ধরুন, আপনি একটা কারখানায় কাজ করেন। রোজগেরে খাটুনির চেয়ে মজুরি অনেকটাই কম। মালিকপক্ষকে মজুরি বাড়ানোর কথা অনেকদিন ধরে বলছেন, নানা দপ্তরে চিঠি-চাপাটিও করেছেন। হালকা গুতানি খেয়ে মালিকপক্ষ মজুরি বাড়ানোর জন্য একটি আলোচনা সভা ডাকলো। তাতে মজুরি বাড়ানোর দেখনদারিতে খাটুনির পরিমাণ আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেল। তখন আপনি কী করবেন? আপনার মনের ভেতরে রাগ হবে না? এই ধরনের অন্যায়, জুলুমবাজির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আগুন জেগে উঠবে না? হাতের সামনে যা পাবেন তাই ছুঁড়ে মারতে ইচ্ছে করবে না?
অথবা ধরুন, আপনি গ্রামের একজন ক্ষেতমজুর, ভূমিহীন কৃষক। এককালে আপনার হাতে চাষের জমি ছিল, যা বর্তমানে শাসকদলের নেতা, নব্য জমিদার বা জোতদাররা দখল করেছে। এখন আপনি সেই জমিতে মজুরি খাটেন, দখলদার নব্য জমিদারের মালিকানায়। খাটুনির ন্যূনতম ভাগ পান না। এমন পরিস্থিতিতে ধুঁকতে ধুঁকতে আপনার মনে একদিন প্রতিবাদের আগুন জ্বলে উঠবে না? আপনার ইচ্ছে করবে না সেই জমি লুঠেরা, ডাকাতবাহিনীকে মারতে? গ্রাম থেকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করতে?
কিংবা, ধরুন, আপনি সদ্য বিয়ে করে স্বামীর বাড়ি উঠেছেন। দেখাশোনা করে বিয়ে হয়েছে, আগে জানতেন না স্বামী রোজ রাতে মদ গিলে বাড়ি ফেরে। বিয়ের পর তা জানলেন, তাই নিয়ে স্বামীকে বারণ করলেন। স্বামী আপনার কথা শুনে মদ্যপান ছাড়ার বা কমানোর বদলে আপনার মুখ বন্ধ করানোয় মনোনিবেশ করলো। মাতাল স্বামীর হাত ওঠানো চালু হল। প্রথমে হাত দিয়ে মারতে থাকলো, পরে বেল্ট খুলে মারলো। তখন আপনি কী করবেন? নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন না? হাতের সামনে যা কিছু পাবেন তাই দিয়ে স্বামীর মাথার উপরে পাল্টা আঘাত করবেন না?
এসব বাদ দিন। বলুন, যে মন্ত্রীরা, নেতারা আপনাদের টাকা, চাকরি চুরি করেছে। একটা সময় পর তাঁদেরকে মারতে ইচ্ছে করেনি? যে মন্ত্রী, নেতারা দেশের জল-জঙ্গল-জমি-ইজ্জত সমেত সমগ্র সম্পত্তি বিদেশি পুঁজিপতিদের কিলো দরে বেচে দিচ্ছে তাঁদেরকে বেধড়ক মারতে মন চায় না? যে বা যাঁরা ধর্ষণ করেছেন এবং সেই ধর্ষণের স্বপক্ষে যে যে মন্ত্রী, নেতারা যুক্তি সাজিয়ে চলেছেন, তাঁদেরকে আপনার মারতে মন চায় না? যে নেতা ও মন্ত্রীরা নিম্নবর্ণ, আদিবাসী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপরের নানা ধরনের অত্যাচার চালিয়ে নিজেদের আখের গোছায়, সমাজে শোষণ, অশান্তি, বিশৃঙ্খলতা, দাঙ্গাকে রাজনৈতিক পুঁজি বানিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখে। তাঁদেরকে গাছে ঝুলিয়ে মারার কথা কখনও মনে আসে না?
