সুপ্রীম কোর্টের এই রায় নিয়ে সংবাদ মাধ্যমগুলিতে অনেক কথা হচ্ছে, টিভি চ্যানেল ও তথাকথিত সোশাল মিডিয়ায় অনেক কথা অনেক চেঁচামেচি চলছে। মাঝেমাঝে মনে হচ্ছে যে যাঁরা তর্ক করছেন চিৎকার করছেন তাঁদের অনেকেই সুপ্রীম কোর্টের এই রায়টি পড়ে দেখেননি। ফলে কোনও আলোচনা করার আগেই ওই রায়ে ঠিক কি আছে সেটা তুলে ধরা দরকার। সেজন্য ওই রায় থেকে উদ্ধৃতি দিতে হবে, পাঠক ক্ষমা করবেন।
সুপ্রীম কোর্টের রায়ে ২০১৬ সালের গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়াকে দুর্ণীতির কারণে বাতিল করা হয়েছে। যাঁদেরকে নিয়োগ করা হয়েছিল সেই মোট প্রায় ২৬ হাজার মানুষের চাকরি বাতিল হয়েছে। এই ২৬ হাজার মানুষের মধ্যে অনেকেই আছেন যাঁরা কোনও দুর্নীতি করেননি কোনও দোষ করেননি।
ঘুস নিয়ে চাকরি দেওয়ার এক বিশাল ষড়যন্ত্র হয়েছিল। দুর্ণীতির এই বিশাল জাল পেতেছিলেন রাজ্যের শাসকদলের মন্ত্রী, এমএলএ ও নেতা কর্মীদের একাংশ এবং তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন সরকারি শিক্ষাদপ্তর, স্কুল সার্ভিস কমিশন ও মধ্যশিক্ষা পর্ষদের আধিকারিকদের একাংশ।
প্রথম প্রশ্ন যে চাকুরিপ্রার্থীরা কোনও দোষ করেননি তাঁদের কি চাকরি বাতিল হওয়া উচিত?
এই প্রশ্নের উত্তরে সুপ্রীম কোর্ট কি বলেছেন? সেটি উল্লেখ করার পূর্বে আইন সম্পর্কে একটি ভুল কথা প্রচার হচ্ছে সেটি বলা দরকার। যাঁরা টাকা দিয়ে অবৈধ উপায়ে চাকরি পেয়েছেন তাঁদের চাকরি বাঁচানোর জন্য শাসকদলের তরফে আইনের বহুল প্রচারিত একটি কথা তুলে ধরা হচ্ছে; কথাটি হল-'একশো অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাক কিন্তু একজনও নিরপরাধ যেন শাস্তি না পায়'। অর্থাৎ ২৬ হাজারের মধ্যে যদি বৈধ অবৈধ অথবা যোগ্য অযোগ্যদের আলাদা না করা যায় তবে কারোরই চাকরি যেন বাতিল না হয়। আর তাই যদি হয় তাহলে সেই মহান অপরাধীরা যাঁরা টাকা নিয়ে চাকরি বিক্রি করেছেন তাঁরাও বেঁচে যেতে পারেন। মহান অপরাধীরা আইনের একটি মহান প্রবাদকে আশ্রয় করে বাঁচতে চাইছেন। সমস্যা হলো যাঁরা অপরাধীদের বিরুদ্ধে সেই আইনজীবীরা এর জবাবে আইনি কথা বলতে গিয়ে টিভি চ্যানেলে যা বলেছেন সেটি একেবারেই ভুল কথা। তাঁরা বলেছেন যে-'একশো অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাক কিন্তু একজনও নিরপরাধ যেন শাস্তি না পায়' কথাটি কেবল ফৌজদারি আইনের কথা (ওঁরা criminal jurisprudence বলেছেন) এবং সেকথা নাকি চাকরি সংক্রান্ত মামলায় (ওঁরা service jurisprudence বলেছেন) খাটে না।
'একশো অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাক কিন্তু একজনও নিরপরাধ যেন শাস্তি না পায়'- আইনের এই প্রবাদবাক্যটি শুধু ফৌজদারি নয় সবরকম মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আইনের বহুরকম প্রবাদবাক্য রয়েছে। নির্বিচারে সেগুলির প্রয়োগ করা যায় না। মামলার বিচার্য বিষয়, সাক্ষ্যপ্রমাণ, মামলার পক্ষভুক্তদের ব্যক্তিগত লাভক্ষতি ও সামাজিক পরিস্থিতির ওপর প্রবাদবাক্যগুলির প্রয়োগ নির্ভর করে। সুপ্রীম কোর্টের বর্তমান রায় থেকেও এটা বোঝা যায়।
যে আইনজীবীরা টিভি চ্যানেলে ওই ভুল কথাটি বলেছেন তাঁরা অনেকে এই মামলার বিভিন্ন ধাপে নানাভাবে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু তাঁরা নিজেরাই কি সুপ্রীম কোর্টের রায়টি পড়ে দেখেননি?
