About Us | Contact Us |

রেয়ার আর্থ মেটিরিয়াল: বস্তুটি আসলে কী, বিশ্ব অর্থনীতিতে এর গুরুত্ব ও প্রভাব

লিখেছেন : সন্তোষ সেন
রেয়ার আর্থ মেটিরিয়াল: বস্তুটি আসলে কী, বিশ্ব অর্থনীতিতে এর গুরুত্ব ও প্রভাব

বিরল খনিজের বিজ্ঞান কথা : রেয়ার আর্থ মেটিরিয়াল বলতে এমন একটি খনিজ উপাদান সমষ্টিকে বোঝায় যেগুলি ভূ-পৃষ্ঠে তুলনামূলক অল্পমাত্রায় পাওয়া যায়। ‘রেয়ার আর্থ’ নামটি শুনলে মনে হয়, এগুলো হয়তো খুবই দুর্লভ বা মহার্ঘ্য কোন পদার্থ। কিন্তু বিজ্ঞান বলছে, নামটির পেছনে রয়েছে এক ঐতিহাসিক ও রসায়নভিত্তিক যুক্তি। উদাহরণস্বরূপ, সেরিয়াম (Ce) পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠে যতটা পরিমাণে পাওয়া যায়, তা তামা বা সিসার থেকেও বেশি। তবে এগুলো প্রকৃতিতে বিচ্ছিন্নভাবে পাওয়া যায় না, বরং একসাথে অনেক উপাদান মিশ্রিত অবস্থায় থাকে। আসলে তাদের আকরিক থেকে বিশুদ্ধ করা অত্যন্ত জটিল, ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। সেই সময়ের স্কেলে এই উপাদানগুলোকে চিহ্নিত  ও পৃথক করার জন্য খুব উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োজন হত, যা তখন দুর্লভ ছিল। আর রসায়নে ‘earth’ (মাটি) বলতে বোঝানো হত এমন কঠিন অক্সাইড পদার্থ, যা তাপ দিলে গলেনা এবং সহজে বিশ্লেষণ করা যায়না। রেয়ার আর্থ উপাদানগুলো মূলত অক্সাইড বা লবণাক্ত অবস্থায় পাওয়া যেত, যেগুলো দেখতে ছিল মাটির মতো। ফলে, এই দুই ধারণার সংমিশ্রণে বিজ্ঞানীরা এসব নতুন উপাদানকে বলতেন “rare earths”. যার অর্থ ছিল –দুর্লভভাবে পাওয়া কঠিন অক্সাইডজাত পদার্থ। বাস্তবত, এগুলো অতীতের তুলনায় এখন আর ততটা দুর্লভও নয়, বরং প্রযুক্তিগতভাবে অপরিহার্য। “Rare Earth" শব্দদ্বয়ের উৎপত্তি মূলত ১৮০০ শতকের শুরুতে, যখন ইউরোপে রসায়নের গবেষণা জোরদার হচ্ছিল। বিজ্ঞানীরা সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও অন্যান্য স্থানে নতুন ধাতু জাতীয় খনিজ আবিষ্কার করতে শুরু করেন। তাঁরা দেখতে পান এই উপাদানগুলো সাধারণ ধাতুর মতো নয়। এগুলো মূলত ছিল কঠিন, ধূসর এবং অক্সাইড জাতীয় পদার্থ। যা সেই সময়কালে সহজে বিশ্লেষণ করা যেত না।

রেয়ার আর্থ উপাদানগুলোর প্রধান খনিজ উৎস হল, Monazite বালি : ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিলে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এবং Bastnäsite –চীন, আমেরিকা ও আফ্রিকায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পাওয়া যায়। বর্তমানে এই উপাদানগুলোর ব্যবহার এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যে আমেরিকা, ইউরোপ, চীন, ভারতের মতো দেশ এগুলিকে কৌশলগত সম্পদ (strategic resource) হিসাবে বিবেচনা করে।  শব্দের মায়াজাল ও বিভ্রান্তি কাটাতে অনেক বিজ্ঞানী ও গবেষক পরামর্শ দিচ্ছেন –রেয়ার আর্থ-এর পরিবর্তে "Critical Minerals" বা "Strategic Materials" শব্দ ব্যবহার করার।

