About Us | Contact Us |

বাঙালি মুসলমানদের জাতীয় উৎসব "ঈদ মিলাদুন্নবী"

লিখেছেন : ওয়াহেদ মির্জা
বাঙালি মুসলমানদের জাতীয় উৎসব

বিশ্বজুড়ে বাঙালি জাতির মধ্যে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরাই সংখ্যাগুরু৷আরবের পরে, বাঙালিরা ভাষা ও জাতিগত দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম সম্প্রদায়। বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ,বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সা: জন্মোৎসব আজ কোন একটি ধর্ম ,জাতি ,বর্ণের  মধ্যে আটকে নেই ৷ তেমনি বাঙালি সংস্কৃতিতে " বিশ্ব নবী দিবস " বলে আনন্দ ও উৎসবের এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে৷এখানে বলে রাখি,ধর্মসত্তার সঙ্গে জাতিসত্তার কোন বিরোধ হয় না৷ সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মের মিলন ঘটায়  হলো সাহিত্য৷ সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় পরিচয় বহন করে সাহিত্যে৷ তা দেখতে পাই বৌদ্ধ কবি রামাই পণ্ডিত( ১০০০ থেকে ১০২০ খ্রিস্টাব্দের) মধ্যেই  রচিত "কলিমা জাল্লাল" নামক রচনায় পহেলা রাসূল করীম (সা.)এর তারিফ করা হয়েছে। এবং ১৩শ শতাব্দীতে 'শূন্য পুরাণ' রচনায়  'নিরঞ্জনের রুস্মা' নামক কবিতায় প্রথমবার মহানবী (সা.)-এর উল্লেখ পাওয়া যায় ৷ এছাড়া বাংলা ভাষায় মহানবীর জীবনীর প্রথম ও উল্লেখযোগ্য সিরাত চর্চা শুরু হয় মধ্যযুগে,যেখানে ১৫ শতকের কবি জৈনুদ্দীন (রহ.)-এর সিরাত চর্চা থেকে এর সূচনা হয়েছিল বলে জানা যায়। ১৮৮৮ সালে শেখ আবদুর রহিম কর্তৃক রচিত " হজরত মুহম্মদ (স.) জীবনচরিত ও ধর্মনীতি "গ্রন্থটিকে বাঙালি মুসলমান কর্তৃক রচিত হযরত মুহাম্মদের উপর প্রথম জীবনীর গ্রন্থ বলা হয়৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে "মহাঋষি" ও "ইসলামের মহান নবী" হিসেবে উল্লেখ করে তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছেন  যা ১৯৩৩ সালের ২৬ নভেম্বর নবী দিবস উপলক্ষে বোম্বের আনজুমানে আহমদিয়ার প্রতি পাঠানো একটি বাণীতে দেখা যায়৷ দিল্লীর জামে মসজিদ থেকে প্রকাশিত The Peshwa পত্রিকার নবী সংখ্যার জন্য ১৯৩৬ সালের২৭ ফেব্রুয়ারী শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রনাথের একটি বাণী পাঠিয়েছিলেন। হযরত মোহাম্মদের জন্মদিন উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ বাণী পাঠিয়েছিলেন স্যার আব্দুল্লাহ সোহরাওয়ার্দিকে। ১৯৩৪ সালের ২৫জুন অই বাণীটি হযরত মোহম্মদের জন্মদিনে আকাশবাণীতে প্রচারিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—