শ্রেণিসমাজে এসবই স্বাভাবিক বিষয়, দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, অত্যাচার থেকে জন্মানো রাগ, ক্ষোভ থেকে পাল্টা মারের বিদ্রোহী স্পৃহা জাগাটা অস্বাভাবিক নয়, শোষিত ও নিপীড়িত জনগণ দীর্ঘদিনের অনুশীলনের দ্বারা তা আত্মস্থ করেছে। শোষিত ও নিপীড়িত জনগণের অসীম সহ্যক্ষমতা। সহ্যের বাঁধ ভেঙে গেলে, তাঁরা মারমুখী হয়ে ওঠেন। এই নিয়ে পুরোনো সময় থেকে একটি প্রবাদ বাক্য চালু আছে; 'কামারের টুকটাক কুমোরের এক ঘা'। কামার হলেন লোহার মত শক্তপোক্ত, প্রতিদিন আঘাত করেন। আর কুমোর হলেন মাটি মত নরম প্রকৃতির, একদম শেষ সময় আত্মরক্ষার স্বার্থে পাল্টা ঘা বা আঘাত দিয়ে থাকেন।নিপীড়িত জনগণ হল তাই। বেঁচে থাকবার জন্য জনগণের মার প্রথমে শুরু হয় সব থেকে নরম প্রকৃতির অধারালো অস্ত্র, জুতো দিয়ে। পুরোনো সময় থেকে নিপীড়িত জনগণের সাথে জুতোর সম্পর্ক অমলিন, ভূমিষ্ঠ হওয়া সদ্যজাত শিশুর সাথে মায়ের সম্পর্ক যেমন থাকে তার সাথে অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মা যেমন শিশুকে আগলে রাখেন, নিপীড়িত জনগণও জুতোকে আগলে রাখেন। একজন মা প্রতিবাদের প্রাথমিক হাতিয়ার বা অস্ত্র হিসেবে, তাঁর শিশুকে ভাবেন, পড়াশোনা শেখান, সমাজে সকলের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড় করাবার জন্য। এটাই সাধারণত মায়েদের প্রতিবাদের প্রাথমিক ধরণ। নিপীড়িত জনগণও আত্মরক্ষার প্রাথমিক অস্ত্র হিসেবে জুতোকে বাছাই করে রেখেছেন, পুরোনো সময় থেকে। তাই যে কোন রাগে, ক্ষোভে নিপীড়িতের মুখ থেকে শোনাই যায় - 'জুতিয়ে মুখ লাল করে দেব', 'জুতো মেরে মুখ ভেঙে দেব' ইত্যাদি আরও নানা ধরনের বিদ্রোহী বাক্য। এ ধরনের নানা কথা শুনলে শোষক বা ক্ষমতাবানেরা ভয় পান, এই বর্ণ ভিত্তিক শ্রেণি-সমাজে এঁদের নিচু জাতি বা নিচু শ্রেণি প্রভৃতি বলে সম্বোধন করেন, তাঁদেরকে সমাজে একঘরে করে দেওয়ার অঙ্ক কষেন। কারণ, শোষক ও নিপীড়কেরা সবসময় ভাবাতে চায় - তাঁদের শোষণ ও অত্যাচার করা ন্যায়সঙ্গত এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ করা এ সমাজে সব থেকে বড় অন্যায় হিসেবে গণ্য। সেই অনুযায়ী আধুনিক রাষ্ট্র কাঠামো তৈরি হয়েছে, নিত্যনতুন আইন এসেছে, প্রধানত, নিপীড়িত জনগণ যাতে নিপীড়কের হাতের নাগালের বাইরে না যেতে পারে। শোষক ও নিপীড়কের অত্যাচার বজায় রাখবার জন্য আইনতভাবে লাঠি, বন্দুক, বোম ইত্যাদি অনেক ধরনের উন্নতমানের প্রাণঘাতী অস্ত্রশস্ত্র ও সশস্ত্র বাহিনী মজুত রাখা আছে। বিপরীতে, শোষিত ও নিপীড়িতেরা দীর্ঘদিনের আত্মরক্ষার অনুশীলনের দ্বারা জুতোকে নিজেদের সব থেকে কাছের নরম, অধারালো অস্ত্র হিসেবে পরিণত করেছে।