সুপ্রীম কোর্ট ওই রায়ে কি বলছেন? রায়ের ৭নং প্যারাগ্রাফে সুপ্রীম কোর্ট বলছেন।
'In such cases- it may be possible to segregate the wrongdoers from those who adhered to the rules. The innocent should not suffer for the actions of the wrongdoers. By segregating the guilty- the se-lection process for the untainted candidates can pro-ceed to its logical conclusion.
..Care must be taken to ensure that the innocent are not unfairly penalized alongside the wrongdo-ers by cancelling the entire process. To treat the in-nocent and the wrongdoers equally would violate Article 14 of the Constitution as it would involve treating unequals equally. The innocent should not be punished for faults they did not commit'. (বাংলায় "এইসব ক্ষেত্রে হয়তো যারা অন্যায় করেছে তাদের থেকে যারা নিয়ম মেনে চলেছে তাদের আলাদা করা সম্ভব। দোষীদের কাজের ফলে নির্দোষীদের যেন ভুগতে না হয়। দোষীদের আলাদা করে ফেলতে পারলে বেদাগ (নির্দোষ) প্রার্থীদের নিয়োগ প্রক্রিয়াকে যুক্তিসঙ্গত পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া যায়।.. অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যাতে নিয়োগ প্রক্রিয়ার পুরোটাই বাতিল করার ফলে দোযীদের সঙ্গে সঙ্গে নিদোষীরা অন্যায়ভাবে শাস্তি না পায়। নির্দোষীদের সাথে দোষীদের সমানভাবে দেখলে সংবিধানের ১৪ নং ধারা লঙ্ঘন করা হয় কারণ তাতে যারা সমান নয় তাদেরকে সমান ধরা হচ্ছে। যে দোষ নিদোষীরা করেনি সেই দোষের কারণে তাদেরকে শাস্তি দেওয়া যায় না)।
একথাগুলো বলার পরেও এই মামলায় সুপ্রীম কোর্ট পুরো প্যানেল বা পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করেছেন। এক ধাক্কায় প্রায় ২৬০০০ শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের চাকরি চলে গেছে। এই ২৬০০০ শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাঁরা কষ্ট করে পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে তবে চাকরি পেয়েছেন। তাঁরা তো কোনও অন্যায় বা দুর্নীতি করেননি। তাঁদেরকে তো দোষী বলা যায় না। তবে তাঁদেরকে দোষীদের সঙ্গে এক করে দেখা হবে কেন? তাঁদের চাকরি বাতিল হবে কেন? কেন সুপ্রীম কোর্ট দোষী ও নির্দোষদের এক করে সকলের চাকরি বাতিল করলেন? দোষী ও নির্দোষদের কি আলাদা করা যেতো না? সুপ্রীম কোর্ট এব্যাপারে কি বলেছেন তা দেখা দরকার। সুপ্রীম কোর্টের রায়ের পুরোটা বাংলা তর্জমা করে দিলে ভাল হত। কিন্তু স্থানাভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না। তবে ওই রায়ের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিতে হবে।
সুপ্রীম কোর্টের রায়ে কি আছে?