রেয়ার আর্থ মেটিরিয়াল বা বিরল খনিজ  উপাদানের তালিকা:

লাইট রেয়ার আর্থ এলিমেন্টসের মধ্যে রয়েছে ল্যান্থানাম (La), সেরিয়াম (Ce),
প্রাসিওডিমিয়াম (Pr), নিয়োডিমিয়াম (Nd),
প্রোমেথিয়াম (Pm) –কৃত্রিম ও তেজস্ক্রিয়, সামারিয়াম (Sm)। অন্যদিকে হেভি রেয়ার আর্থ এলিমেন্টসের মধ্যে রয়েছে: ইউরোপিয়াম (Eu), গ্যাডোলিনিয়াম (Gd), টের্বিয়াম (Tb), ডিসপ্রোসিয়াম (Dy), হোলমিয়াম (Ho), এর্বিয়াম (Er), থুলিয়াম (Tm), ইটারবিয়াম (Yb), লুটেশিয়াম (Lu), স্ক্যান্ডিয়াম (Sc) এবং 
ইট্রিয়াম (Y)। সর্বমোট এই ১৭টি মৌলিক পদার্থ রয়েছে রেয়ার আর্থ এলিমেন্টসের তালিকায়।

লক্ষ্য করুন সবকটি এলিমেন্টস এর নামের শেষে রয়েছে ‘য়াম’ শব্দ বন্ধ, অর্থাৎ সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি ধাতুর মতো। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। বিরল খনিজ পদার্থগুলো চরিত্রগতভাবে ধাতব প্রকৃতির। মূল রেয়ার আর্থ মেটিরিয়ালের ১৫টি উপাদান ল্যান্থানাইড সিরিজ গোষ্ঠীভুক্ত, এরা f-block    ধাতু। পারমাণবিক পর্যায় সারণির ৬ষ্ঠ পর্যায়ে অবস্থান করে। অন্য দুটি সংযুক্ত উপাদান, স্ক্যান্ডিয়াম ও ইট্রিয়াম d-ব্লক ভুক্ত ধাতু এবং সপ্তম পর্যায়ভুক্ত। এই হল একুন্নে ১৭ খানা। যারা আধুনিক প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সামরিক ক্ষেত্র, তথাকথিত গ্রীন এনার্জী ও ইলেক্ট্রনিক্স জগতের মধ্যমণি।

আধুনিক অর্থনীতিতে রেয়ার আর্থ উপাদানের গুরুত্ব:

প্রথমেই দেখা যাক টেকনোলজি ও ইলেকট্রনিক্স শিল্পে এদের বাড়বাড়ন্ত। স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, টেলিভিশন, ক্যামেরা, LED ডিসপ্লে তৈরিতে বিরল খনিজ মাস্ট। কাকে ছেড়ে, কাকে ধরি? 
রেয়ার আর্থ চুম্বক, যেমন নিয়োডিমিয়াম চুম্বক  (NdFeB) তৈরিই হয় নিয়োডিমিয়াম খনিজ থেকে। মোটর ইন্ড্রাস্ট্রিতে এ নাকি মহারানী। একে ছাড়া বৈদ্যুতিক গাড়ি বা স্কুটার তৈরি সম্ভবই নয়। এই চুম্বক দিয়ে আসলে তৈরি হয় উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন ব্যাটারি। আর নিয়োডিমিয়াম ও ডিসপ্রোসিয়াম, এই দুটি উপাদান ছাড়া ইলেকট্রিক গাড়ির ‘হাই-পারফরম্যান্স মোটর’ তৈরিও সম্ভব নয়।