কেবল এখন নয়, এখানে নয়। বিশ্বের নানা দেশেও শোষক ও অত্যাচারীদের মারতে জুতোর ব্যবহার হয়েছে। যেমন, ২০০৮ সালে ইরাক তথা মধ্যপ্রাচ্য ধ্বংসের নায়ক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে এক সাংবাদিক জুতো ছুঁড়ে মেরেছিলেন। ঔপনিবেশিক আমলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ব্রিটিশদের সরাসরি আঘাত করতে পারেননি। ১৮৮২ সালে 'নীলদর্পণ' নাটকটিতে চাষীদের উপর ব্রিটিশের অত্যাচার দেখে, ব্রিটিশ সাহেবের চরিত্রে অভিনয় করা এক ভারতীয়কে জুতো ছোঁড়েন। অত্যাচারীকে জুতো ছুঁড়ে মারা হল অহিংস্র-বিদ্রোহের লক্ষণ। সাধারণত বিনা রক্তপাতে মনের রাগ, ক্ষোভ অনেকখানি কমানো যায়। পাশাপাশি অত্যাচারীকে ইঙ্গিতও দেওয়া যায় যে, 'অনেক হল এবারে সহ্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে, অত্যাচার না কমলে নিপীড়িতের বিদ্রোহ সহিংস হয়ে উঠতে পারে'।
এদেশে ক্ষমতাবান-অত্যাচারীদের দিকে জুতো ছুঁড়ে মারা নিপীড়িতের এক প্রকারের বিদ্রোহী সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এমন নানা উদাহরণ ইতিহাসে দেখা যায়। আসলে এর মধ্য থেকে নিপীড়িত শ্রেণির বিদ্রোহের দর্শন উত্থাপিত হয়, জুতো উৎপাদক নিম্নবর্ণ বা আদিবাসী বা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিদ্রোহের ধ্বনি আকাশে, বাতাসে সংক্রমিত হয়। তবে বিগত কয়েক বছরে তা, দেশের বেশির ভাগ অংশ জুড়ে হয়নি। কিন্তু সমাজে জুতো ছোঁড়ার জায়গা বা কর্তার শূণ্যস্থান ফাঁকা থাকেনি। সাম্প্রতিককালে তার প্রমাণ যথেচ্ছভাবে মিলেছে, সুপ্রিমকোর্টের দ্বিতীয় নিম্নবর্ণ-বিচারপতিকে জুতো ছোঁড়ার শ্লোগানের মধ্য দিয়ে, 'সনাতন ধর্ম কা অপমান, নেহি সহেগা হিন্দুস্তান'। জুতো যিনি ছুঁড়েছেন তাঁর দাবি অনুযায়ী তিনিও একজন নিম্নবর্ণ। অথচ, জুতো ছোঁড়ার পর তিনি যে শ্লোগান দিয়েছেন তা উচ্চবর্ণ-ব্রাহ্মণ, তাঁদের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, আর.এস.এস ও সংঘ পরিবারের কথা সকলকে মনে করিয়ে দিয়েছে। আরও গভীরভাবে ভাবলে মনে পরে যায় - আর.এস.এস ও সংঘ পরিবারের মেন্টর বা দীক্ষাগুরু সাভারকর ও গোলওয়ালকারের কথা। প্রথমজন ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশের জুতো চেটে দ্বিজাতি তত্ত্ব বানিয়ে দেখিয়েছিলেন, কেন হিন্দুরাই কেবল ভারতীয়(১৯২৩)। দ্বিতীয়জন কংগ্রেস আমলে গান্ধী হত্যার পর নিষিদ্ধতা আটকানোর কৌশলে কংগ্রেসের জুতো চাটবার নিদান দিয়ে জহর লাল নেহেরুকে চিঠি লিখেছিলেন, একসাথে হাত মিলিয়ে দেশের প্রধান শত্রু মুসলমান ও কমিউনিস্টদের জব্দ করবার।