সুপ্রীম কোর্টের রায়টি ৫৩-টি প্যারাগ্রাফে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। আপিল করার বিশেষ অনুমতি দেওয়ার পরে ২-নং প্যারা থেকে রায় শুরু হয়েছে। ২-নং থেকে ৫ নং প্যারায় হাইকোর্টের কোন রায়ের বিরুদ্ধে আপিল, কাঁরা কাঁরা আপিল করেছেন এবং কাঁদেরকে আপিলে অপরপক্ষ রূপে যুক্ত করা হয়েছে সেসব বলা হয়েছে।
এখানে দেখা যাচ্ছে হাইকোর্টের ২২শে এপ্রিল ২০২৪ তারিখের রায়ের (কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায়) বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছে। হাইকোর্ট ওই রায় দিয়ে ২০১৬ সালের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগের গোটা প্রক্রিয়াটি বাতিল করে দিয়েছিলেন এবং নিয়োগের জন্য মনোনীত প্রায় ২৬ হাজারের চাকরি বাতিল হয়েছিল।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে কাঁরা সুপ্রীম কোর্টে আপিল করলেন? প্রথমতঃ একদল চাকরিপ্রার্থী যাঁরা নির্দোষ এবং আরেকদল যাঁদের বিরুদ্ধে দুর্ণীতির অভিযোগ এসেছে। দ্বিতীয়তঃ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার। তৃতীয়তঃ পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশন বা এসএসসি SSSC)। সিবিআই তদন্ত করেছিল তাই তাকেও এই আপিলে পক্ষভুক্ত করা হয়েছে।
রায়ের ৬-নং প্যারায় মামলা সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য, ঘটনাক্রম, হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চ ও ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশগুলি উল্লেখ করা হয়েছে।
রায়ের ৭-নং প্যারা থেকে ১৯-নং প্যারা পর্যন্ত রয়েছে আইনের আলোচনা। ওই আলোচনা যে মূল প্রশ্নকে নিয়ে করা হয়েছে তা হল কোন পরিস্থিতিতে গোটা নিয়োগ-প্রক্রিয়াকে বাতিল করা উচিত বা উচিত নয়। এখানে সুপ্রীম কোর্টের একাধিক মামলার উদাহরণ উল্লেখ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছবার চেষ্টা করা হয়েছে। সুপ্রীম কোর্ট ১১টি মামলার উল্লেখ করেছেন।
হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় যে যে বেআইনি কাজ করা হয়েছে তার লিস্ট করেছেন এবং সুপ্রীম কোর্ট তাঁর রায়ের ২০-নং প্যারায় সেটা উল্লেখ করেছেন। ২১-নং প্যারায় বাগ কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী অশিক্ষক কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে কি কি বেআইনি কাজ করা হয়েছে এবং কাঁরা করেছেন তার উল্লেখ করেছেন। ২২-নং প্যারায় সিবিআইয়ের তদন্তের রিপোর্টে যেসব তথ্য দেওয়া হয়েছে তার উল্লেখ করা হয়েছে। ২৩-নং প্যারায় বেআইনি কাজগুলি সম্পর্কে এসএসসির স্বীকারোক্তির উল্লেখ রয়েছে। কতজন প্রার্থী কি ধরনের বেআইনি কাজের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন এসএসসি হাইকোর্টে তার সংখ্যাগুলি দিয়েছিলেন সুপ্রীম কোর্ট তাঁর রায়ের ২৪-নং থেকে ২৬-নংপ্যারায় তা উল্লেখ করেছেন। পরে এসএসসি ডিগবাজি দিয়ে বলেছিলেন যে ঠিক কয়টি বেআইনি নিয়োগ হয়েছে তা তাঁরা বলতে পারবেন না; রায়ের ২৭-নং প্যারায় এর উল্লেখ আছে। ২৮-নং থেকে ৩৭-নং প্যারায় এসএসসি মধ্যশিক্ষা পর্ষদের বেআইনি কাণ্ডকারখানা, যার মধ্যে ওএমআর শিট নষ্ট করে দেওয়া, কোনও অনুমোদন ছাড়াই নিয়োগপত্র দেওয়া ইত্যাদির কথা রয়েছে। ৩৮ এবং ৩৯-নং প্যারায় চাকরিপ্রার্থী দু'দলের বক্তব্যের আলোচনা রয়েছে।
