ভাসানী—মুজিব সম্পর্ক নিয়ে সমাজে অনেক কথন প্রচলিত আছে। এর কিছু সত্য; কিছু আংশিক সত্য; কিছু সত্য—মিথ্যা মিশ্রিত; আর বেশির ভাগই রাজনৈতিক কুটকৌশল সম্বলিত। তাই এ বিষয়ে সঠিক ইতিহাসের জন্য বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। কেননা এই দুই মহান নেতার জীবনের ইতিহাসের পরতে পরতে বাঙালি জাতির সমস্ত অর্জন জড়িয়ে রয়েছে। এক্ষেত্রে এম. আর. আখতার মুকুলের ‘ভাসানী মুজিবের রাজনীতি’, বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকীর 'মওলানা ভাসানীকে যেমন দেখেছি', সৈয়দ আবুল মকসুদের ‘মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী’ এবং শাহ আহমদ রেজার ভাসানী—মুজিব সম্পর্ক নিয়ে প্রকাশিত 'নিবন্ধসমূহ' (জানামতে এ বিষয়ে তিনি বই লিখছেন), মহিউদ্দিন আহমদের 'বেলা—অবেলা' সূত্রপাতের সূত্র হতে পারে। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের পূর্বাপর ভাসানী—মুজিব সম্পর্কের মজবুত ভিত্তি গড়ে ওঠে। ১৯৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলনকে ঘিরে বৈশ্বিক রাজনীতি, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও প্রতিষ্ঠাকালীন আদর্শিক ভিত্তির প্রশ্নে নিরাপোস মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করলেও তাতে মুজিবের সাথে সম্পর্কে খুব একটা প্রভাব পরেনি। বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের প্রতি তিনি বেশ আস্থাশীল ছিলেন। তাই বৃদ্ধ বয়সেও তিনি ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দান করেন। শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত করে আনতে ঘোষণা করেন, “প্রয়োজন হলে ফরাসী বিপ্লবের মতো জেলখানা ভেঙ্গে মুজিবকে নিয়ে আসবো”। ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন বয়কট করেও তিনি মুজিবকে অকুন্ঠ সমর্থন দান করেন। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর ৯ মার্চ পল্টনের জনসভায় তিনি বাংলার আপমর জনসাধারণকে মুজিবের ওপর আস্থা রেখে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবান জানান। মুক্তিযুদ্ধকালীণ মুজিবনগর সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এসব দিক বিবেচনা করলে সহজেই প্রতিয়মান হয় যে, আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে একদিকে মওলানা ভাসানী গণআন্দোলন সৃষ্টি করে পশ্চিম পাকিস্তানী শাষকগোষ্ঠীকে চাপে রেখেছেন; অপরদিকে বঙ্গবন্ধু তাতে রাজনৈতিক ফয়সালার পথে হেঁটেছেন। মুলতঃ আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই দুই মহান নেতার দুইমূখী ভুমিকাই স্বাধীনতা লাভে ক্রিড়নক হিসেবে কাজ করেছে। বাঙালির স্বার্থরক্ষা এবং অধিকার আদায়ের কঠিন সংগ্রামে আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ উত্তরকালেও মওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেছেন। ১৯৫৭ সালে তিনি পৃথক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির্ গঠন সত্ত্বেও জীবনের শেষ অবধি তাঁর প্রিয় মজিবরের প্রতি পক্ষপাতিত্ব ও নির্মোহ সমর্থনের নজির শুধু বাংলাদেশ নয় পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষক এম. আর. আখতার মুকুলের ভাষায়, “তাহলে কি ভাসানী আর মুজিব এই দুই মহান