নবায়নযোগ্য জ্বালানির (Green Energy) মূল রসদ ঐ ‘য়াম’ নামের যত্তসব ইয়াম্মি ইয়াম্মি খনিজ। কোথায় কোথায় লাগে? উইন্ড টারবাইন,
ইলেকট্রিক গাড়ির মোটর, সোলার প্যানেল ও ফুয়েল সেল প্রযুক্তির মালমশলা তৈরিতে। প্রতিরক্ষা ও মহাকাশ প্রযুক্তিতে এই পঞ্চব্যঞ্জনের স্বাদ গ্রহণ করা যাক। জেট ইঞ্জিন, গাইডেড মিসাইল, নানান ধরনের সেন্সর, উপগ্রহ যোগাযোগ ও রাডার প্রযুক্তি জাস্ট মুখ থুবড়ে পড়বে বিরল খনিজ সত্যিকার অর্থে বিরল হয়ে পড়লে। এখানেই ক্লান্ত হয়ে পড়লেন নাকি? আপনার ক্লান্তি, অবসাদ, অবসন্নতা কাটাতেও ধাতব মধ্যমনিরা হাজির। চিকিৎসা প্রযুক্তির জগতে MRI মেশিন (এখন তো কর্পোরেট পরিচালিত, কর্পোরেট শাসিত চিকিত্সা ব্যবস্থায় আমাদের প্রায় সকলকেই এমআরআই এর গহ্বরে মাথা ঢোকাতে হয়), লেজার সার্জারি, আর রাজরোগ ক্যানসার চিকিৎসায় গ্যাডোলিনিয়াম-এর ব্যবহার মোটেই বিরল নয়। 

এককথায় বললে, রেয়ার আর্থ উপাদান হল আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বের অদৃশ্য ভিত্তি। আগামী দশকে সবুজ জ্বালানি, AI, ইলেকট্রিক যানবাহন এবং সামরিক প্রযুক্তিতে এর চাহিদা বহুগুণে বাড়বে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। ফলে রেয়ার আর্থ খনিজ পদার্থ শুধু অর্থনৈতিক নয়, কৌশলগত সম্পদ বলেও বিবেচিত। আর এর হাত ধরেই দখলদারির বাসনা তীব্র হয়ে উঠেছে বাজার নির্ভর পুঁজিবাদী অর্থনীতির জগতে।

বহুল ব্যবহৃত এইসব খনিজ ব্যঞ্জনের ঝোল কাদের কোলে কতটা?

উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণে চীন রয়েছে এক নম্বর স্থানে। বিশ্বের মোট রেয়ার আর্থ উৎপাদনের প্রায় ৭০% নিয়ন্ত্রণ করে চীন। ব্রাজিল রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকা নতুন রেয়ার আর্থ খনির উন্নয়নে কাজ করে চলেছে জোরকদমে। ভারতের মোনাজাইট বালিতে রেয়ার আর্থ পাওয়া যায় কেরালা, ওড়িশা ও তামিলনাড়ুতে। অর্থনীতির ঘোড়াকে লাগাম ছেড়ে ছোটাতে এইসব দেশগুলোর বেলাগাম না হয়ে উপায় নেই। রেয়ার আর্থ উপাদানের রপ্তানিতে সীমাবদ্ধতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে নিষেধাজ্ঞা বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বন্দ্ব হিসেবে হাজির। ফলে এটি একটি রাজনৈতিক হাতিয়ারও হয়ে উঠেছে।

মহা শক্তিধর আমেরিকার দুর্দশা:

ট্রাম্পের নয়া জমানায় শুল্কনীতির কোপে চীনের উপর ১৩৬ শতাংশ শুল্ক চাপানোর ঘোষণায় চীন পাল্টা বাড়তি শুল্ক আরোপ করার পাশাপাশি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রেয়ার আর্থ মেটিরিয়াল আমেরিকায় রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। মহা শক্তিমান ট্রাম্প পড়ে গেলেন মহা সমস্যায়। আমেরিকার ধনকুবেররা আরও বেশি করে সংকটে পড়লেন। তাই ইলন মাস্কদের চাপে ট্রাম্প বাধ্য হলেন চীনের সাথে বাণিজ্য চুক্তিতে বসতে। এই একটি ঘটনা দিয়েই আজকের অর্থনীতিতে বিরল খনিজের সবল উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। আর তাই চীন নির্ভরতা কমাতে মরীয়া মার্কিন প্রশাসন একটার পর একটা পদক্ষেপ নিয়ে চলেছে। 