৪০-নং থেকে ৪২-নং প্যারায় সুপ্রীম কোর্ট বললেন যে গোটা নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় বৃহৎ আকারে কারচুপি করা হয়েছে; এবং সে কারচুপি ইচ্ছাকৃত ভাবে করা ও এসএসসি কারচুপিকে ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করেছে। যেসব আইনের কথা দিয়ে এসএসসি ও অন্যরা কেস বাঁচানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন সেসবের আলোচনা রায়ের ৪৩ ও ৪৪-নং প্যারায় রয়েছে।
৪৫-নং থেকে ৫৩-নং প্যারায় গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া ও সকলের চাকরি বাতিলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ও কিছু নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আইন সম্পর্কে সুপ্রীম কোর্টের সিদ্ধান্ত
আমরা ১৯-নং প্যারায় ফিরে যাব। এখানে সুপ্রীম কোর্ট আইনের আলোচনার সারাংশ থেকে যে সিদ্ধান্তগুলি গ্রহণ করলেন সেগুলি বলা হয়েছে। এখানে সুপ্রীম কোর্ট বলছেন:-
'When an in-depth factual inquiry reveals systemic irregularities-such as malaise or fraud-that undermine the integrity of the entire selection process the result should be cancelled in its entirety. However if and when possible- segregation of tainted and untainted candidates should be done in consonance with fairness and equity'. (বাংলায়- যখন গভীর ভাবে তথ্য অনুসন্ধান করে দেখা যায় যে গোটা ব্যবস্থাটার অঙ্গপ্রত্যঙ্গে অনিয়ম, যথা গোটা ব্যবস্থাটার অসুস্থ অবস্থা বা ধোঁকা, যা গোটা নিয়োগ-প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতাকে নষ্ট করে দেয়, তখন নিয়োগ-প্রক্রিয়ার পুরো ফল বাতিল করতে হবে। তাহলেও যদি বা যেখানে সম্ভব সেখানে চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে নির্দোষ ও দোষীদের আলাদা করতে হবে কারণ ন্যায় ও সৎবুদ্ধির সেটাই নিয়ম)।
তাহলে সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে বলে পুরো নিয়োগ-প্রক্রিয়াকে বাতিল করার আগে দেখতে হবে যে নির্দোষ ও দোষীদের (অথবা যোগ্য ও অযোগ্যদের) আলাদা করা যাচ্ছে কি না। কিন্তু আলাদা করার এই কাজটি কে করবেন? অবশ্যই আদালতকেই করতে হবে।
হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চ, ডিভিশন বেঞ্চ এবং সুপ্রীম কোর্ট বারেবারে এসএসসি ও মধ্যশিক্ষা পর্ষদের কাছে যোগ্য ও অযোগ্যদের তালিকা চেয়েছিলেন। তা তাঁরা দেননি; দায়সারা ভাবে অযোগ্যদের কিছু নাম দিয়ে বলেছিলেন যে তাছাড়াও আরও অযোগ্য থাকতে পারে। এই কারণেও দায়টা আদালতের ওপরেই পড়ে। পুরো নিয়োগ-প্রক্রিয়াকে বাতিল করার আগে আদালতকেই এই দায় নিতে হবে। নির্দোষ ও দোষীদের (অথবা যোগ্য ও অযোগ্যদের) আলাদা করা না গেলে কেন তা করা গেলনা তার কারণ দেখাতে হবে।
আমরা এবার দেখব যে সুপ্রীম কোর্ট এই কাজটি কীভাবে কতটুকু করলেন।
যোগ্য ও অযোগ্যদের আলাদা করা: সুপ্রীম কোর্টের প্রচেষ্টা
যোগ্য ও অযোগ্য শব্দ দুটির বদলে সুপ্রীম কোর্ট অন্য শব্দ ব্যবহার করেছেন। যোগ্য শব্দের বদলে 'বেদাগ' (untainted অর্থাৎ যার গায়ে অভিযোগের দাগ নেই), আর অযোগ্য শব্দের বদলে 'দাগী' (tainted-অর্থাৎ যার গায়ে অভিযোগের দাগ আছে)।
আমরা অবশ্য যোগ্য ও অযোগ্য শব্দ দুটি ব্যবহার করছি। পুনরাবৃত্তি - হলেও আমরা আবার উল্লেখ করছি যে সুপ্রীম কোর্ট সিদ্ধান্ত করেছেন = পুরো নিয়োগ-প্রক্রিয়া বাতিল করার আগে চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে যোগ্য ও অযোগ্যদের আলাদা করার প্রচেষ্টা করতেই হবে এবং তারজন্য গভীরভাবে তথ্য অনুসন্ধান করতে হবে।