সুপ্রিমকোর্টের নিম্নবর্ণ-বিচারপতিকে যিনি জুতো ছুঁড়েছিলেন তাঁর দেওয়া শ্লোগানটি আর.এস.এস ও সংঘ পরিবারের মেন্টর সাভারকর, গোলওয়ালকরদের দর্শনের সাথে মিলে যায়। জুতো ছুঁড়ে মারার পর তিনি বলেছেন, 'সব কিছুই ঈশ্বর করিয়েছে', এটিও মিলে যায় আজকের বিশ্বে ফ্যাসিবাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুরু নরেন্দ্র মোদির নন-বায়োলজিক্যাল বক্তব্যের সাথে। যদিও একথার দর্শন-তত্ত্ব আবিষ্কারক, জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ নীৎশে। যিনি বলেছেন, ঈশ্বর আজ মৃত, তাঁকে বাঁচানোর দায়িত্ব শক্তিশালীদের কাঁধে তুলে দেওয়ার বা নেওয়ার কথা। জার্মান, ইতালি হয়ে ভারত - ফ্যাসিবাদের সেঁকেলে জনক থেকে এঁকেলে জনক, প্রত্যেকেই নিজেদেরকে ঈশ্বরপুত্র বা ঈশ্বরের সমতুল্য হিসেবে তুলে ধরেছেন, একটি জাতি বা ধর্মকে রক্ষা করতেই তাঁরা পৃথিবীতে এসেছেন, একথাগুলোই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেছেন। এবং যখন যেখানেই যারা শোষক ও অত্যাচারী তাদের পক্ষ নিয়েছেন। এই যেমন, নিম্নবর্ণ-বিচারপতিকে জুতো ছোঁড়া আইনজীবীর দর্শনের ধারক ও বাহক যে সংগঠন, যে সংঘ, সেই আর.এস.এস ও সংঘ পরিবার প্রথম থেকে অত্যাচারী ব্রিটিশ, ইহুদী গণহত্যাকারী নাৎসি পার্টি ও ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির পার্টির পক্ষে থেকেছে। তখন এ নিয়ে বহু লেখালেখি করেছে। এখন এরাই আবার মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আগ্রাসনে মার্কিনীদের পক্ষে, ফিলিস্তিনের জমিতে জায়নবাদী-ইজারেলের দখলদারিত্বের সঙ্গী। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া, চিনের বন্ধু শক্তি। অর্থাৎ, অত্যাচারী, ক্ষমতাবান ও ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে যাওয়া এদের চলার রাজনৈতিক পথের নীতির বাইরে। এরা রাজনৈতিক থেকে সাংগঠনিক - সব দিক থেকে নিজেরাই ফ্যাসিবাদী। নিপীড়িতের অস্ত্র নিপীড়িতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা এদের ফ্যাসিবাদের পথে চলবার রাজনৈতিক কৌশলের অংশ। তাই নিপীড়িতের ফ্যাসিবাদী ও ক্ষমতাবানদের দিকে জুতো ছোঁড়া সাময়িকভাবে বন্ধ হওয়ার সাথেসাথে সেই জায়গাতে এরা দখল বসিয়েছে। ঠিক একইভাবে যে সব আদিবাসী অঞ্চলে সশস্ত্র যুদ্ধ বন্ধ করবার নামে মাওবাদীদের অস্ত্র ছাড়ার কথা বলা হচ্ছে, সেইখানে নিপীড়িতেরা অস্ত্র ছাড়লে যুদ্ধ বন্ধ হবে না। উল্টে, রাষ্ট্রীয় লাইসেন্স-প্রাপ্ত সেনাবাহিনীর পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জোরে বিনা লাইসেন্সে আর.এস.এস ও সংঘ পরিবারের মতাদর্শগত সশস্ত্র শাখাগুলো গড়ে উঠবে, যাঁরা জল-জঙ্গল-জমির লুঠ তীব্রতর রাখবে, ওইসব অঞ্চলে সাধারণ প্রতিবাদ গড়ে উঠবার গোড়ায় বাধা দেবে। এটা ফ্যাসিবাদের সাধারণ রাজনৈতিক-পন্থা, এ পথ অবলম্বন করে ফ্যাসিবাদীরা গোটা দেশজুড়ে একচেটিয়া রাজত্ব কায়েম করতে চায়। ফলে, ফ্যাসিবাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিনা