About Us | Contact Us |

দুর্গাপুর কান্ড উত্তর প্রদেশের এক খন্ড চিত্র

লিখেছেন : তায়েদুল ইসলাম
দুর্গাপুর কান্ড উত্তর প্রদেশের এক খন্ড চিত্র

আমরা কথায় কথায় গর্ব করে বলি, এটা বিজেপি শাসিত রাজ্য নয়। এটা উত্তর প্রদেশ নয়। আমরা উত্তর প্রদেশ হতে দেব না। কিন্তু আপনি যদি গত ৩১ জুলাই পশ্চিম বর্ধমান জেলার দুর্গাপুরের ঘটনা বর্ণনা করেন তা হলে ঘটনা সম্পর্কে অপরিচিত শ্রোতা কিছুতেই বিশ্বাস করবেন না এটা উত্তর প্রদেশের ঘটনা নয়। পরে ঘটনাস্থল পশ্চিম বর্ধমান জেলার দুর্গাপুর বললে মনে হতে পারে পশ্চিমবঙ্গ আর উত্তর প্রদেশের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এটা ঠিক একটা ঘটনা দিয়ে সমগ্ৰ পরিস্থিতির তুলনা করা যায় না। কিন্তু অন্ততপক্ষে এটুকু বলার মধ্যে কোন ভুল নেই যে ঐ ঘটনাটি উত্তর প্রদেশের মতো ঘটনা।