কিন্তু এই তথ্য অনুসন্ধানের কাজটি কে করবেন? অনুসন্ধান বা তদন্তের কাজ আদালত নিজে করতে পারেন না। সাধারণত পুলিশ বা কোনও তদন্তকারী সংস্থা বা নিয়োজিত কোনও এনকোয়ারি । কমিশন বা সরকার কিম্বা আদালত নিয়োজিত কোনও ব্যক্তি বা কমিটি তথ্য অনুসন্ধান বা তদন্তের কাজ করেন। তথ্য অনুসন্ধান বা 1 তদন্তের ফলাফল আদালতের কাছে যখন পেশ করা হয় তখন আদালত বিচার করে তদন্তের ফলাফলকে সঠিক বলতে পারেন - অথবা বেঠিক বলতে পারেন অথবা পুনর্তদন্তের দিক নির্দেশ করতে পারেন। তদন্ত বা অনুসন্ধান হোক বা না হোক চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে যোগ্য ও অযোগ্যদের আলাদা করার দায় আদালতের।
আশ্চর্যের বিষয় এই যে যোগ্য ও অযোগ্যদের আলাদা করার জন্য সুপ্রীম কোর্ট কি প্রচেষ্টা করলেন তার কোনও হদিশ তাঁদের এই রায়ে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁরা কি চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন? তাই যদি হয় তাহলে সে ব্যাপারে রায়ে স্পষ্ট করে লিখতে হত যে তাঁরা কি চেষ্টা করেছিলেন আর কেন তা ব্যর্থ হল। দুর্ণীতির ফলে গোটা নিয়োগ-প্রক্রিয়া যে বিনষ্ট হয়েছে তা নিয়ে সুপ্রীম কোর্ট অনেক কথা যথার্থভাবেই লিখেছেন। কিন্তু তারপরে এই মামলায় যোগ্য ও অযোগ্যদের আলাদা করার জন্য তাঁদের যে দায় তা নিয়ে তাঁরা একটি কথাও খরচ করেননি। ফলে সুপ্রীম কোর্টের এই রায় অসম্পূর্ণ।
কোনও তথ্যই কি ছিল না?
যোগ্য ও অযোগ্যদের আলাদা করার জন্য সুপ্রীম কোর্টের কাছে কোনও তথ্যই কি ছিল না? তথ্য ছিল। সুপ্রীম কোর্ট সেই তথ্যের প্রতি হয় নজর দেননি অথবা সে তথ্য যথেষ্ট নয় ভেবে গ্রহণ করেননি। কিন্তু রায়ে সেটা বিশেষ ভাবে লেখা উচিত ছিল।
সেই তথ্যটি কি?
আমরা রায়ের ২২-নং প্যারায় দেখতে পাব যে সুপ্রীম কোর্ট সিবিআইয়ের ৫-ই ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখের রিপোর্টে পাওয়া কিছু তথ্যের উল্লেখ করেছেন। সিবিআই তদন্ত করে তথ্যগুলি উদ্ধার করেছেন। উল্লিখিত ওই রিপোর্টের ৫-নং থেকে ১১-নং প্যারায় ওএমআর শিট 'OMR Sheet' সংক্রান্ত তথ্যগুলি রয়েছে।
ওএমআর শিটকে কোনও পরীক্ষার্থীর উত্তরপত্র বলা যায় যেখান থেকে পরীক্ষার্থী কত নম্বর পেয়েছেন তা দেখা যায়। এই ওএমআর শিটগুলি সংরক্ষণ করার কথা ছিল। কিন্তু সেগুলি পুড়িয়ে দেওয়া বা নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এসএসসি বলেছেন যে তাঁরা এগুলি নিয়ম অনুযায়ী এক বছর পরে নষ্ট করেছেন। সুপ্রীম কোর্ট এ সম্পর্কিত নিয়ম দেখে বলেছেন ঐ নষ্ট করা বেআইনি হয়েছে।
কিন্তু ওএমআর শিটগুলি নষ্ট করার আগে সেগুলি স্ক্যান (Scan বা কম্পিউটারে ছবি) করে সংরক্ষণ করা হয়েছিল। সিবিআই রিপোর্টের ৩-নং প্যারায় এর উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে ওই স্ক্যান করা এবং প্রত্যেকটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর কি হবে তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখে পরীক্ষার্থীরা কে কত নম্বর পেল তা ঠিক করার দায়িত্ব বা কাজটি "নাইসা" নামে একটি কোম্পানিকে দেওয়া হয়েছিল।
ওই রিপোর্টের ৫-নং প্যারায় বলা হয়েছে যে নাইসা স্ক্যান করার কাজের জন্য আরেকটি কোম্পানিকে বরাত দেয় যার নাম ডেটা স্ক্যানটেক সলিউশন'। এই দুটি কোম্পানির লোকজন এসএসসির অফিসে যায় এবং এসএসসির অফিসারদের এ উপস্থিতিতে স্ক্যান করার কাজটি সম্পন্ন করে। তারপর ওএমআর এ শিটগুলির স্ক্যান করা ছবিগুলি হার্ড ডিস্কে সংরক্ষণ করে হার্ড ডিস্কগুলি নাইসার হাতে দেওয়া হয়। নাইসা সেগুলি তাদের নয়ডা অফিসে নিয়ে যায়। এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নগুলির সঠিক উত্তরগুলি (answer key) নাইসার হাতে তুলে দেয়।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে ওএমআর শিটগুলি নষ্ট করে হলেও - সেগুলির ছবি হার্ড ডিস্কে সংরক্ষণ করা ছিল।
