About Us | Contact Us |

কট্টরপন্থার ছায়ায় জাভেদ আখতার ও বানু মুশতাক বিতর্ক

লিখেছেন : রুবাইয়া জুঁই
কট্টরপন্থার ছায়ায় জাভেদ আখতার ও বানু মুশতাক বিতর্ক


যে শহর কবিতার মশাল হাতে যুগে যুগে আঁধার ভেদ করেছে, যে কলকাতা বিদ্যাসাগরের বর্ণমালায়,  নজরুলের বিদ্রোহের কণ্ঠে, রবীন্দ্রনাথের মানবতার বাণীতে ভর করে দাঁড়িয়েছে ---- যে শহর একসঙ্গে রাজপথে নামে রাত দখলে, ঢাকের তালে, আজানের সুরে ভাসে একসাথে।  আজ সেই শহরের বুকেই কট্টরপন্থার হিংস্র ছায়া নেমে এলো। উর্দু অ্যাকাডেমির
 মঞ্চে এক হওয়ার কথা ছিল শিল্প, সাহিত্য আর সংলাপের। কিন্তু তার আগেই দাউ দাউ করে উঠল ধর্মান্ধতার বিষদাঁত। জাভেদ আখতারের মতো এক প্রবীণ কবি, গীতিকার তথা সাহিত্যিককে ঘিরে হঠাৎই উঠল আপত্তির ঝড়। আপত্তি এতটাই প্রবল যে “অনিবার্য কারণে স্থগিত” করতে হলো আয়োজন। অথচ আমরা জানি এ কোনো “অনিবার্য কারণ” নয়, এ হলো ভয়, এ হলো অসহিষ্ণুতার কাছে মাথা নোয়ানো। যে শহর হাজার রকম ভাষা, সংস্কৃতি, চিন্তাকে বুকে টেনে নিয়েছে, সেখানে আজ এক কবির কণ্ঠ থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। এ লজ্জা শুধু উর্দু
অ্যাকাডেমির নয়, শুধু জাভেদ আখতারের নয়, এ আমাদের সবার। কট্টরপন্থীরা ভুলে যায় কবিতাকে বন্দি করা যায় না, কণ্ঠরোধ করে চুপ করানোও যায় না। যতই তারা হুমকি দিক, ভয় দেখাক, ততই সাহিত্যের আলো আরও জোরে ছড়িয়ে পড়বে। আর আজকের এই অন্যায়ের প্রতিবাদে যদি আমরা কলম না ধরি, তবে কাল হয়তো আমাদেরই কণ্ঠরোধ করে দেবে তারা। 

 ৩১ অগাস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলার কথা ছিল পশ্চিমবঙ্গ উর্দু অ্যাকাডেমির এই সাহিত্য সভা। আর ১ সেপ্টেম্বর মঞ্চে বসার কথা ছিল জাভেদ আখতারের। যিনি নিজেকে নাস্তিক বলে পরিচয় দেন। ফলে তাঁর উপস্থিতিকেই ভয় পেল কিছু কট্টর গোষ্ঠী। জমিয়ত উলেমা-ই-হিন্দ ও ওয়াহায়িঁ ফাউন্ডেশন হুমকি দিল, নাস্তিককে ঢুকতে দেওয়া হবে না কলকাতায়। কবি যদি নাস্তিক হন, তবে তাঁর শব্দও যেন অশুচি। প্রশাসনও কট্টরপন্থীদের হুঙ্কারে ভয়ে পিছিয়ে গেল, অনুষ্ঠান বাতিল হলো। অথচ তারা ভুলে গেল - ---ভারত হিন্দুরাষ্ট্র নয়, মুসলিম দেশও নয়; এখানে বিশ্বাসী যেমন জায়গা পান, অবিশ্বাসীও তেমনি।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে - যদি এক কবির কণ্ঠই সহ্য না হয়, তবে কেমন করে আমরা নিজেদের সভ্যতা দাবি করব? মৌলবাদ বারবার দেওয়াল তোলে, কিন্তু ইতিহাস জানায় দেওয়ালের ওপারেই নতুন ভোর, নতুন কবিতা।