ব্যক্তিত্ব বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর স্বার্থে আজীবন একটি অলিখিত সমঝোতার ভিত্তিতে রাজনীতি করে গেছেন?” উত্তর অবশ্যই খুঁজে নেবে ভবিষ্যত প্রজন্মতবে তার আগে দলীয় দৃষ্টিকোণের উর্ধ্বে উঠে আমাদেরকে নির্মোহভাবে সঠিক ইতিহাস চর্চা ও সংরক্ষণ করতে হবে কেননা আমাদের জাতীয় ইতিহাস আর অর্জনগুলোকে কলঙ্কিত করতে একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবি আর রাজনীতি ব্যবসায়ীরা জাতীয় ঐক্যের সরোবরে বিষ ঢালতে শুরু করেছে। চাটার দলেরা হীন স্বার্থে ইতিহাস বিকৃতির নির্লজ্জ খেলায় মেতেছে। কেউ কেউ তো আবার অতি উৎসাহী হয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের সাথে পিতৃতুল্য মওলানা ভাসানীকে জড়িয়ে কুৎসা রটনা করছে এতে করে কারা লাভবান হচ্ছে তা প্রকৃত দেশপ্রেমিক নাগরিক আর প্রকৃত রাজনীতিবিদদের অনুধাবন করতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, তাই এ বিষয়ে সঠিক ধারণা লাভের জন্য ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড নিয়ে মওলানা ভাসানীর প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখা ও উদ্ধৃতি উল্লেখ করছি:
মওলানা ভাসানী ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট ভোরবেলা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুসংবাদ শুনে পূত্রশোকের ন্যায় শোকে মুহ্যমান ছিলেন। কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর বরাতে জানা যায়, ওই দিন সকালে তিনি অন্যান্য দিনের ন্যায় ফজরের নামাজ শেষে ক্যাম্পাসে (সন্তোষ) পায়চারি করতে বেরুবেন। এরই মধ্যে রেডিওতে ঢাকায় অভ্যুত্থান ও হত্যাকান্ডের ঘোষণা প্রচারিত হচ্ছিল। কেউ একজন তাঁকে খবরটি জানানোর পর তিনি স্তম্ভিত হয়ে যান।
এ প্রসঙ্গে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের তৎকালীন নেতা আতিকুর রহমান সালু বলেন, "১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ঘটনাক্রমে আমি টাঙ্গাইল ছিলাম। ভোর রাতে আমার মেজো ভাইয়ের ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো। এই জানিস, শেখ সাহেবকে তো মেরে ফেলেছে রে! বললাম, বলিস কি? তারপর রেডিওতে খবর শুনে বিস্তারিত জানতে পারলাম। আমি কোনমতে প্যান্ট—শার্ট পড়ে বললাম— আমি সন্তোষে যাচ্ছি হুজুরকে খবর দিতে। সন্তোষে যখন পেঁৗছলাম তখন আকাশটা অনেক ফর্সা। ছনের ছাউনী দেয়া কুঁড়ে ঘরে তিনি নেই। শুনলাম মসজিদে গেছেন। দ্রুত ছুটলাম মসজিদের দিকে। দেখলাম হুজুর নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসছেন। আমাকে দেখেই বললেন, কি খবর? এত সকালে? আমি বিস্তারিত খুলে বলতেই তিনি বললেন— কি বল? রেডিও আনতে বললেন কাউকে। রেডিওতে খবর শুনে আমাকে বললেন একটু দাঁড়াও। বলে আবার মসজিদের ভেতর গেলেন তিনি। প্রায় এক ঘণ্টা পরে বেরিয়ে এলেন তিনি। দেখি তাঁর দু'চোখ অশ্রুসিক্ত। “কত বললাম কিছুতেই শুনলো না। কে যে যুক্তি দিল বাকশাল করার, প্রেসিডেন্ট হওয়ার। বহুদিন আমার সঙ্গে ছিল, আমার সেক্রেটারী ছিল। এমন কর্মী, এমন সংগঠক আমি আর পাই নাই। অনর্গল কথা বলে যাচ্ছেন হুজুর, আর হাতের তসবীহ গুনছেন দ্রুত।" এরপর সারাদিন তিনি পানাহার পর্যন্ত করেননি। কয়েকদিন পর অসুস্থাবস্থায় তাঁকে