সিবিআই রিপোর্টের ১০-নং প্যারায় বলা হয়েছে যে তদন্ত - করতে গিয়ে ২০২২ সালের ১৫/১৬-ই সেপ্টেম্বর তারিখে নাইসার প্রাক্তন কর্মী পঙ্কজ বনশালের বাড়ি থেকে সিবিআই তিনটি হার্ড ডিস্ক উদ্ধার করে যেগুলিতে ওএমআর শিটগুলির ছবি আছে। ১১-নং প্যারায় বলা হয়েছে যে সিবিআই ডেটা স্ক্যানটেক সলিউশন কোম্পানির কাছ থেকে অনেক কম্পিউটার-ফাইল উদ্ধার করে যেগুলিতে ওএমআর শিটগুলির ছবি আছে তথ্য আছে। এই ফাইলগুলির সঙ্গে পঙ্কজ বনশালের কাছ থেকে উদ্ধার ফাইলগুলি মিলিয়ে (হ্যাশ ভ্যালু দেখা) বোঝা যায় যে পঙ্কজ বনশালের ফাইলগুলিতে কোনও কারচুপি হয়নি। ১২-নং প্যারায় বলা হচ্ছে যে এসএসসির কম্পিউটারে যেসব তথ্য ছিল তার সঙ্গে পঙ্কজ বনশালের ফাইলগুলির তথ্য মিলিয়ে দেখে বোঝা যায় যে যারা অযোগ্য তাদের নম্বর এসএসসি বাড়িয়ে দেখিয়েছে।
সিবিআই রিপোর্টে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কথা রয়েছে রিপোর্টের ১৮ (ডি) নং এবং ১৮(ই) নং প্যারায়। এখানে বলা হয়েছে:-
(d) The Response string of candidates pertain-ing to IXX and XI-XII as recovered from M/s Data Scantech Solutions matches with the Response String available in the hard disk seized from Pankaj Bansal. On the basis of these response strings the actual genuine OMR marks of IX-X and XI-XII candidates were determined. (বাংলায়- নাইন-টেন ও ইলেভেন-টুয়েলভ ক্লাসের চাকরিপ্রার্থীদের সম্পর্কিত রেসপন্স স্ট্রিং যা ডেটা স্ক্যানটেক সলিউশন কোম্পানির কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে তার সঙ্গে পঙ্কজ বনশালের হার্ড ডিস্ক থেকে পাওয়া রেসপন্স স্ট্রিং মিলে যাচ্ছে। এই রেসপন্স স্ট্রিংগুলির ভিত্তিতে ওই ক্লাসের চাকরিপ্রার্থীদের ওএমআরে প্রাপ্ত আসল বা জেনুয়িন নম্বরগুলি নির্ধারণ করা হয়েছে।
(e) The Response string of candidates pertain-ing to Gr. C & Gr. D as recovered from Ms Data Scantech Solutions matches with the Response String available in the hard disk seized from Pankaj Bansal. On the basis of these response strings the actual genu-ine OMR marks of Gr. C & Gr. D candidates were determined. (বাংলায় গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি-র চাকরিপ্রার্থীদের সম্পর্কিত রেসপন্স স্ট্রিং যা ডেটা স্ক্যানটেক সলিউশন কোম্পানির কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে তার সঙ্গে পঙ্কজ বনশালের হার্ড ডিস্ক থেকে পাওয়া রেসপন্স স্ট্রিং মিলে যাচ্ছে। এই রেসপন্স স্ট্রিংগুলির ভিত্তিতে গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি-র চাকরিপ্রার্থীদের ওএমআরে প্রাপ্ত আসল বা জেনুয়িন নম্বরগুলি নির্ধারণ করা হয়েছে।
'রেসপন্স স্ট্রিং' হল এমন একটি কম্পিউটার কৌশল বা টেকনিক যা ব্যবহার করে মোটা কথায় আসল-নকল চেনা যায়।
অতএব ওএমআর শিটগুলির ছবি পাওয়া গেল, চাকরিপ্রার্থীরা পরীক্ষায় কে কত নম্বর আসলে পেয়েছেন তাও নির্ধারণ করা গেল, অথচ যোগ্য অযোগ্যদের আলাদা করা গেলো না কেন? সুপ্রীম কোর্ট এ ব্যাপারে কি বললেন?