ইউক্রেন ও গ্রিনল্যান্ডের খনিজ ভান্ডার দখলের বাসনাও একই পথ ধরে। মার্কিন অর্থনীতির টালমাটাল পরিস্থিতি সামলাতে এবং কর্পোরেটদের ব্যবসা বাণিজ্য ও মুনাফার আরও সুযোগ করে দিতেই ইউক্রেনের সাথে খনিজ- চুক্তি করতে চান মহামান্য ট্রাম্প। রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর বিনিময়ে তিনি চান ইউক্রেনের বিপুল খনিজ ভান্ডারের দখলদারি। বলাই বাহুল্য যে, আমেরিকার অর্থনৈতিক চাপ ও যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ করার কৌশলের কাছে জেলেনস্কি আজ না হোক কাল আমেরিকার শর্তেই খনিজ চুক্তিতে সই করতে বাধ্য হবেন।

অন্যদিকে খনিজ ভান্ডারে ভরপুর গ্রিনল্যান্ড  ২০১৯ সালেই কিনে নিতে চেয়েছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গ্রিনল্যান্ড অধিগ্রহণের পরিকল্পনা শুধুমাত্র একটি ‘রিয়েল এস্টেট ডিল’ নয়। পাশাপাশি এটি যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের একটি কৌশলগত পদক্ষেপও বটে। গ্রিনল্যান্ডের অবস্থান উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের মাঝে, আর্কটিক অঞ্চলে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘থুলে এয়ার বেস’  এখানে অবস্থিত। যা রাশিয়া ও চীনের সম্ভাব্য ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শনাক্ত করতে সাহায্য করে। স্বভাবতই গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ পেলে যুক্তরাষ্ট্র আর্কটিকে তার প্রভাব আরও জোরদার করে প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর প্রভাব কমাতে পারবে। এর সাথে শকুনির চোখ গ্রিনল্যান্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর। গ্রিনল্যান্ডের স্তূপীকৃত বরফের নিচে রয়েছে বিপুল পরিমাণে দুর্লভ খনিজ সম্পদ। যেমন: থোরিয়াম, লিথিয়াম, নিওডিমিয়াম, জারকোনিয়াম’র মতো দুর্লভ খনিজ এবং অবশ্যই ইউরেনিয়াম। গ্রিনল্যান্ড অধিগ্রহণের মাধ্যমে এভাবে চীন নির্ভরতা কমাতে চাইছিল বিশ্ব অর্থনীতির হর্তাকর্তা ট্রাম্প সাহেব।

অন্যদিকে, চীন ও রাশিয়া আর্কটিক অঞ্চলে তাদের প্রভাব বাড়াতে সক্রিয়। চীন গ্রিনল্যান্ডে খননকার্য ও অবকাঠামো উন্নয়নে আগ্রহী, যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগের বিষয়। গ্রিনল্যান্ড অধিগ্রহণের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এই প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর প্রভাব কমাতে চায়। এককথায়, বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি, সোলার প্যানেল, তথ্য প্রযুক্তি ও কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের কাঁচামাল যে ভূমিতে মজুদ আছে, তার অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক গুরুত্ব বলে বোঝানোর দরকার হয়না। অন্যদিকে বরফের নিচে বড় মাপের পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ভান্ডার থাকার সম্ভাবনাও আছে। বরফ যত গলবে, তত বেশি করে সেই ভান্ডার নাগালে আসবে। আর সেই পরিমাণে বরফ জমাট বাঁধবে রাজনৈতিক জলচিত্রে। যদিও মার্কিনী এই বাসনার বিরুদ্ধে জল ঢেলেছে গ্রিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, রাশিয়া, চীন সহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। তবুও মরীয়া ট্রাম্প আরও একধাপ এগিয়ে গেলেন। এবার তিনি ডুব দিতে চাইলেন সমুদ্রের তলদেশে

আন্তর্জাতিক নিয়ম উপেক্ষা করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গভীর সমুদ্র-খনন দ্রুত শুরু করতে নির্দেশ দিয়েছেন। শুধু নিজের দেশের সমুদ্র অঞ্চল নয়, অন্যান্য অঞ্চলেও এই কাজের বিস্তার ঘটানোর কথা বলেছেন। আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে চীন এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তবুও সমুদ্রের তলদেশ থেকে খনিজসমৃদ্ধ সামগ্রী ও অন্যান্য মূল্যবান উপাদান সংগ্রহে বিশ্ব নেতৃত্বে উঠে আসার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে ট্রাম্প বাহিনী। তাঁরা যে ‘সাত রাজার ধন মানিক’ এর খোঁজে বেরিয়ে পড়েছেন।