পিজি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর ১৬ আগষ্ট জেনারেল এম এ জি ওসমানী হেলিকপ্টার যোগে সন্তোষে আসেন এবং মোশতাক সরকারকে সমর্থন জানাতে মওলানা ভাসানীর কাছে বিবৃতির জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু ভাসানী তা দিতে অস্বীকার করলে ২১ আগষ্ট মোশতাক নিজেই তাঁর স্মরণাপন্য হয়ে ভগ্ন হৃদয়ে সন্তোষ ছাড়েন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, "১৭ আগষ্ট কোনো কোনো পত্রিকায় ভাসানীর এক 'তারবর্তা'র বরাত দিয়ে নতুন সরকারের প্রতি তাঁর 'সমর্থন' শীর্ষক যে ক্ষুদ্র খবরটি প্রকাশিত হয় তার সঙ্গে ভাসানীর কোনো সম্পর্ক ছিলো না। সেটি সরকারের পক্ষ থেকেই কেউ প্রচার করে। ভাসানীর নিজেরই ভাষ্য।"
প্রসঙ্গতঃ ওই সময় ইত্তেফাকের কর্ণধার ছিল মানিক মিয়ার জ্যেষ্ঠপুত্র ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন। যিনি বাকশালের বিরোধীতা করে জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন এবং পটপরিবর্তনের পর মোশতাক সরকারকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। ১৭ আগষ্ট ইত্তেফাকে 'জনসাধারণের স্বস্তির নিঃশ্বাস' শিরোনামে নিউজও করেছিলেন।
সম্প্রতি মহিউদ্দিন আহমেদ তাঁর 'বেলা—অবেলা' গ্রন্থে লিখেছেন, "ভাসানী তখন টাঙ্গাইলে গ্রামের বাড়িতে অসুস্থ অবস্থায় ছিলেন। সেখান থেকে তড়িঘড়ি করে তিনি একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দিলেন, এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। রাজনৈতিক মতভিন্নতা সত্ত্বেও পুত্রবৎ শেখ মুজিবের হত্যাকান্ডকে স্বাগত জানানোর ব্যাপারটি সাজানো কেচ্ছা বলে সন্দেহ হয়। নতুন শাসকদের পক্ষে জনসমর্থন আদায়ের জন্য অতি উৎসাহী কোন কর্মকর্তা এ কাজটি করে থাকতে পারেন। ভাসানীর নামে এই বিবৃতিটি দেওয়া হলেও এটা তৈরি করেছিল সরকারের তথ্য দপ্তর এবং বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার মাধ্যমে তা গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়। এর একদিন পরেই ভাসানীকে সরকারি উদ্যোগে ঢাকায় এনে পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। খন্দকার মোশতাক তাঁকে হাসপাতালে দেখতে যান। পত্রিকার প্রথম পাতায় এই সাক্ষাতের ছবি ফলাও করে ছাপানো হয়েছিল।"
একুশে পদক প্রাপ্ত ছড়াকার আবু সালেহ বলেন, "মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবের হত্যাকান্ডের খবর শুনে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ঘটনার কয়েক দিন পর তিনি চিকিৎসার জন্য পিজি হাসপাতালে ভর্তি হন। এ সময়ে খোন্দকার মোশতাক আহমদ তার সরকারী স্টাফদের সাথে নিয়ে হুজুরের সংগে দেখা করেন। সেই বহরে সাবিহউদ্দীন আহমদও ছিলেন। তিনি তখন তার পি আর ও ছিলেন। আমি হুজুরের কেবিন কক্ষেই ছিলাম। এর একটু আগেই ফনি ভূষণ মজুমদার তার কেবিনে ফিরে গেছেন। তিনি দিনে একবার হলেও হুজুরের শরীরের খবর নিতে আসতেন। হুজুরের প্রতি তার শ্রদ্ধা ও ভক্তি দেখে অবাক হয়েছি। কেবিনে ফিরে যাবার সময়ে তিনি আমাকে হুজুরের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে বলতেন। হুজুরের শরীর তখন খুবই খারাপ ছিলো। এখানে আসার আগে তিনি কুমুদিনী হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। খোন্দকার মোশতাক কেবিনে ঢুকলে হুজুর তার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকান। বসতেও বলেননি। এক সময়ে তিনি বলেই ফেললেন "আমার মজিবরকে তোমরা মেরেই ফেললে!" তিনি ক্ষোভের সংগে তাকে আরো বলেন "দুই আনার মুড়ি খেয়ে সারাদিন দলের কাজ করেছে আর তোমরা নেতা হইছো!" রাগ ও ক্ষোভের মাত্রা বাড়তে থাকলে এক সময়ে মোশতাক আমাকে একটু বাইরে যেতে,বলেন। আমি হুজুরের ঔষুধ দিয়ে বরান্দায় এসে দাঁড়াই।"