অস্ত্রে বেঁচে থাকা জীবনের সব থেকে বড় কঠিন কাজ হয়ে উঠে। এমন কঠিন সময় নরম প্রকৃতির অধারালো অস্ত্র, জুতো কাজে আসে, জুতো মারার সুযোগ ছেড়ে দেওয়া যায় না। এটা যাঁরা করে বা করতে উদ্যত হয়ে উঠে তাঁরা কখনও সজ্ঞানে আবার কখনও অজ্ঞানে ফ্যাসিবাদের পক্ষে অবস্থান নেয়, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ফ্যাসিবাদের উত্থানে সহায়কের ভূমিকা নিয়ে ফেলে। অন্ততঃপক্ষে বিগত কয়েক বছরে ফ্যাসিবাদীদের জুতো ছোঁড়ার ইতিহাস তারই জানান দেয়।
দেশের এমন দুর্দান্ত বিপদের সময় যে সকল কেতাবি বাম বুদ্ধিজীবী, প্রগতিশীলেরা এসব ঘটনাকে সংবিধানের গন্ডিতে বাঁধতে চায়, তাঁরা আদতে ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইকে খাটো করে দিচ্ছে, লড়াকু জনগণের লড়াইয়ের পরিসর সংকুচিত করছে। সংবিধান যে দেশের জনগণের অধীনে, দেশের বৈচিত্র্য, ইতিহাস, আত্মসম্মানের অধীনস্থ, তা তাঁরা নিজেরা ভুলে যেতে বসেছে, ফ্যাসিবাদের আতঙ্কে। সেই আতঙ্ক নাগরিক সমাজের অনেকের কাছে গুলিয়ে দেয় যে, আগে দেশ পরে সংবিধান, দেশের মাটির বাস্তবিক অবস্থার গতি অনুযায়ী সংবিধানের সংস্কার ঘটে, সংবিধান বদলে দেওয়ার অধিকার আছে, এমন সব সত্যনিষ্ঠ বাস্তবিক বিষয়গুলোকে। এত বছর ধরে যে সংবিধান জনগণের প্রয়োজন মত রুটির যোগান দিতে পারেনি, থাকবার জায়গা, চিকিৎসা, শিক্ষা সুনিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে, সেই সংবিধানের নানা সংস্কার ঘটিয়েই ধাপে ধাপে ফ্যাসিবাদ জাঁকিয়ে বসে, জনগণের ভেতরে নিজেদের ভিত্তি মজুবত করছে। আজ যাঁরা এদেশের ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদের দর্শনের দ্বারা নিম্নবর্ণ-বিচারপতিকে আক্রমণের ঘটনাকে সংবিধানের আয়ত্তে আনতে চায়, তাঁরা আসলে হিমালয়ের ধ্যান করা শান্ত সাধুতে পরিণত হয়েছে, যাঁদের সাথে নিমিত্ত মাত্র জনগণের সম্পর্ক নেই। বরং, এঁরা এসব করবার মধ্য দিয়ে সামগ্রিকভাবে ফ্যাসিবাদ বিরোধী উত্তাল বিদ্রোহ আটকিয়ে রাখবার পথ পরিষ্কার করছেন, সংবিধান যে কথা বলে। তাঁরা খেয়াল রাখবার বাস্তবিক অবস্থায় নেই যে, নজর দেবে, সংবিধানের কার্যাবলীর রূপান্তর ঘটিয়ে বা সংস্কার করে ফ্যাসিবাদীরা সাধারণ জনগণের ভেতরে মতাদর্শগত ভিত্তি পাকাপোক্ত করছে। যার ফলস্বরূপ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী-পন্থা('লো ইনটেনসিটি কনফ্লিক্ট') অবলম্বন করে নিম্নবর্ণ, দলিতেরা আজ নিম্নবর্ণ, দলিতদের মারছেন, আদিবাসীরা আজ আদিবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছেন, ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদের শ্লোগান তুলে। এটাই আর.এস.