তবে কট্টরপন্থীরা শুধু কলকাতায় নেই,তাদের বিষদৃষ্টি গোটা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে। কারণ আরও একটি ঘটনা সামনে এসেছে। ৩১ অগাস্ট কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া আন্তর্জাতিক বুকারজয়ী লেখিকা বানু মুশতাককে এই বছরের মাইসুরুর 'দশেরা' উদ্বোধনের জন্য আমন্ত্রণ জানান। ২২ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে ২ অক্টোবর বিজয়া দশমীতে শেষ হবে এই ‘নাদা হাব্বা’, যা যুগ যুগ ধরে ধর্ম, জাতি ও সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে উঠে সাংস্কৃতিক মিলনের প্রতীক হয়ে আছে। কিন্তু উৎসবের শঙ্খধ্বনির মাঝেই আরএসএস ও বিজেপির বিদ্বেষের ঢোল বেজে উঠল। তারা প্রশ্ন তুলল--একজন মুসলিম নারী লেখিকা কেন উদ্বোধন করবেন! যেন 'দশেরা' কেবল একটি ধর্মের সম্পত্তি, আর বাকি সকলের উপস্থিতি অপরাধ। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, হায়দার আলি, টিপু সুলতান থেকে দিওয়ান মির্জা ইসমাইল পর্যন্ত বহু শাসকের আমলে এই উৎসব ছিল সকল সম্প্রদায়ের।

বানু মুশতাকের লেখা কন্নড় ভাষায়, তাঁর সাহিত্য মানুষের হৃদয়ের ভাষা। তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো মানে কন্নড় সাহিত্যের প্রতি সম্মান, মানুষের বহুত্বের প্রতি শ্রদ্ধা। কিন্তু আরএসএস ভয় পায় এই মিলনকে, এই বহুত্বকে। তারা চায় বিভেদের বিষ ছড়িয়ে দিতে। ফলে মুখ্য অতিথি হিসেবে বানু মুশতাককে আমন্ত্রণ জানানোকে কেন্দ্র করে শুরু হলো হুলস্থুল কাণ্ড। কংগ্রেসশাসিত রাজ্যে বিজেপি ঘোষণা করল যে, কংগ্রেস ‘হিন্দুবিরোধী’। উপমুখ্যমন্ত্রী ডি শিবকুমার এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শোভা করন্দলাজে মুখোমুখি হয়েছেন বাগ্‌যুদ্ধে। কেন্দ্রবিন্দুতে লেখিকা ও সমাজকর্মী বানু মুস্তাক। যাঁকে দশেরা উৎসবের মঞ্চে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। শিবকুমার স্পষ্ট জানালেন, মন্দির কেবল এক সম্প্রদায়ের সম্পত্তি নয়, যেমন মসজিদ বা গির্জাও কেবল ধর্মের খাঁচায় আটকে নেই। ধর্ম যদি বিভাজনের দেওয়াল না হয়ে মিলনের সেতু হয়, তবে সংখ্যালঘু প্রতিনিধি মন্দিরে পা রাখতেই পারেন। কিন্তু এই কথাই যেন বিষবাষ্প হয়ে উঠল বিজেপির চোখে। শোভা করন্দলাজে ঘোষণা করলেন “মন্দির কোনও ধর্মনিরপেক্ষ স্থান নয়, এটি হিন্দুদের পবিত্র প্রতিষ্ঠান।” তাঁর অভিযোগ, বানুকে আমন্ত্রণ জানানো আসলে হিন্দুদের ভাবাবেগে আঘাত।

অন্য প্রান্তে শিবকুমারের জোরালো জবাব “চামুণ্ডী পাহাড় ও দেবী চামুণ্ডেশ্বরী সমগ্র সমাজের, কেবল হিন্দুদের নয়। দশেরা সকলের উৎসব।” তবে এক্ষেত্রে আশার কথা এটাই যে, মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া জানালেন, সরকার কোনও ভুল করেনি এবং তিনি তাঁর সিন্ধান্তে অবিচল।

রুবাইয়া জুঁই
রুবাইয়া জুঁই

লেখিকা