শাহ আহমদ রেজার মতে, "মোস্তাককে সমর্থন দেয়ার বরাত সরকারী প্রচার মাধ্যম। তখন দেশের পত্রিকার সংখ্যা ছিল ৪টি এবং ৪টিই সরকারী। এ অবস্থায় ১৫ আগস্টের পরপর যখন বিবৃতিটি প্রকাশিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে, তখন সরকারি মালিকানাধীন দৈনিকের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে স্বাভাবিক কারণেই। শুধু তা—ই নয়, মওলানা ভাসানীর কথিত বিবৃতিটি উদ্ধৃত করা হয় ‘বিশ্বস্ত সূত্রের’ বরাত দিয়ে। সততা ও সদিচ্ছা থাকলে বিশেষ দৈনিকটি থেকে সরাসরিই বিবৃতিটি উদ্ধৃত করা সম্ভব ছিল এবং ইতিহাস গবেষণার দৃষ্টিকোণ থেকে তেমনটি করা প্রয়োজনও ছিল। কিন্তু সহজবোধ্য কারণে দৈনিকটির নাম পর্যন্ত বলা হয় না বরং আশ্রয় নেয়া হয় ‘বিশ্বস্ত সূত্রের'।"
প্রবীন রাজনীতিক হায়দার আকবর খান রনো তার 'শতাব্দী পেরিয়ে' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, "আশরাফ গিরানী আমার কাছে তো বটেই, এমনকি প্রকাশ্যেও যে তথ্যটি প্রকাশ করেছেন, তা প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য বলে আমি বিশ্বাস করি। তথ্যটি হল এই রকমঃ ১৯৭৫ সালের ১২ আগস্ট গিরানী বন্দী ভাসানীর একটি চিঠি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে বহন করে নিয়ে যান। চিঠিটির কোন কপি বোধহয় তার কাছে নাই। সে সময় ফটোকপির যুগ শুরু হয়নি আমাদের দেশে। গিরানীর ভাষ্য অনুযায়ী চিঠির ভাষাটি ছিল এই রকম “প্রিয় মুজিব, আমি রাতে এক মিনিটও ঘুমাইতে পারি না। চক্ষু বুজলেই দেখিতে পাই, তোমার মৃত দেহ বহন করিয়া লইয়া যাইতেছে। তোমার চারদিকে দুর্নীতির পাহাড় গড়িয়া উঠিয়াছে। তাই সাবধান হও, সাবধান হও, সাবধান হও।” গিরানীর ভাষ্য অনুযায়ী, ‘সাবধান হও’ কথাটি তিনবার ছিল। উক্ত চিঠিতে ভাসানী মুজিবকে শীঘ্রই সন্তোষে এসে দেখা করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। উক্ত চিঠিতে ভাসানী দেশের সংকটময় পরিস্থিতিতে জাতীয় সরকার গঠনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। চিঠি সম্পর্কে এটাই হচ্ছে গিরানীর ভাষ্য। কিন্তু আমার কাছে একটা খটকা লাগে এই ভেবে যে, যখন বাকশাল নামক এক দলীয় ব্যবস্থা চলছে, অন্য সকল পার্টির্ নিষিদ্ধ, তখন মওলানা ভাসানী কিভাবে জাতীয় সরকারের প্রস্তাব করেন। তবে গিরানীকে আমি খুব ভালো করে চিনি। সে আর যাই হোক, মিথ্যা বানিয়ে বা অতিরঞ্জিত করে বলার লোক নয়।"
তরুণ প্রাবন্ধিক ও রাজনীতিক ফিরোজ আহমেদ এ প্রসঙ্গে তার বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন এভাবেÑ "মওলানা ভাসানীকে নিয়ে কয়েকটা কৌতুহল জাগানো প্রশ্ন পেলাম। একটা প্রশ্ন হলো, ভাসানী ১৫ অগাস্টের হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করেছেন। মোশতাককে সমর্থন দিয়েছেন।
জিজ্ঞেস করলাম, জেনেছেন কোথায়?