"ইসলাম পৃথিবীর মহত্তম ধর্মের মধ্যে একটি। এই কারণে উহার অনুবর্তিগণের দায়িত্ব অসীম, যেহেতু আপন জীবনে এই ধর্মের মহত্ত্ব সম্বন্ধে তাহাদিগকে সাক্ষ্য দিতে হইবে। ভারতে যে-সকল বিভিন্ন ধর্মসমাজ আছে তাহাদের পরস্পরের প্রতি সভ্য জাতিযোগ্য মনোভাব যদি উদ্ভাবিত করিতে হয় তবে কেবলমাত্র রাষ্ট্রীক স্বার্থবুদ্ধি দ্বারা ইহা সম্ভবপর হইবে না। তবে আমাদিগকে নির্ভর করিতে হইবে সেই অনুপ্রেরণার প্রতি, যাহা ঈশ্বরের প্রিয় পাত্র ও মানবের বন্ধু সত্যদূতদিগের অমর জীবন হইতে চির উৎসারিত। অদ্যকার এই পূর্ণ অনুষ্ঠান উপলক্ষে মস্লেম ভ্রাতাদের সহিত একযোগে ইসলামের মহাঋষির উদ্দেশ্য আমার ভক্তি-উপহার অর্পন করিয়া ঊৎপীড়িত ভারতবর্ষের জন্য তাঁহার আশীর্বাদ ও সাত্ত্বনা কামনা করি।"
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানবদের মধ্যে আখ্যায়িত করেছিলেন। মানবতার মুক্তিদূত ,সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ,আখেরি নবী,সর্বশেষ রাসূল হযরত মুহাম্মদ সা. জন্ম ও ওফাত দিবস আরবী চন্দ্র মাস রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সোমবার ৷ তিনি মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন মক্কার কোরেশ বংশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে(আনুমানিক ৫৭০ খ্রিস্টাব্দ)এবং মদিনায় ইন্তেকাল করেন (৮ জুন ৬৩২ খ্রিস্টাব্দ)৷রবিউল আউয়াল হল আরবের বসন্তের প্রথম মাস৷রবি অর্থ বসন্ত আর আউয়াল মানে প্রথম৷ বাঙালি মুসলমান সমাজে দিনটি " ফাতিহায়ে দোয়াজদাহুম " নামে আগে বহুল পরিচিত ছিল৷কাজী নজরুল ইসলাম "ফাতেহা-ই-দোয়াজ্‌-দহম্‌" বা "ফাতেহা-ই-দোয়াজ্‌দাহম" নামে একটি কবিতা লিখেছেন, যা রাসুল (সাঃ)-এর শানে লেখা৷দোয়াজদাহুম ফারসি শব্দ ,যার অর্থ ১২ অর্থাৎ ১২ তারিখের ফাতিহা অনুষ্ঠান৷ পরে এই দিন " মিলাদুন্নবী (সা:) নামে প্রসিদ্ধ হয় ৷ এর অর্থ নবী সা  এর জন্মোৎসব৷ পরবর্তী সময়ে এর সঙ্গে " ঈদ " শব্দ যোগ হয়ে " ঈদ মিলাদুন্নবী" ও বলা হয়,অর্থাৎ মহানবী সা. এর জন্মোৎসব৷ এই সময় আরেকটি পরিভাষাও প্রচলিত হয়েছে,তা হল " সিরাতুন্নবী সা:" অর্থাৎ নবী সা. এর জীবন ও কর্মের আলোচনা৷মাহে রবিউল আউয়াল মাসে
এই  দিন ভারতে জাতীয় ছুটি থাকে৷বাঙালি মুসলমানদের কাছে এই  মাস অত্যন্ত বরকতময় ও ফজিলতপূর্ণ ৷সুফি বাংলায় সুফিয়ানা তরিকা ও সংস্কৃতির মাধ্যমে মহম্মদীয় দর্শন ফুটে উঠেছে একেশ্বরবাদী ধর্ম ভাবনায়৷ বাংলার মাটিতে একেশ্বরবাদী আন্দোলন সুফির সঙ্গে একাত্ম হয়ে গড়ে উঠেছে বাঙালির  বাঙালিত্ব৷পবিত্র মিলাদুন্নবীর ইতিহাস অতি প্রাচীন ৷মিলাদুন্নবীর সূচনা করেছেন স্বয়ং আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন । নবী (সা.) মক্কায় যে ঘরে ভূমিষ্ট হয়েছিলেন, সেই ঘরটির জিয়ারত ও সেখানে দু’আ করার প্রথা সর্ব প্রথম  আব্বাসীয় খলিফাদের যুগে বাদশা হারুনুর রশীদের মাতা খায়জুরান বিবি (১৭৩ হিজরী)  চালু করেন।