ভারতের গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ হল স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং স্বচ্ছ নির্বাচন প্রক্রিয়া। নির্বাচন কমিশন অফ ইন্ডিয়া (ECI) এই দায়িত্ব পালন করে, কিন্তু সাম্প্রতিককালে, বিশেষ করে বিহারে চলমান Special Intensive Revision (SIR) প্রক্রিয়া নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক উঠেছে। এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ২৫ জুন ২০২৫ থেকে, যার লক্ষ্য ভোটার তালিকা পরিশোধন করা এবং নতুন ভোটার যোগ করা। কিন্তু অপোজিশন দলগুলি, যেমন কংগ্রেস, আরজেডি, এআইএমআইএম এবং অন্যান্যরা, এটিকে "ভোট চুরি" (vote theft) হিসেবে অভিহিত করেছে, দাবি করে যে এটি লক্ষ লক্ষ ভোটারকে বাদ দেওয়ার একটি ষড়যন্ত্র। সুপ্রিম কোর্টও এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে, ECI-কে ৬৫ লক্ষ বাদ দেওয়া ভোটারের বিস্তারিত তালিকা প্রকাশ করার নির্দেশ দিয়েছে। এই নিবন্ধে আমরা প্রদত্ত ১০টি প্রশ্নের ভিত্তিতে বিস্তারিত আলোচনা করব, যাতে ECI-এর অফিসিয়াল স্ট্যান্ড, অপোজিশনের অভিযোগ, মিডিয়া রিপোর্ট এবং X (পূর্বতন টুইটার) থেকে সংগৃহীত মতামত অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে সকল পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হবে, যাতে পাঠকরা নিরপেক্ষভাবে বিষয়টি বুঝতে পারেন। এই বিষয়ে যোগেন্দ্র যাদব যে, দশটি প্রশ্ন তুলেছেন তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় -
১. রাজনৈতিক দলের পরামর্শ কেন নেওয়া হল না?
ECI-এর নিয়মাবলী অনুসারে, SIR-এর মতো বড়সড় পরিশোধন প্রক্রিয়া শুরু করার আগে সকল সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পরামর্শ করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু বিহারে এই প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগে কোনও দলকে আহ্বান করা হয়নি। অপোজিশন নেতা যেমন জয়রাম রমেশ এবং পাওয়ান খেরা X-এ পোস্ট করে দাবি করেছেন যে এটি একটি "দিয়াবোলিকাল মুভ" (দুর্নীতিপূর্ণ চাল) যা লক্ষ লক্ষ ভোটারকে বাদ দেওয়ার উদ্দেশ্যে। ECI-এর পক্ষ থেকে চিফ ইলেকশন কমিশনার গ্যানেশ কুমার প্রেস কনফারেন্সে বলেছেন যে প্রক্রিয়াটি আইনসম্মত এবং স্বচ্ছ, এবং রাজনৈতিক দলগুলিকে ভুল তথ্য ছড়ানোর জন্য অভিযুক্ত করেছেন। তবে দ্য হিন্দু এবং বিবিসির রিপোর্ট অনুসারে, এই অভাব স্বচ্ছতার প্রশ্ন তুলেছে, যা আসন্ন বিহার বিধানসভা নির্বাচন (অক্টোবর-নভেম্বর ২০২৫)-এ প্রভাব ফেলতে পারে।
২. বিহারের নির্বাচনী বছরে গাইডলাইন ভঙ্গ
ECI-এর নির্দেশিকা স্পষ্টভাবে বলে যে, যে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন সামনে, সেখানে SIR করা উচিত নয়। তবু বিহারে এটি চালানো হয়েছে। অপোজিশনের অভিযোগ, এটি NDA-কে সুবিধা দেওয়ার জন্য। অসাদুদ্দিন ওয়াইসি ECI-কে চিঠি লিখে বলেছেন যে এটি "আইনগতভাবে সন্দেহজনক" এবং গণতান্ত্রিক অধিকার লঙ্ঘন করে। ECI-এর রিপোর্ট অনুসারে, SIR-এর ফলে ৯৯.৮% কভারেজ অর্জিত হয়েছে, যাতে ২২ লক্ষ মৃত, ৭ লক্ষ ডুপ্লিকেট এবং ৩৬ লক্ষ স্থানান্তরিত ভোটার বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে সুপ্রিম কোর্টের ইন্টারিম অর্ডারে ECI-কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে বাদ দেওয়া ভোটারদের নোটিশ দিয়ে সুযোগ দিতে হবে।