যদিও পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থা ও বিজ্ঞানীরা এই আদেশের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাঁদের মতে –গভীর সমুদ্র খননের ফলে সমুদ্রের জটিল ও অজানা বাস্তুতন্ত্রের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। যা সমুদ্রের কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ ক্ষমতা হ্রাস করে জলবায়ু পরিবর্তনকে নিশ্চিত করেই ত্বরান্বিত করবে। পাশাপাশি সমুদ্রের অতল গহীনে রয়েছে নানান ধরনের মাছ সহ অসংখ্য সামুদ্রিক প্রাণী, প্রবাল, শৈবাল এবং কয়েক কোটি উপকারী অণুজীব। সমুদ্র খননের ফলে যাদের অস্তিত্ব চরম বিপদে পড়বে। বিলুপ্ত হয়ে যাবে প্রচুর প্রাণ ও উদ্ভিদ প্রজাতি। অর্থাৎ  সামগ্রিকভাবে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ধ্বংস প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত হবে, একথা নিঃসন্দেহেই বলা যায়। যদিও কিছু শিল্পপতি ও তাদের সমর্থকদের বক্তব্য –“ মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ সব খনিজসম্পদের ওপর চীনের একচেটিয়া আধিপত্য মোকাবিলার জন্য আমেরিকার নিজস্ব খনিজ-উৎস উন্নয়ন জরুরী।” এটাই আসলে আসল কথা। 


ভারতীয় উপমহাদেশের খনিজ কব্জায় আনতে উদগ্রীব ভারত, চীন ও আমেরিকা:  

হিমালয়ের পাদদেশে বিরল খনিজের উপস্থিতি কতটা কী পর্যায়ে রয়েছে দেখা যাক। হিমালয় পর্বতমালার বিভিন্ন অঞ্চলে এই সম্পদের পরিমাণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য অনেকটা সীমিত হলেও বিজ্ঞানী ও ভূতাত্ত্বিকদের মতে –হিমালয়ের কিছু অংশে মাটির নিচে বা পাহাড়ের পাথরে রেয়ার আর্থ এলিমেন্ট (REE) থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্পদের প্রাপ্যতা এবং উত্তোলন নিয়ে গবেষণা চলছে। মূলত লিথিয়াম, টেলুরিয়াম, নিকেল, কোবাল্ট, স্যামারিয়াম, থুলিয়াম ইত্যাদি খনিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ হতে পারে এই উপাদানগুলো।