পরবর্তী কালে ১২ রবিউল আওয়ালে ঐ নারীর নেতৃত্বে র্তীথযাত্রীগণ প্রতি বছর নবী (সা.) এর জন্ম দিবস ধরে নিয়ে ঐ ঘরে আনন্দোৎসব পালন করেন। বাংলায়  সেই 1600 খ্রীষ্টাব্দ থেকে বাঙালি  উৎসব - পর্ব উদযাপনের লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায়৷সুফি বাংলায় এই রকম উৎসব পালন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি  লিখিত ইতিহাস হওয়ার আগেও ছিল ধরা যায়৷কিন্তু লিখত ইতিহাসে কমপক্ষে 400 বছরের পুরনো ঐতিহ্য ,বাহারীস্থানে গায়াবীতে ,যা মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের অধীনস্থ মীর্জা নাথান কেবল বাঙলা এবং তার আশেপাশের তৎকালীন ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন৷ফতেহা দোয়াজদাহাম  উদযাপনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য তো বেশ পুরোনো বাংলায়৷ বাংলার নবাবী  আমলে মুর্শিদাবাদের সুলতানরাও এই দিবস কেন্দ্র করে বেশ ধুমধাম উৎসবের আয়োজন করতেন৷স্মৃতিকথায় মিলাদুন্নবী,ঐতিহাসিক কে,পি সেন তাঁর বাংলার ইতিহাস(।নবাবী আমল) কিতাবে লিখেছেন :" নবাব সেই দিনটি একটি বিরাট উৎসব আনন্দের দিনে পরিনত করতেন৷ তিনি রবিউল আউয়াল মাসে প্রথম বারো দিন লোকদের আদর অভ‍্যর্থনা করতেন এবং ব‍্যক্তিগতভাবে আথিথেয়তায় উপস্থিত হতেন৷ বিশেষ করে তিনি গরীবদেরকে অভ‍্যর্থনা করতে ভালোবাসতেন ৷ এই উপলক্ষে সমস্ত মুর্শিদাবাদ শহর ভাগিরথী নদীর তীর পর্যন্ত আলোকময় সজ্জিত করে রাখতেন ৷ আলোকসজ্জার স্থানগুলোতে কুরআন শরীফের আয়াত সমূহ এবং মসজিদ,বৃক্ষ,লতাপাতা ও ফলসমূহ প্রদর্শিত হতো৷ সেনাপতি নাজির আহমেদ অধীনে এক লক্ষ লোক আলোকসজ্জার কাজে নিয়োজিত হতো৷ একটি নির্দিষ্ট সময়ে কামান গর্জন করত৷ বুঝতে পারছেন আজ থেকে 300 বছর আগে সার্বজনীন ভাবে মিলাদুন্নবী উদযাপন করা হতো৷উৎসবের ঢাকা গ্ৰন্থে জনাব সাদ উর রহমান তথ্য দিচ্ছেন " 1790 সালের দিকে আরমানিটোলা তারা মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা মির্জা গোলাম পিরের পিতামহ আবু সাঈদ প্রতিবছর ঈদে মিলাদুন্নবী উৎসবে নিজ ব‍্যয়ে তবারক হিসেবে পোলাও বিতরণ করতেন"৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্ৰন্থাগার বিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা মুহম্মদ সিদ্দিক খান - মুনতাসীর মামুন ও সাদ উর রহমানের বহুত আগেই -1966 সালে লিখেছেন " ফাতেহা -ই- দোয়াজ দাহাম উপলক্ষে চক মসজিদের আশেপাশে চারদিক আলোকময় সাজানো হতো ৷ মসজিদে পড়ানো হতো " মিলাদ শরীফ"৷ এই মিলাদও পড়া হতো সমবেত কন্ঠে৷ সৈয়দ মুজতবা আলীর বড় ভাই গবেষক ও ঐতিহাসিক সৈয়দ মুর্তজা আলী( 1920-1981)  যখন সিলেট গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে পড়তেন তখন তাঁর স্কুলে আড়ম্বরে সঙ্গে মিলাদ উৎসব হতো৷( আমাদের কালের কথা ,পৃষ্ঠা 91)