এস ও সংঘ পরিবারের ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু রাষ্ট্রের কর্মপদ্ধতি, যেখানে উচ্চবর্ণ-ব্রাহ্মণ্যবাদের জাতি হিংস্রতার দাম্ভিক মতাদর্শ মাথায় করে বয়ে নিয়ে যাবেন নিম্নবর্ণেরা, তাঁরা নিজেদের জীবনপাত করবেন, জীবনের আত্মাহুতি দেবেন। এটাই ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু রাষ্ট্রের দিকে পৌঁছানোর যাত্রাপথের শেষ সময় ও অন্তিম ফলাফল। যেখানে নিম্নবর্ণের প্রাণ নিম্নবর্ণ নেবে, আদিবাসীর প্রাণ আদিবাসী নেবে এবং আদিবাসী ও নিম্নবর্ণ একত্রিত হয়ে দেশের অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্ম, জাতি ও কমিউনিস্টদের প্রাণ নেবে, উচ্চবর্ণ-ব্রাহ্মণ্যবাদের দর্শনের হিংস্র গেরুয়া ঝান্ডা উর্দ্ধে তুলে। নিম্নবর্ণ-বিচারপতিকে নিপীড়িতের নরম, অধারালো অস্ত্র জুতো দিয়ে আক্রমণ, ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বের শ্লোগান তুলে আবারও সেই ইঙ্গিত দিয়েছে। বলা বাহুল্য, এই ধরনের নরম প্রকৃতির অধারালো অস্ত্রের দ্বারা আক্রমণের মাধ্যমে তাঁকে ও তাঁর আম্বেদকর-পন্থী পরিবারকে 'শুধরে যাওয়ার' বার্তা দেওয়া হয়েছে, একটা সময় পর তা না হলে গৌরি লঙ্কেশ, দাভোলকার প্রমুখের মত অবস্থাও হতে পারে, এমন ভাবনা আজকের দুঃসময় সকলের মাথায় ঘুরতে বাধ্য। এর মাধ্যমে ফ্যাসিবাদীরা, নিম্নবর্ণ-দলিতদের বড় অংশের বিদ্রোহী মনোভাবকে ভয় দেখিয়ে দমিয়ে রাখতে চাইছে, ঠিক যেমনভাবে উমর খালিদদের বিনা বিচারে বছরের পর বছর বন্দি করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছাত্রযুবদের আওয়াজ, প্রতিবাদ, বিদ্রোহকে বন্দুকের নলের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। এই ধরনের পদ্ধতি মাওবাদী রাজনৈতিক মতাদর্শে সমর্থনকারীদের(পড়ুন, নেতা বা কর্মী নয়, কেবল সমর্থক।) ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হচ্ছে। শোষিত ও নিপীড়িতকে ভয় পাওয়ানো শোষক ও ফ্যাসিবাদ-পন্থীদের নৈতিক রাজনীতি, তারা চায় ভয়ের সমাজ কায়েম করার মধ্য দিয়ে গোটা দেশজুড়ে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটাতে।
এমন ধরনের ভয় পাওয়ানোর প্রয়াস বিগত কয়েক বছরে জুতো ছোঁড়ার মধ্য দিয়েও চলছে। বছর চারেক আগে, নাগপুরের এক সভায় যখন কানহাইয়া কুমারকে জুতো ছোঁড়া হয়েছিল, তখন তাঁর বিরুদ্ধে কানহাইয়া কুমারের তেমন কোন প্রতিবাদ ছিল না যা সমাজের চোখে দাগ কাটতে পারে, ভয়ের বিপরীতে সাহসের বার্তা বয়ে আনে। এবারে নিম্নবর্ণ-বিচারপতিকে জুতো ছোঁড়ার পরও সেই একই ভঙ্গি দেখা গেলো সর্বত্র দিক থেকে। ফলে অভিযুক্তেরা বুক বাজিয়ে তাদের বর্ণ-বিদ্বেষপূর্ণ, জাতি হিংস্রতার প্রচার ও প্রসার করে চলেছেন, প্রথমে জুতো ছুঁড়ে, পরে ঢিল মেরে, ঢিলের পরে প্রাণঘাতী বুলেট মারার আওয়াজ দিচ্ছেন। