতেলেস দর্শনদারি পণ্ডিত হলেও তিনি মনে করতেন যে গাছপালাদের আত্মা [psyche] সর্বনিম্ন মানের। আত্মায় তিনি জীবন আর যাবতীয় গতির চালিকা শক্তি দেখতেন, সচল মানে সজীব আর অচল মানে নির্জীব – যেমন পাথর। গাছপালা সাধারণত একি জায়গায় শেকড় গেঁড়ে থাকে বলে, আরিস্তোতেলেস এবং তার অনুগামীগণ তাকে সজীব আর নির্জীব বস্তুদের মাঝামাঝি স্তরে রেখেছেন। 
উদ্ভিদ আর জন্তুর এই কোঠর ভেদাভেদে ফাটল ধরল উনিশ শতকের শেষে, তবে তার প্রভাব গণমানসে এখনো দেখা যায়। মাত্র ইদানিংকালে বিজ্ঞানী-মহল একমতে স্বীকার করেছেন যে উদ্ভিদ আর জন্তুদের মধ্যে কোন গুণগত তফাৎ নেই, তফাৎটি পরিমাণগত। জন্তুরা উদ্ভিদদের তৈরি করা খাদ্য আর শক্তির সম্ভার ভোগ করে বাঁচে। অপরপক্ষে উদ্ভিদরা তাদের চাহিদা মেটাবার জন্য সূর্যর শক্তি ব্যবহার করে। জন্তুজানোয়ার গাছাপালার উপর নির্ভর করে, আর গাছপালারা সূর্যর উপর।
এই প্রেক্ষিতে জীব-সমূহের মধ্যে উদ্ভিদ-রাজ্যর ভূমিকা পুনর্বিচার করা হয়েছে: গাছাপালা হল জন্তু-জানোয়ার আর সূর্যশক্তির মাধ্যম, অর্থাৎ উদ্ভিদের কোষের অঙ্গাণু – হরিৎ কণিকা [ক্লোরোপ্লাস্ট] – জীবজগৎ আর আমাদের সৌরমণ্ডলের কেন্দ্রীয় শক্তির সঙ্গে মিলন ঘটায়। জন্তুজানোয়ারের তুলনায় গাছপালা অপরিহার্য – তারা না থাকলে আমাদের গ্রহে জীবন সম্ভব হত না।
সর্বাধুনিক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় পরিলক্ষিত হয়েছে যে উদ্ভিদরা অনুভব করা (অতএব তাদের ইন্দ্রিয় আছে), যোগাযোগ করা (নিজেদের মধ্যে আর জন্তুদের সাথে), স্মরণে রাখা, ঘুমানো, এমনকি অন্য প্রজাতির উপর প্রভাব খাটানোর ক্ষমতা রাখে। নিঃসন্দেহেই তাদের বুদ্ধিমান বলা চলে: তাদের মূল-শেকড়রের জাল সেনাবাহিনীর মতো অবিরাম এগিয়ে চলে এবং তাদের দিগ্বিজয় লক্ষ লক্ষ মূলকেন্দ্র দিয়ে পরিচালিত। কাজেই এই মূল-তন্ত্র উদ্ভিদের পরিচালনা করে যেন সমষ্টিগত মস্তিষ্ক বা দিকে-দিকে ছড়ানো বুদ্ধিমত্তা, যা বৃদ্ধি-প্রসারের সময় বেঁচে থাকার জন্য অতি দরকারি খবর সংগ্রহ করে, যেমন খাবারের ঠিকানা। 
গত কয়েক দশকের আবিষ্কারের নিরিখে অবাক লাগে না শুনে যে সুইজ-দেশের  ECNH (অ-মানব প্রাণীর জন্য নৈতিক সমিতি (Ethics Committee on Non-Human Biotechnology, ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত) ২০০৮ সালের শেষে ঘোষিত করেছে নতুন নীতিমালা „উদ্ভিদদের প্রাণ-মর্যাদা। উদ্ভিদদের স্বগুণ ভিত্তিক নৈতিক বিচার”, যার মতে গাছপালারা অন্যান্য প্রাণীদের মতো সম্মানযোগ্য।
গাছপালার ক্ষেত্রে সম্মানের কথা তোলা অনেক সাহসী ধাপ মনে হতে পারে, কিন্তু নিশ্চয়তার সাথে বলা যায় যে এটা প্রথম আইনি উদ্যোগ যেখানে উদ্ভিদদের আইনি অবস্থান মানুষের লাভ-লোকসান হিসাবের বাইরে বিবেচনা করা হয়েছে। প্রাণ-মর্যাদার তাৎপর্য হল যে উদ্ভিদদের প্রতি আমাদের সম্মান রাখা উচিত এবং তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্যও আছে। আমরা যদি মনে করি যে গাছপালা নিছক সহজ সবুজ নিষ্ক্রিয় যন্ত্র যা চক্কর মতো খালি একি কাজ করতে থাকে অথবা আমাদের চাহিদা মেটাবার চাকর, তাহলে „মর্যাদা”-র কথা সত্যি হুজুকের মতো শোনায়। আবার যদি আমরা গাছপালা জটিল সবুঝ সক্রিয় প্রাণী হিসেবে দেখি যারা অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা রাখে, যাদের স্বতন্ত্র বেঁচে থাকার অধিকার আছে, তাহলে মর্যাদার প্রসঙ্গ আনার কারণ আছে বৈকি।
জগদীশ চন্দ্র বসু (১৮৫৮-১৯৩৭), অন্যতম প্রথম ভারতীয় আধুনিক বৈজ্ঞানিক এবং ভারতবর্ষর ইতিহাসের কিংবদন্তী বিশ শতকের সূচনায় লিখেছিলেন: „গাছপালা আমাদের মতো জীবিত। তারা খাবার খেয়ে বড় হয়, অভাব-দারিদ্র্যর সাথে লড়ে, সুখ পায় এবং কষ্টও পায়। তারা চুরিও করে, আবার একের অপরকে সাহায্যও করে, দরকার মতো বন্ধুত্ব পাততে পারে আবার আপনার সন্তান বাঁচাবার জন্য আত্মত্যাগ করতেও পারে”। বসুর মতে জন্তু-জানোয়ার আর গাছপালার মধ্যে সেরকম ফারাক নেই।
অনেক বিষয় চিন্তায় ফেলতে পারে, অনেক বিষয় আরও পরীক্ষা করে তলিয়ে দেখা দরকার। তবুও জৈবপ্রযুক্তির নীতি বিষয়ক সমিতির সদস্যবৃন্দ (নীতিবিদ, আণবিক জীববিজ্ঞানী, প্রকৃতি বিজ্ঞানী আর পরিবেশ বিজ্ঞানীরা) একটি বিষয়ে একমত হতে পেরেছেন: উদ্ভিদদের অবজ্ঞার সাথে বিচার করতে নেই। গাছপালাদের যাচ্ছেতাই উচ্ছৃঙ্খল বিনাশ নৈতিক ভাবে ক্ষমার অযোগ্য। 
গাছপালার আইনের মানে নয়, যে তাদের ব্যবহার কমানো বা একেবারে বন্ধ করা উচিত! যেমন জন্তুজানোয়ারের প্রাণ-মর্যাদা মানে নয় যে আমাদের খাদ্যশৃঙ্খল থেকে আমরা তাদের পরিহার করেছি অথবা তাদের উপর কোন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা আর করতে পারি না।
যুগে যুগে জন্তুজানোয়ার বুদ্ধিহীন স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র মনে করা হত। মাত্র কয়েক দশক হল আমরা তাদের মর্যাদাপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করলাম। আজকাল তারা আর জিনিশপত্র নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় সমস্ত আধুনিক রাষ্ট্রে অভিনব আইন প্রবর্তন করার দাবি তুলেছে যাদের মতে জন্তুজানোয়ারের প্রাণ-মর্যাদা রাষ্ট্র-সমাজের সুরক্ষার বিষয় হয়ে দাঁড়াল। গাছপালা তেমন কিছু পায়নি। তাদের আইন-অধিকার বিষয়ে আলোচনা এখনও খুবই কাঁচা, তবে তাকে পাকানোর জন্য আমাদের আর দেরি করা উচিত নয়।  