কুষ্টিয়া হাই স্কূলে হযরত মুহাম্মাদের জন্মোৎসব পালনের সময় প্রধান অতিথি ছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায় ,তিন তখন কুষ্টিয়ার মুহাকুমা হাকিম  ছিলেন৷( আমার এই ছোট ভুবন ,আবুল হোসেন, পৃষ্ঠা 88)
মিলাদ হতো স্কুলে ৷ নবী দিবস উপলক্ষে হযরতের জীবনের উপর রচনা প্রতিযোগিতা হতো ৷ ( আমি সরদার বলছি ,পৃষ্ঠা - 120)
কলকাতা রেডিওতে ফাতেহা দোয়াজ দহমের উপর এক জীবন্তিকা প্রচারিত হত ৷ হযরতের জন্মবৃত্তান্ত ,কোরেশের অত‍্যাচার ,ওহোদের রযুদ্ধ ইত্যাদি নানা ঘটনা  শুধু কথা ,বক্তৃতা এবং গানের মাধ্যমে রূপায়িত করা হবে ৷ স্ক্রিপট ওপর  মাওলানা আকরম খাঁ  তাঁর সই করার পর এইধরনের জীবন্তিকা দেখে মহাখুশি ছিলেন নৃপেন মজুমদার ৷
অমিতাভ চৌধুরীর লেখা থেকে জানা যায়, ফতেহা দোয়াজ দহম উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,"কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আসো।" মূলত সূফী ভাবধারায় রচিত এই সঙ্গীত শান্তিনিকেতনে নবীদিবস উপলক্ষে গাওয়া হতো। রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর ভাবনায় ও ব্যক্তিজীবনে সুফিবাদের প্রভাব লক্ষ্য করার মতো।1947 সালের পূর্বে রচিত তৎকালীন বাঙালি সমাজে   কবি ও প্রাবন্ধিক নবী দিবস নিয়ে বিভিন্ন কবিতা ও প্রবন্ধ লিখেছেন তার মধ্যে  চিন্তাবিদ ,প্রাবন্ধিক  এস . ওয়াজেদ আলি  লিখেছেন তার কিছু অংশ উদ্ধৃতি হিসেবে তুলে ধরছি " সেদিন ( 12 রবিউল আউয়াল) আমি এক নবী দিবসের উৎসবে সভাপতিত্ব ক‍রতে গিয়েছিলাম৷ হিন্দু ,মুসলিম উভয় ধর্মের লোকই এসেছিলেন উৎসবে যোগ দিতে আর বক্তৃতা শুনতে ৷ হজরত মোহাম্মদের জন্মতিথির অনুষ্ঠান৷ সুতরাং ধর্ম জাতি নির্বিশেষে সকলেই তাতে অংশ নিয়ে বিশ্ববরেণ্য মহাপুরুষের প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চেয়েছিলেন৷"
অধ্যাপক আলী আহমদ লিখেছেন"কোন জাতিকে প্রকৃষ্টরূপে জানিতে হইলে সেই জাতির গ্ৰন্থরাজিই সুন্দর উপাদান ৷গ্ৰন্থপঞ্জী হইল জাতির দরপন - স্বরুপ ৷1850 থেকে 1947 সাল পর্যন্ত স্বতন্ত্রভাবে মিলাদ নিয়ে রচিত কিছু ঐতিহাসিক 20টি কিতাব সংগ্রহ আছে  ,তারমধ্যে কিছু তুলে ধরলাম:-(গুলিস্তাঁ,1988)
 মৌলুদ শরীফ (মীর মশাররফ আহমদ -1898), মৌলুদ শরীফ ( মৌলভী মুহম্মদ নইমুদ্দীন -1895),মৌলুদ শরীফ (নওয়াব বাহাদুর নওয়াব আলী চৌধুরী -1905),বাংলা মউলুদ শরীফ ( সৈয়দ আবুল হোসেন -1925) ইত্যাদি৷1937সালে অক্টোবরে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ " এক জাতি গঠন" প্রবন্ধে " একজাতি হইতে গেলে জাতির সাধারণ পর্বদিন চাই"উল্লেখ করে মুসলমানদের তরফ থেকে মিলাদুন্নবীর উদযাপনকে " জাতীয় উৎসব "  হিসেবে প্রস্তাব করেছিলেন৷

ওয়াহেদ মির্জা
ওয়াহেদ মির্জা

কবি ও প্রাবন্ধিক