১,০০০ কিমি দীর্ঘ হিমালয় অঞ্চলজুড়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে REE থাকার কথা জানিয়েছে চীন। পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব হিমালয়ের অরুণাচল, অসম এবং মেঘালয়ে বিরল খনিজের সম্ভাবনা সর্বাধিক। অরুণাচলের Lodoso অঞ্চলে ২.১৫ মিলিয়ন টন Ferruginous phyllite নামক REE খনিজ পাওয়া গেছে। এর পাশাপাশি পূর্ব কামেং 
ও পশ্চিম সিয়াঙ অঞ্চলে Neodymium সমৃদ্ধ খনিজের নমুনা পাওয়া গেছে। অন্যদিকে অসমের Jashora ও Samchampi alkaline complex-এ খনন শুরু হয়েছে। মেঘালয়ের সাং উপত্যকায় titaniferous bauxite যৌগে REE আছে বলে জানা গেছে। জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (GSI) জানিয়েছে, নিম্ন হিমালয় অঞ্চলের উত্তরাখণ্ড, সিকিম এবং পশ্চিমবঙ্গ উপকণ্ঠে ভ্যানাডিয়াম ভান্ডারের সন্ধান পাওয়া গেছে। ব্যাটারি তৈরি এবং বিভিন্ন অ্যালয় তৈরির ক্ষেত্রে যা অত্যাবশ্যক। এর মধ্যে পুরুলিয়ার কয়েকটি ব্লকে GSI দ্বারা দ্বিতীয় পর্যায়ের অনুসন্ধানের কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে, এখানে ১৪–১৭টি বিরল খনিজ উপাদানের একটি বাস্কেট রয়েছে। বর্তমানে আমাদের দেশে মোট খনিজ অনুসন্ধানের ৫০ শতাংশই বর্তমানে বিরল মৃত্তিকা উপাদানের তল্লাশিতে কাজে লাগানো হচ্ছে। এর থেকেই আর একবার প্রমাণিত হয় যে, এইসব বিরল খনিজের গুরুত্ব বর্তমান অর্থনীতিতে কী বিপুল স্থানে পৌঁছে গেছে। তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে ভারত ৫৪০ টন ‘রেয়ার আর্থ ম্যাগনেট’ আমদানি করেছিল, যার ৮০ শতাংশই এসেছিল চীন থেকে। কিন্তু ২০২৫-এর এপ্রিল থেকে সাতটি রেয়ার আর্থ মিনারেল এবং ম্যাগনেট রপ্তানিতে চীন নিষেধাজ্ঞা জারি করায় ভারত, আমেরিকা সহ অনেক দেশের কর্পোরেট সংস্থাগুলোর ত্রাহি ত্রাহি রব। তাই এবার তারা কোমর বেঁধে নেমেছে। এই প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ভারী শিল্পমন্ত্রী বলেন –“দেশেই বিরল মৃত্তিকা উপাদান উত্তোলন ও তা দিয়ে ‘রেয়ার আর্থ ম্যাগনেট’ তৈরিতে উৎসাহ দিতে দ্রুত ১,৩৪৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ঘোষিত হবে।”

ভারত এবং চীন উভয়ই হিমালয় অঞ্চলে রেয়ার আর্থ মেটিরিয়ালের অনুসন্ধান করছে। কারণ, বর্তমান বৈশ্বিক প্রযুক্তি ও জ্বালানি খাতে এগুলির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। অন্যদিকে মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশ সহ জম্মু কাশ্মীরের বিপুল রেয়ার আর্থ মেটিরিয়াল পাওয়া গেছে। ভৌগোলিকভাবে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ মায়ানমার সংলগ্ন সেন্ট মার্টিন দ্বীপ দখলে নেওয়ার ক্ষেত্রে আমেরিকার আগ্রহ প্রবল। এটি একটি ছোট দ্বীপ হলেও ভারতীয় উপমহাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান ও সামরিক উপস্থিতি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে চীন চাইছে বাংলাদেশ ও মায়ানমারের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করতে। মায়ানমারে এরমধ্যেই চীন সামরিক আধিপত্য স্থাপন করেছে। এবং বিরল খনিজ খননের জন্যই রাখাইন প্রদেশ থেকে রোহিঙ্গা বিতড়ন। 

দুই প্রধান শক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব, তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ আজ ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চলেছে। এক্ষেত্রে একদিকে ভারত ও পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ঝগড়া বিবাদ এবং অন্যদিকে আমাদের দেশের একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শের রাজনৈতিক দল কর্তৃক মানুষে মানুষে ধর্মীয়, জাতপাত বিভাজন বিরোধ তৈরি করে দেশের মধ্যেও হাজারো সমস্যা তৈরি করে রেখেছে। প্রতিবেশী বাংলাদেশও একই পথে তীব্র গতিতে এগিয়ে চলেছে। ঠিক এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রেয়ার আর্থ মেটিরিয়াল দখলের লক্ষ্যে চীন ও আমেরিকা এই উপমহাদেশে যেকোন সময় যেকোন ধরনের অস্থিরতা তৈরিতে মদত জোগাতে পারে। তার কিছু কিছু ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপে। ভারতীয় উপমহাদেশের এই গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল বিষয়ে আমাদের গভীরে ভাবা ও চর্চা করা ভীষণ জরুরী হয়ে পড়েছে।

সন্তোষ সেন
সন্তোষ সেন

বিজ্ঞান ও পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও প্রাবন্ধিক