এই যে চারিদিকে বাংলার মানুষজনকে পেটানো হচ্ছে, সেটা নাকি অনেকের চোখে পড়ছে না। এই চোখে না পড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে শ্রেণী। কাদের চোখে পড়ছে না? মাথা থেকে পা অবধি যাঁদের ঋণে জর্জরিত, তবুও নিজেকে মধ্যবিত্ত ভাবা বন্ধ না করা বাঙালীর একাংশের চোখে পড়ছে না। মিঠুন চক্রবর্তী বা সাহিত্যিক তিলোত্তমা মজুমদার কিংবা বিজেপির নতুন বাঙালী সভাপতি শমিক ভট্টাচার্যের বা অন্যান্য যাঁরা নিয়ম করে বাংলার বিবেক হয়ে এবিপি আনন্দে যান, তাঁদের না হয় চোখে মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত হওয়ার স্বপ্ন আছে তাঁদের চোখে পড়ে না, কিন্তু সিপিআইএম দলের নেতাদের, তাঁদেরও চোখে পড়ছে না? যাঁরা গরীব মানুষের কথা বলে থাকেন, তাঁদের চোখেও যদি না পড়ে তাহলে মুশকিল। তাঁদের অনেকেই বলছেন এটা তৃণমূল এবং বিজেপির সেটিং তত্ত্ব। বিজেপি তৃণমূলকে হারাতে চায় না, তাই তাঁরা নির্বাচনের আগে তৃণমূল যাতে এই বিষয়ে আন্দোলন করতে পারে এবং বাংলা ভাষা আন্দোলন আবার নতুন করে শুরু করে, বাংলা-বাঙালী আবেগকে সামনে নিয়ে আসতে পারে এবং ২০২৬ সালের নির্বাচনে জিততে পারে সেই জন্যেই নাকি এই বিষয়টা সচেতনভাবে সামনে এনেছে।
কিন্তু বিষয়টা কি এতটাই সরলরৈখিক? এই বিষয়টার মধ্যে আর কিছুই কি নেই? ঐ যে বললাম, আসল কারণ শ্রেণী, বাঙালি মধ্যবিত্ত তো বেঙ্গালুরু বা পুণেতে মার খাচ্ছেন না আপাতত, তাই চোখে পড়ছে না, দেশের নানান রাজ্যে বাঙালী গরীব সংখ্যালঘু মানুষেরা আক্রান্ত হচ্ছেন। এই শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই কোভিডের সময়ে তাঁরা থালা বাজিয়েছেন, বাড়ির পরিচারকদের কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন মাইনে না দিয়ে, তাঁরা কীভাবে খেতে পাবেন তা ভাবেননি। দরজা বন্ধ করে ডালগোণা কফি বানিয়েছেন। বড় কমপ্লেক্সে লিফটে জমাদার বা বাড়ির পরিচারকদের উঠতে দেননি। ঐ সময়ে দলে দলে পরিযায়ী শ্রমিকেরা যখন বাড়ি ফিরতে গিয়ে দেখেছেন, ট্রেন, বাস সহ সমস্ত যানবাহন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে তখন তাঁদের ঐ জমায়েত দেখে মনে করেছেন ঐ ভীড় থেকেই কোভিড সংক্রমণ বাড়বে। তবলিগ জামাতের সদস্যদের দিকে আঙুল তুলেছেন। এই ধরনের মানসিকতা এবং আচরণ শুধু একজন বা দু’জন করেননি, বেশীরভাগই করে গেছেন আর ভেবেছেন এই পদ্ধতিতে নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখে অনেক উঁচুতে বাস করে শুধু নিজেরা ভালো থাকবেন। এই মানুষেরা নিজেদের মধ্যবিত্ত ভাবেন বটে, কিন্তু আসলে যে তাঁরা হতদরিদ্র, তা সেদিনও বুঝতে পারেননি, আজও বোঝেন না। তাই তাঁদের অনেক কিছুই চোখে পড়ে না। কিন্তু চোখে পড়ে না বললেই তো বিষয়টা মিথ্যে হয়ে যায় না।
এই যেমন কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র দপ্তর গত ১৮ই মে ২০২৫ দেশজুড়ে এক সাঁড়াশি অভিযানের ডাক দিয়েছে, তথাকথিত বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে। প্রতিটি রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় শাসিত রাজ্যকে নির্দেশ পাঠিয়েছে ৩০ দিনের মধ্যে তথাকথিত অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গাদের চিহ্নিত করতে, গ্রেপ্তার করতে। বাংলাদেশী বা রোহিঙ্গা সন্দেহজনক বন্দিদের জল সীমান্ত বাহিনী বা বিএসএফ বা আসাম রাইফেলের হাতে তুলে দিতে হবে । দ্রুত তাদের দেশ থেকে বের করে দিতে হবে। আমি জানি না বললে এই নির্দেশিকা তো মিথ্যে হয়ে যায় না।