গত ৩১ জুলাই দুপুর বেলা কয়েক জন খুচরো গরু ব্যবসায়ী বাঁকুড়া জেলার বড়জোরা হাট থেকে ১৪ টি গরু কিনে ট্রাকে করে ডিভিসি ব্যারেজ পার হয়ে দুর্গাপুরের দিকে যাচ্ছিলেন। গরু ব্যবসায়ীরা ছিলেন দুর্গাপুর ৬ এর জেমুয়া গ্ৰাম, এবং বীরভূমের ইলামবাজার সংলগ্ন গ্ৰামের বাসিন্দা। তাঁরা দীর্ঘ দিন ধরে গরু কেনা-বেচার ব্যবসা করেন। কেউ কেউ দু তিন প্রজন্ম থেকে করেন। এক হাট থেকে কিনে অন্য হাটে বিক্রি করেন। মাংস, চাষের কাজে ব্যবহার, দুধ পাওয়ার জন্য - সব ধরনের গরুই কেনাবেচা করেন। এই ব্যবসার জন্য নিয়ম করে পুলিশকে তোলাও দেন। ঐ দিন ট্রাকে করে ১৪ টি গরু নিয়ে আসছিলেন। শ্বশান ঘাট এবং গ্যামন ব্রীজ মোড়ে দু জন বাইক আরোহী গরুর গাড়ি থামাতে বলে। গরু কেনার কাগজ দেখতে চাই। গরু গাড়ি থেকে নামাতে বলে। ব্যবসায়ীরা কাজ শুরু করেন। এর মধ্যেই প্রায় ৩০/৩৫ জন হাজির হয়ে যায়। মারধর শুরু করে। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। হাত পা বেঁধে আঘাত করে। জয়শ্রী রাম বলতে বাধ্য করে। বাংলাদেশী, মুসলিম বলে গালিগালাজ করে। ৭০ বছরের একজন বৃদ্ধকে মেরে রক্তাক্ত করে দেয়। দু আড়াই ঘণ্টা ধরে এই নিষ্ঠুর মার, গালিগালাজ চলতে থাকে। গুন্ডারাই মোবাইলে ভিডিও লাইভ প্রচার করে। ঢিল ছুড়া দুরত্বে " কোক ওভেন" থানা থাকলেও থানা দীর্ঘক্ষণ পৌঁছায়নি। দু আড়াই ঘণ্টা পর পৌঁছায়।  সন্ধ্যা ৮.১৫ মিনিটে থানা এফআইআর গ্ৰহণ করে। মূল অভিযুক্ত পারিজাত গাঙ্গুলী আর দিপক দাস সহ নাম বিহীন ২০/২৫ জনের বিরুদ্ধে। ধারা দেওয়া হয় বিএনএস ২০২৩ এর ১৯১(২)/ ১৯১(৩)/ ১৯০/ ১১৫(২)/ ১১৭(২)/ ১০৯(১)/ ৩০৩(২)/ ১৩৭(২)/ ৩২৪(৪)/৩৫১(২) । অভিযোগ দায়ের করেন দুর্গাপুর নিউ টাউনশিপ থানার জেমুয়া গ্ৰামের সেখ জহিরুল, বয়স ৫৫। পিতা মৃত সেখ জলিল। গত ৫ আগষ্ট সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ ইন্ডিয়া- এক প্রতিনিধি দল জেমুয়া গ্ৰাম পরিদর্শন করেন এবং কোক ওভেন থানা আধিকারিকের সাথে দেখা করেন। প্রতিনিধি দলের রিপোর্ট অনুযায়ী এ দিন পর্যন্ত ছয়জনকে পুলিশ গ্ৰেফতার করেছে। ১৪ টি গরু উদ্ধার করে ফেরত দিয়েছে। এখনও প্রধান অভিযুক্ত পারিজাত গাঙ্গুলী গ্ৰেফতার হয়নি। কোক ওভেন থানার ওসি মোঃ মাইনুল হক জানিয়েছেন এ দিন ঘটনার সময় তিনি ফোর্স সহ অন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে অন্যত্র ব্যস্ত ছিলেন। না হলে, তিনি থানায় উপস্থিত থাকলে ঘটনা এত দূর গড়াতে পারতো না। পারিজাতকে গ্ৰেফতারের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। উপর মহল থেকেও তাকে গ্রেফতারের জন্য চাপ আছে। আটটি দল চেষ্টা চালাচ্ছে। প্রাথমিক খবরে জানা যাচ্ছে সে রাজ্যে নেই। একটি দল চেন্নাই পৌঁছিয়েছে । আশা করছি কয়েক দিনের মধ্যে তাকে গ্রেফতার করা যাবে। আধিকারিকের সাথে দেখা করে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় প্রতিনিধি দল দাবি করে নৃশংস ভাবে আক্রমণ ও আঘাত করার মূল পান্ডা পারিজাতকে  অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে। মূল আসামী পারিজাতকে এখনও গ্ৰেফতার করেনি। প্রতিনিধি দল যখন থানা থেকে বেরিয়ে হেঁটে আসছিলেন ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রলোক প্রতিনিধি দলের কাছে এসে কাকুতি মিনতি করে বলেন আমার ছেলেও জড়িত। সে এখন বাড়িতে ঘুমাচ্ছে। সাম্প্রদায়িক গন্ডগোল করবেন না। এখানে হিন্দু মুসলমানের খারাপ সম্পর্ক কোন দিন ছিল না। পাশে থেকে এক জন জানালেন ছয় জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তার প্রতিবাদে থানা ঘেরাও হবে। প্রচুর পুলিশ মোতায়েন দেখা গেল। ফলে ঐ ভদ্রলোকের পরিচয়, তার কথার সত্যতা, নাকি অপ্রকৃতিস্থ, নাকি আতঙ্কগ্ৰস্থ তা জানা হয়নি। থানায় জানানোও হয়নি। প্রতিনিধি দলের এক জন মন্তব্য করেন হতে পারে তিনি পারিজাতের বাবা। পারিজাত বাড়িতেই আছে। আশঙ্কা করছেন পারিজাতকে প্রকাশ্যে পেলে গণরোষের শিকার হতে পারে। সেই ভয়ে এ রকম আচরণ করছেন। 
এলাকার সর্বস্তরের জনগণের বক্তব্য দুর্গাপুর সবসময় সম্প্রীতির জায়গা। আরএসএস ও বিজেপির প্রভাবে সম্প্রীতির পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। পুলিশ নিরপেক্ষ ভাবে এবং শক্ত হাতে ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে আরও ঝামেলা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।


ঘটনাটি রাজ্য সামাজিক মাধ্যমে হইচই ফেলে দিয়েছে। নেটিজেনদের একাংশের দাবি এ রাজ্যেও তৃণমূলের আমলে মব লিঞ্চিং এর মতো ঘটনা ঘটে চলেছে। রাজ্য সরকার শক্ত ভাবে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। তৃণমূল সরকার নরম হিন্দুত্বের পথে হাঁটতে এই অভিযোগ হালে পানি পাচ্ছে । মানবাধিকার কর্মীদের বক্তব্য তৃণমূলের ছত্রছায়ায় হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে। পুলিশের একাংশ বিজেপি প্রভাবিত মানসিকতা নিয়ে কাজ করছে। রাজ্য সরকারকে শক্ত হাতে এ সবের মুকাবিলা করতে হবে।

তায়েদুল ইসলাম
তায়েদুল ইসলাম

বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী