About Us | Contact Us |

ধর্ম, সংস্কৃতি ও নাগরিক সমাজ: ক্ষমতার নতুন অস্ত্র

ধর্ম, সংস্কৃতি ও নাগরিক সমাজ: ক্ষমতার নতুন অস্ত্র

বর্ধমান জেলার বৈচি গ্রাম একটি সাধারণ গ্রাম, যেখানে কৃষক, শ্রমিক, ছোট ব্যবসায়ী, শিক্ষক, পুরোহিত সবাই মিলে গড়ে তুলেছে এক চেনা বাংলার ছবি। বাইরে থেকে সব শান্ত, কিন্তু ভেতরে ভেতরে এখানে চলছে ক্ষমতার এক সূক্ষ্ম খেলা। এই খেলা শুধু প্রশাসন বা muscle-power-এর ওপর নির্ভরশীল নয়—এর মূল অস্ত্র ধর্ম, সংস্কৃতি ও নাগরিক সমাজ। এই গল্পের ভেতর দিয়ে আমরা বুঝতে পারি, আধুনিক ভারতীয় রাজনীতিতে কিভাবে বিজেপি ও তৃণমূলের মতো দলগুলো শুধুমাত্র বলপ্রয়োগ নয়, বরং মানুষের মনোজগৎ, বিশ্বাস ও চিন্তাকে নিজেদের দখলে এনে একপ্রকার পূর্ণ হেজেমনি প্রতিষ্ঠা করছে।
 

ধর্ম ও সংস্কৃতি: রাজনীতির হাতিয়ার
ভারতবর্ষে ধর্ম ও সংস্কৃতি কখনোই কেবল ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয় ছিল না; বরং এগুলো রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ব্রিটিশ শাসনকাল থেকেই ‘বিভক্ত করো ও শাসন করো’ নীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করে বিভাজন ও শাসনের পথ সুগম করা হয়েছে। স্বাধীনতার পরও এই প্রবণতা কমেনি। বরং, আজকের রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মীয় উৎসব, মন্দির, মসজিদ,লোককাহিনী, জাতীয়তাবাদ এসবকে নিজেদের রাজনৈতিক কৌশলের অংশ করেছে। বিজেপি যেমন হিন্দুত্বের ছাতার নিচে নানা ধর্মীয় পরিচয়কে একত্রিত করে, তৃণমূলও বাঙালি জাতীয়তাবাদ, দুর্গাপুজো, রবীন্দ্রনাথ, মাতৃভাষা ইত্যাদিকে ব্যবহার করে নিজেদের শক্ত ঘাঁটি গড়ে তুলছে।
ধর্ম ও সংস্কৃতি কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে প্রবল প্রভাব ফেলে। এই প্রভাব কখনো ঐক্য, আবার কখনো বিভাজন তৈরি করে। রাজনৈতিক দলগুলো এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সমাজের ভেতরে নিজেদের আদর্শ ও স্বার্থ প্রতিষ্ঠা করে, যাতে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় রাজনৈতিক পরিচয়ে পরিণত হয়।
 

নাগরিক সমাজ: সম্মতির কারখানা
গ্রামশি তাঁর তত্ত্বে বলেছেন, ক্ষমতা শুধু বলপ্রয়োগ নয়, বরং সম্মতির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। এই সম্মতি তৈরি হয় নাগরিক সমাজের মাধ্যমে যেখানে ক্লাব, মন্দির কমিটি, স্কুল, মিডিয়া, পরিবার, স্থানীয় সংগঠন সবকিছুই শাসক শ্রেণির আদর্শ ছড়িয়ে দেয়। বৈচি গ্রামে ক্লাবের দাদারা যখন পাড়ার ছেলেমেয়েদের ধর্মীয় উৎসবে অংশ নিতে বলে, তখন সেটা শুধু উৎসব নয়,একটা রাজনৈতিক সম্মতির চর্চা। স্কুলের শিক্ষকরা যখন নির্দিষ্ট দলের কথা বলে, তখন ছাত্রদের মনেও সেই দলের প্রতি সম্মতি তৈরি হয়।
এভাবেই নাগরিক সমাজের প্রতিটি স্তরে শাসক দলের চিন্তা, সংস্কৃতি, ধর্ম, ভাষা, ইতিহাস সবকিছু ঢুকে পড়ে। মানুষ নিজের ইচ্ছায়, বিশ্বাসে, স্বপ্নে শাসক শ্রেণির আদর্শকে সত্য বলে মেনে নেয়। ফলে, বলপ্রয়োগ ছাড়াই ক্ষমতা আরও গভীরে গেঁথে যায়—এটাই হেজেমনি।
 