রায়ের শেষের দিকে ৪১-নং প্যারায় সুপ্রীম কোর্ট বললেন
'The claim that the data on the three hard disks shows no interpolation and is consistent with the data in M s. Data Scantech Solutionsóó computers fails to account for significant gaps and discrepancies.' (বাংলায় - তিনটি হার্ডডিস্ক সম্পর্কে যে দাবী করা হচ্ছে যে সেগুলিতে কোনও কারচুপি নেই ও হার্ড ডিস্কগুলি ডেটা স্ক্যানটেক সলিউশন কোম্পানির কাছে পাওয়া তথ্যগুলির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ সেই দাবী ইঙ্গিতপূর্ণ ফাঁক ও গরমিলগুলিকে ব্যাখ্যা করতে পারছেন না।) কি সেই ইঙ্গিতপূর্ণ ফাঁক ও গরমিলগুলি (significant gaps and discrepancies)? কোথায় সেগুলো দেখা যাচ্ছে? কোনো জবাব নেই। সিবিআইয়ের দীর্ঘ রিপোর্ট যেখানে ওএমআর শিটের ছবি পাওয়া গেছে ও পরীক্ষার্থীরা আসলে কত নম্বর পেয়েছেন তা নির্ধারিত হয়েছে বলে বলা হচ্ছে, যেটা সুপ্রীম কোর্ট নিজে উল্লেখ করেছেন, সেটাকে একটি আবছা বাক্য দিয়ে নাকচ করা যায় কি? যায় না।
দেখা যাচ্ছে যে যোগ্য ও অযোগ্যদের আলাদা করার চেষ্টা করা যেত। সুপ্রীম কোর্টের এই রায় অসম্পূর্ণ। অতি দ্রুত এই রায়ের যথাযথ পুনর্বিবেচনা দরকার।
চাকরিহারাদের প্রতি একটি নিবেদন
রাজ্য সরকার বলেছিলেন যে সুপ্রীম কোর্টে তাঁরা রিভিউ পিটিশন করবেন। কয়েকদিন আগে তাঁরা বাস্তবে যা করলেন তা হলো নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু করার জন্য সময় ভিক্ষা।
কোর্ট ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সময় দিয়েছেন। এও বলেছেন যে বেদাগ শিক্ষকরা ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত পড়াতে পারবেন ও মাইনে পাবেন। কে বেদাগ তা কি সুপ্রীম কোর্ট নিজে ঠিক করে দিয়েছেন? তা যদি না করে থাকেন তাহলে রাজ্যের মহান ব্যক্তিদের পোয়া বারো।
চাকরিহারারা সুপ্রীম কোর্টে রিভিউ পিটিশন করতে পারেন। কিন্তু শুধু আদালতের ওপর ভরসা করে বসে থাকলে হবেনা জনমতের ওপরেও ভরসা করতে হবে। আদালতে যান কিন্তু ঐক্যবদ্ধ হোন, আন্দোলনের রাস্তাতেও থাকুন। ঐক্যবদ্ধ থাকলে জয় হবে।
ঋন : সোশাল জাস্টিস