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী রেখা গুপ্ত এক সর্বভারতীয় ব্রাহ্মণ সম্মেলনে বলছেন, 'সমাজে ব্রাহ্মণরাই জ্ঞানের শিখা প্রজ্জ্বলন করেন। ব্রাহ্মণরা কেবল ধর্মগ্রন্থ নয়, অস্ত্রেরও পুজো করেন। এই অস্ত্র ও ধর্মগ্রন্থের মাধ্যমে আমরা দেশ ও সমাজকে রক্ষা করতে পারি।' তাহলে এই ধর্মগ্রন্থ পাঠ করা ব্রাহ্মণদের হয়ে অস্ত্র চালাবেন কারা? এ সমাজের নিম্নবর্ণ, দলিত ও আদিবাসীরা, যাঁরা দীর্ঘদিনের বিদ্রোহী অনুশীলন মারফত এগুলোকে রপ্ত করেছেন। আর.এস.এস ও সংঘ পরিবার তাঁদের নিশানা, ছোঁড়ার দিক, লক্ষ্য, মতাদর্শের পরিবর্তন ঘটিয়ে চলেছে।
ইতিহাসে 'জুতো মেরে থোতা মুখ ভোঁতা' করে দেওয়ার শিক্ষা শোষিত ও নিপীড়িতেরা দিয়েছেন। জুতোকে কখনও দেখা গেছে, কারখানায় সংখ্যালঘু, নিম্নবর্ণ-শ্রমিকদের বিদ্রোহী অস্ত্র হিসেবে। আবার তা কখনও দেখা গেছে, গ্রামের সংখ্যালঘু নিম্নবর্ণ-ভূমিহীন, ক্ষেতমজুরদের হাতে, আবার কখনও তা হয়ে উঠেছে অত্যাচারিত মেয়ে, বউ'য়ের বেঁচে থাকবার স্বর- আত্মরক্ষার নরম প্রকৃতির অধারালো অস্ত্র হিসেবে। যদি এই জুতো ছ'বছর আগে বাবরী মসজিদ ভাঙা ও রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার রায় দেওয়া, কাল্পনিক ব্যাখ্যাকারী বিচারপতির দিকে পড়ত তাহলে হয়ত আজকের দিনে নিম্নবর্ণ-বিচারপতির সত্যনিষ্ঠ, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাকে এসমাজ ধারণ করবার জায়গায় থাকতো এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদী মতাদর্শে বিশ্বাসী দলিত আইনজীবীও জুতো ছোঁড়ার আগে অনেকবার ভাবতো। অথবা, জুতো ছোঁড়ার পরে স্বতস্ফূর্ততার সাথে জুতো হাতে নিয়ে বিদ্রোহীরা রাস্তায় নামতো যা ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদীদের ভেতরে ভয় ও সামগ্রিক সাধারণ জনগণের ভেতরে সাহসী চেতনার সংক্রমণ ঘটাতে পারতো। তখন আলোচনাটা হত ভিন্ন, এখনের মত একগুঁয়ে, সাংবিধানিক কান্নাকাটি মার্কা প্যাচপ্যাচে নয়। কিন্তু, সেই সব হয়নি, যা হল তা জুতো ছোঁড়ার ইতিহাসকে সকলের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে, ভবিষ্যতে জুতো ছোঁড়ার অধিকার শোষিত ও নিপীড়িতের থাকবে না কি ফ্যাসিবাদীরা তা পুরোপুরি দখল করবে, সে সব প্রশ্ন তুলে আনছে। আবারও যদি জুতো ছোঁড়ার সম্পূর্ণ অধিকার শোষিত ও নিপীড়িতেরা পুনঃদখলে নেয় তাহলে এই বাংলায় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মত বর্ণবিদ্বেষী, ব্রাহ্মণ্যবাদী সাহিত্যিকদের সাক্ষাৎকার ছাপা বন্ধ করতে বাজারি মিডিয়ারা বাধ্য হবে। ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদের শ্লোগানের বিপরীতে আকাশে পাখির মত মুক্তির শ্লোগান উড়বে, বাতাসে প্রতিধ্বনিত হতে পারে - জুতো(অস্ত্র) ধরা হাত, ব্রাহ্মণ্যবাদকে(ফ্যাসিবাদকে) করবে কুপোকাত।