বিজেপি-তৃণমূল: আধিপত্য থেকে হেজেমনিতে
বৈচি গ্রামে বিজেপি ও তৃণমূল—দুই দলই শুধু muscle-power বা প্রশাসনিক ক্ষমতা দিয়ে নয়, বরং ধর্মীয় উৎসব, ক্লাব, পুজো কমিটি, স্কুলের অনুষ্ঠান,এসবের মাধ্যমেই আসল রাজনীতি চালায়। বিজেপি গ্রামের কালীপুজোয় নতুন করে আলোর মালা দেয়, মন্দিরে সংস্কার করে, লোককাহিনির দেবতাদের নিয়ে উৎসব করে। তৃণমূল আবার দুর্গাপুজো, রবীন্দ্রজয়ন্তী, ভাষা দিবস,এসবকে নিজেদের দখলে আনে। এইভাবে দুই দলই গ্রামের মানুষের মন জয় করে, তাদের স্বপ্ন, আশা, বিশ্বাস নিজেদের মত করে গড়ে তোলে। শুধু বাহ্যিক আধিপত্য নয়, বরং মনের গভীরে এক ধরনের সম্মতি গড়ে ওঠে—এটাই গ্রামশির হেজেমনি।
 

পুঁজিবাদী সংকট: মুখোশের আড়ালে
ভারতে পুঁজিবাদী উন্নয়ন মানে অসম উন্নয়ন, ধনী-গরিবের ফারাক, কর্পোরেটের দাপট। বৈচি গ্রামের কৃষক দেখছে তার জমি কর্পোরেটের হাতে চলে যাচ্ছে, শ্রমিক দেখছে কাজ কমছে, ছোট ব্যবসায়ী দেখছে বাজারে বড় কোম্পানির দাপট। কিন্তু এই সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা না করে, শাসক দলগুলো ধর্ম, সংস্কৃতি, জাতীয়তাবাদ,এসব নিয়ে মনোযোগ ঘুরিয়ে দেয়। কেউ বলে, “CAA বা NRC আমাদের পরিচয় রক্ষা করবে”, কেউ বলে, “আমরা বাঙালির স্বার্থ রক্ষা করছি”—আসলে এগুলো পুঁজিবাদী শোষণকে ঢাকতে ব্যবহৃত মুখোশ।
 

পরিবর্তনের গল্প: সহযোগিতার ডাক
বৈচি গ্রামের কিছু তরুণ-তরুণী—রবি, সুমনা, নীলু—মিলে পাঠচক্র শুরু করে। তারা গ্রামশি ও মার্ক্স পড়ে বুঝে, আসল লড়াইটা মানুষের মনের ভেতরে। তারা জানে, শুধু সরকার পাল্টালেই কিছু হবে না—মানুষের চিন্তা, বিশ্বাস, স্বপ্ন, আশা—এসব বদলাতে হবে। তারা ক্লাব, স্কুল, পাড়ায় আলোচনা শুরু করে—“আমরা কেন শুধু নিজের স্বার্থ দেখি? কেন আমরা ভাবি, সহযোগিতা মানে দুর্বলতা? কেন আমরা ভাবি, ধর্ম বা জাতীয়তাই আমাদের আসল পরিচয়?”
 তারা ছোট ছোট গল্প বলে, নাটক করে, গান গায়,যাতে মানুষ বুঝতে পারে, আসল মুক্তি আসে একসাথে লড়ে, একসাথে ভাগ করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে। তারা বলে, “সহযোগিতা মানে শক্তি, বিভাজন মানে দুর্বলতা।”
 

শেষ কথা: মুক্তির চাবিকাঠি
গ্রামশি বলেছিলেন, “নতুন সমাজ গড়তে হলে, আগে নতুন মানুষ গড়তে হবে।” মার্ক্স বলেছিলেন, “শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য ছাড়া মুক্তি নেই।” বৈচি গ্রামের তরুণরা বুঝতে পারে, বিজেপি বা তৃণমূল—যেই ক্ষমতায় থাকুক, তারা নাগরিক সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম,এসবকে ব্যবহার করে তাদের হেজেমনি তৈরি করছে। এই হেজেমনি ভাঙতে হলে, আগে নিজেদের মন, চিন্তা, বিশ্বাস বদলাতে হবে।
 তাদের উপলব্ধি—সহযোগিতা, একতা, বিশ্বাস—এটাই মুক্তির চাবিকাঠি। নতুন সমাজ গড়ার জন্য, আগে নতুন মানুষ গড়তে হবে, আর সেই কাজটা শুরু করতে হবে নিজেদের ভেতর থেকেই।

স্বপ্ননীল মুখার্জী
স্বপ্ননীল মুখার্জী

গবেষক, অর্থনীতি