ক ল্প ত রু

একবার চেষ্টা করো নিজের গা’কে গাছের মতো দেখতে - কল্পনায় বা অনুভবে
তার পদমূলে কত রগরগিনী নাচে প্রত্যেক স্পন্দনে
দু’পার মাঝে বুনো ফুলের উৎসব আর গুল্মভরা গুফায়
জঙ্গলি জানোয়ারের বাস

কিংবা কীটকীটাণু গিজগিজ করছে পুষ্টি ঘিরে
মৌমাছিরা মাংসের চাক পাকায় আর গাছের অন্তরঙ্গ পিঁপড়ে-শ্রমিক
গড়ে তোলে কাঠকঠিন কঙ্কাল স্থাপত্য

সূর্যগামী হাতগুলির আঙুলপত্র বিচরণ
বাতাসে ভাসছে আর বুড়ো হয়ে খসখস করবে

শীর্ষাসনে বাসা বানায় পাখিরা
যা পায় কুড়িয়ে তা দিয়ে বোনে চিন্তাজাল
তার উপর চুলের ঝর্ণা বটজটা

আর এত প্রাণ জোগাতে ঘুরে ধায় অবিরাম
শিরোপশিরার শাখাপ্রশাখা
গাছের ভেতর আর একটি গাছ
নূরের মোহনা
……………………………………………

এবার পঙ্গু গাছও হয় ভাঙাডাল শুকনো মূল
দুর্বল গাছও শক্ত হতে পারে
তবে যে গাছকে দিনদিন বিষয়ে দেওয়া হয়
অথবা করে ফেলে উদ্বাস্তু, দলিত, সর্বহারা, নিহত
সে গাছের কপাল স্রেফ তক্তা-বাঁধা পেরেক-মারা আরামের আসবাব
তাদের জন্যে যাদের মনের জঙ্গল নিপাত হল কুঠারধারালো লোভে

 

কামিল এস-স্কি
কামিল এস-স্কি

লেখক ও অনুবাদক,পোল্যান্ড।