এই নির্দেশ পালনের জন্য প্রত্যেক রাজ্য সরকারকে দ্রুত প্রতিটি জেলায় একটা করে বিশেষ টাস্ক ফোর্স (STF) দল গঠন করতে বলা হয়েছে। এই বিশেষ টাস্ক ফোর্সকে ৩০ দিনের মধ্যে কাজ শেষ করতে বলা হয়েছে। সেই কারনেই আজকাল কাগজে কাগজে হঠাৎ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে ভারতীয় কোস্টাল গার্ড বাহিনী কয়েক’শ বাংলাভাষীকে বিভিন্ন রাজ্য থেকে ধরে এনে মাঝ সমুদ্রে ছুড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেছে। অথবা বিএসএফ কয়েক’শ বাঙালিকে অকথ্য অত্যাচার করে নো ম্যানস ল্যান্ডে ছুঁড়ে ফেলে এসেছে বা উড়িষ্যার মত ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি করে রেখেছে। সেই জন্যেই হরিয়ানার গুরগাঁও বা তামিলনাডু বা মহারাষ্ট্রে বাঙালীদের ওপর অত্যাচার চলছে। আসলে দীর্ঘদিন ধরে একটা প্রচার করা হয়েছে যে বাংলাদেশ থেকে মায়ানমার থেকে লক্ষ লক্ষ অনুপ্রবেশকারী বাংলা হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, তার ফলেই আজ সারা দেশ জুড়ে বাঙালী দেখলেই অন্য ভাষার মানুষদের মনে হচ্ছে, সবাই বাংলাদেশী রোহিঙ্গা। সারা বিশ্বে কত জন রোহিঙ্গা আছে, তা জানা নেই, খোঁজ নেওয়া নেই, কিন্তু সরকারের তালে তাল মেলানো ছাড়া এখন কিছুই করনীয় নেই। ঐ প্রচার দীর্ঘদিন ধরে করে যাওয়ার কারণে আজ বেশীরভাগ মধ্যবিত্ত মানুষজন এটাই মনে করেন সত্যি, অথচ জনবিন্যাস দেখলে তা কিন্তু মনে হয় না। চারিদিকে যদি বাংলাভাষী মুসলমান বিপুল পরিমাণে বেড়ে যেত, তাহলে তো সেটা আশেপাশের মানুষদের সঙ্গে কথা বললেই মালুম হতো। বাংলাদেশী মুসলমানরা নিশ্চিত হনুমান পুজো করেন না, বা গণেশপুজো করেন না। তাহলে চারিদিকে এত হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের সংস্কৃতির রমরমা কেন?
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রতিটি রাজনৈতিক দল জানত যে খুব শীঘ্রই পশ্চিমবঙ্গবাসীদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁদের ওপর অত্যাচার শুরু হতে চলেছে । তারা সবাই জানত এই আক্রমণ কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে রাজ্যে রাজ্যে মূলত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নাগরিকত্ব আইন ১৯৮৫, ১৯৮৬, ২০০৩, ২০১৯ প্রয়োগ করার অছিলায় হচ্ছে। তবুও সরকার পক্ষ ও বিরোধীরা কোনো বিরোধিতা করেনি। এই বিষয়ে যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করেন, তিনিও চুপ থাকবেন, কারণ CAA ২০০৩ পাশ করানোর সময়ে তিনি বিজেপি’র মন্ত্রীসভায় ছিলেন। কংগ্রেস এবং সিপিআইএম ও ঐ সময়ে নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের বিরোধিতা করেনি, বা পরে ইউপিএ ক্ষমতায় এসেও তা পরিবর্তন করার চেষ্টা করেননি। আজকে বাঙালী ভাবাবেগ নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরব, কিন্তু এই নাগরিকত্ব আইন বাতিলের কথা তিনি কি বলছেন? এতদিনে তাঁর মনে হচ্ছে বাংলা সিরিয়ালে কেন হিন্দি গান ব্যবহার করা হচ্ছে, কিন্তু এই সংস্কৃতি কি একদিনে জায়গা করে নিয়েছে? তাছাড়াও এই হিন্দি সংস্কৃতিও নিশ্চিত বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা নিয়ে আসেননি। তবে সমস্যাটা কোথায়?