৩. বন্যার মধ্যে নোটিশ ছাড়াই সিদ্ধান্ত
বিহারের অনেক জেলায় ভয়াবহ বন্যার সময় SIR ঘোষণা করা হয়েছে, যা অভিযোগ উঠিয়েছে যে এটি তাড়াহুড়ো। রাহুল গান্ধী এবং তেজস্বী যাদব দাবি করেছেন যে এটি অসংখ্য ভোটারকে প্রভাবিত করবে, বিশেষ করে দরিদ্র এবং মাইগ্রান্টদের। ECI-এর পক্ষে বলা হয়েছে যে এটি একটি রুটিন প্রক্রিয়া, এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। বিবিসির রিপোর্টে উল্লেখ আছে যে ড্রাফট রোলে মৃত ব্যক্তির নাম এবং ভুল ছবি রয়েছে, যা প্রক্রিয়ার ত্রুটি দেখায়।
৪. নতুন ভোটার সংযোজনের সংখ্যা
২৫ জুন থেকে ২৫ জুলাইয়ের মধ্যে কত নতুন ভোটার যোগ হয়েছে, ECI তা প্রকাশ করেনি। এটি সন্দেহ বাড়িয়েছে। X-এ পোস্ট অনুসারে, ৬৫ লক্ষ ভোটার বাদ দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে ৩৪% মৃত, ৫৫% স্থানান্তরিত।ECI-এর প্রেস কনফারেন্সে বলা হয়েছে যে এটি স্বচ্ছ, এবং অপোজিশনকে অ্যাফিডেভিট দিয়ে প্রমাণ দিতে বলা হয়েছে।
৫. নথি ছাড়া জমা ফর্ম
অনেক ফর্ম নথি ছাড়াই জমা হয়েছে, যা আইন লঙ্ঘন। প্রশান্ত ভূষণ X-এ বলেছেন যে এটি অসাংবিধানিক, যেমন NRC-এর মতো। ECI-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে যে ৭.২৩ কোটি ফর্ম ডিজিটাইজড হয়েছে।
৬. BLO-র ‘Not Recommended’ ফর্ম
BLO-রা অনেক ফর্মে ‘Not Recommended’ লিখেছেন, কিন্তু ভিত্তি স্পষ্ট নয়। কপিল সিব্বাল সুপ্রিম কোর্টে বলেছেন যে "মৃতরা জীবিত দেখানো হচ্ছে" ECI-এর দাবি, এটি দ্য প্রত্যেক ক্ষেত্রে নোটিশ দেওয়া হয়।
৭. বিদেশী ভোটার খোঁজার নাম করে বিভ্রান্তি
ECI দাবি করেছে বিদেশী ভোটার পাওয়া গেছে, কিন্তু সংখ্যা প্রকাশ করেনি। অপোজিশন এটিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বলে। টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় উল্লেখ আছে যে নেপালি, বাংলাদেশী ভোটার নিয়ে অভিযোগ।
৮. রাহুল গান্ধীর প্রেস কনফারেন্সের পর ফর্ম্যাট বদল
রাহুল গান্ধীর সমালোচনার পর ফর্ম্যাট বদলানো হয়েছে, যা ECI-এর স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ করে। X-এ পোস্টে বলা হয়েছে যে এটি "ভোট চুরি"। ECI-এর রেসপন্স: অভিযোগ ভিত্তিহীন।
৯. অনুরাগ ঠাকুরের কাছ থেকে হলফনামা চাওয়া হয়নি
অনুরাগ ঠাকুরের কাছে হলফনামা না চাওয়া, কিন্তু অপোজিশনের কাছে চাওয়া, পক্ষপাতিত্ব দেখায়। পিয়ূষ গোয়েল অভিযোগকে "বেসলেস" বলেছেন।
১০. সমাজবাদী পার্টির অভিযোগে তদন্ত ঝুলে আছে
সমাজবাদী পার্টির অভিযোগের তদন্ত না হওয়া ECI-এর নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ করে। সুপ্রিম কোর্ট ২২ আগস্ট ২০২৫-এ কমপ্লায়েন্স রিপোর্ট চেয়েছে।
পরিশেষে বলা যায়, এই ১০টি প্রশ্ন প্রমাণ করে যে ECI-এর SIR প্রক্রিয়া গণতান্ত্রিক মানদণ্ড থেকে সরে যাচ্ছে। ECI-এর ২০২৪ KAP সার্ভে অনুসারে, রোলগুলি ইতিমধ্যে "নিয়ার পারফেক্ট" ছিল, তবু SIR চালানো হয়েছে। অপোজিশনের অভিযোগ যে এটি একটি "ভোটবন্দি" (votebandi), যখন ECI এটিকে পরিশোধন বলে। জরুরি ভিত্তিতে ECI-কে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে, স্বচ্ছতা বজায় রাখতে হবে এবং গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করতে হবে। অন্যথায়, ভারতের গণতন্ত্রের আস্থা ক্ষুণ্ণ হবে।