বিভিন্ন সময়ে প্রমাণ হয়েছে অনুপ্রবেশকারী সন্দেহে অত্যাচারিত প্রতিটি মানুষ বা তাঁদের পূর্বপুরুষেরা স্বাধীনতার বহু আগে থেকেই ভারত বসবাস করে। এমনকী বাংলাদেশে কোনদিন ঘুরতেও যায়নি। তারা প্রত্যেকেই নিজেদের ভারতীয় হিসাবে প্রমাণ দিয়েছে ও বাড়িতে ফিরে এসেছে। প্রমাণিত হয়েছে মুখে সরকার যতই বলুক না কেন এই নাগরিকত্ব আইনগুলো শুধুমাত্র বিদেশিদের উপর প্রয়োগ হবে, বাস্তবে দেখা গেল কয়েক পুরুষ থেকে ভারতে বসবাসরত মানুষদের উপর এই আইনগুলো প্রয়োগ হয়েছে ও হচ্ছে। আসলে দেশের নাগরিকদের বেনাগরিক করারই আইন এইগুলো। এই গুলো দিয়ে সরকার নিজের নাগরিকদের উপরই আক্রমণ হানছে। তাহলে শুধু বাঙালিরা আক্রান্ত বললে হবে না, বলতে হবে কী কারণে বাঙালিরা আজ দেশের নানান প্রান্তে আক্রান্ত।
আর আমাদের রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলো সব জেনে বুঝেও বিমূর্ত ভাষার উপর আক্রমণ বলে কত মিছিল মিটিং-ই না করছে, কেঁদে কঁকিয়ে একাকার হচ্ছে। আসলে আরএসএস পরিচালিত বিজেপি সরকারের ঘৃণ্য চক্রান্তকে আড়াল করেছে সবাই। অথচ আসল বিষয়টা তারা প্রত্যেকেই জানত কে, কেন এটা করছে, কিন্তু কোনোদিন তার বিরোধিতা করেননি।
মোদ্দা কথা হলো কোনও ব্যক্তি ২০০ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করলেও, সেই ব্যক্তিকে যে কোনো সময়ে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী বলে ধরে নিয়ে যেতে পারে ---- সেটা আজ দেখতে না পাওয়া গেলেও যে কোনও দিন হতে পারে। সুতরাং জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব এই দাবী যদি না করা যায় তাহলে সমূহ বিপদ। ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনেই একমাত্র এই জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা আছে। শ্রেণীর রাজনীতি এই শিক্ষাই দেয়, যে সত্যি কথা স্বীকার করতে হবে। উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে থাকলে, ঝড় কি আটকানো যায়? শুধু বাঙালী আক্রান্ত বললে সম্পূর্ণটা বলা হয় না। এটা তো উপসর্গ মাত্র। আসল রোগটা তো ধরতে হবে। আসল রোগটা তো নাগরিকত্ব আইনে লুকিয়ে আছে, ঐ রোগ না সারিয়ে বাংলা-বাঙালী ভাবাবেগ শুধু জাগিয়ে লাভ হবে না, তাতে অন্য ভাষার মানুষের প্রতি বিদ্বেষ তৈরী হবে। সেই বিদ্বেষ অন্য সমস্যার সৃষ্টি করবে। এতদিন ধর্মে ধর্মে বিভেদ ছিল, আগামীতে তা ভাষায় ভাষায় বিভেদ হয়ে দেখা দেবে, তাতে কি আসল সমস্যা মিটবে?