তখনকার দৈনিক পত্রিকায়। বড় করে ছাপা হয়েছে তো।
কিন্তু তখন যে চারটা মাত্র পত্রিকা আমাদের খবরের উৎস, সেগুলো তো এর আগেই বাকশাল সরকার সরকারী মুখপাত্র বানিয়ে বাকি সবগুলো পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিলো। মাওলানার প্রতিষ্ঠিত হককথাকে নিষিদ্ধ করেছিল ১৯৭২ সালেই। ফলে মোশতাকের আমলে যে তথ্য আমরা খবরের কাগজসূত্রে পেলাম, সেগুলোর নির্ভরযোগ্যতা কী? কিংবা, এইভাবে গণমাধ্যম কবজা করার পরিনাম যে মানুষের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের সুযোগ এবং অভ্যাস দুটোই বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল বাকশালের মাধ্যমে, চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে, আরো নানান সব নিপীড়নমূলক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে, এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হলো যে দিনেদুপুরে রক্ষীবাহিনীর হাতে খুন হলেও সে খবর আর পত্রিকায় ছাপা হবে না, যে হাতিয়ারগুলো ব্যবহার করেই মোশতাকের মন্ত্রীসভায় লীগের নেতাদের স্বেচ্ছায় কিংবা বলপ্রয়োগে অংশ নেয়ানো হলো, তার নিন্দা কখনো করেছেন?
৯৫ বছরের বুড়ো ভাসানী ১৫ অগাস্টের বহু আগে থেকেই গৃহে অন্তরীণ ছিলেন। এই বয়োবৃদ্ধ মানুষটিকে কারা গৃহবন্দি করে রেখেছিল? তার নিন্দা করেছেন? সেই ঘরে আটকে থাকা, দুনিয়া থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারিতে আটকে রাখা অসুস্থ মানুষটাকে হাসপাতালে মোশতাক দেখতে গিয়েছিলেন, আওয়ামী নেতাদের মত তিনি বঙ্গভবনে গিয়ে মোশতাককে সমর্থন জানান নাই। এই ছবিটিই ফলাও করে পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, এবং পত্রিকাতে বাকি সব যা জানি সেটাও বাকশালের সংস্কৃতিতে কবজা করা পত্রিকার ভাষ্য, ভাসানী কি বলেছেন তা সেখানে কিভাবে মিলবে? ...
তবু ভাসানী কী মনে করতেন, সেটা জানতে ভাসানীর ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বাসযোগ্য মানুষদের কাছেই যেতে হবে। তাদের অনেকের কাছেই শুনেছি, নিজের সমর্থকদের ওপর এত নিপীড়নের পরও, আওয়ামী লীগের এত গণবিরোধী অবস্থানের পরও ভাসানী ১৫ অগাস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে দারুণ ব্যাথা পেয়েছিলেন। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক বিরোধিতা তিনি যতই করুন না কেন, তাকে পুত্রের মতই দেখতেন। প্রতিহিংসাপরায়ন তিনি ছিলেন না, যদিও জনগণের বলপ্রয়োগে গভীর আস্থা পোষণ করতেন। সেই বলপ্রয়োগের স্মরণীয়তম দৃষ্টান্তটার কথাই বরং বলি।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাতেই হয়তো শেখ মুজিবুর রহমানের ফাঁসি হয়ে যেতো বঙ্গবন্ধু উপাধি পাবার আগেই; কেউ তাকে উদ্ধার করার সাহস কিংবা স্পর্ধা দেখায়নি, বন্দি ছিলেন তিনি ঢাকা সেনানিবাসে। '৬৯ এর প্রবল অভ্যূত্থানের ওপর দাঁড়িয়ে ভাসানী হুমকি দিয়েছিলেন পাক সামরিক জান্তাকে: মুজিবকে না মুক্তি দেয়া হলে জনতাকে নিয়ে তিনি ক্যানটনমেন্ট থেকে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসবেন। আগুন ঝরানো মাওলানা তার নাম এমনি এমনি হয়নি।
এই হলো ভাসানী। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের ৫০ বছর পূর্তিতে তার প্রাবল্যকে বুঝতে হলে খুচরো খুচরো প্রশ্ন করে কাজ হাসিল হবে না। অনেক বড় অকৃতজ্ঞতা এবং নিমকহারামি থেকেই ভাসানীকে নিয়ে এই জাতীয় মিথ্যা গুজব মোসাহেবরা ছড়িয়ে থাকে।"
বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক এবিএম মূসা তার 'মুজিব ভাই' গ্রন্থে লিখেছেন, "সত্যিই কি তিনি সেদিন (১৫ই আগস্ট) নিশ্চুপ ছিলেন, কিন্তু কেন? পরবর্তিকালে কোন একদিন তৎকালীন এনএসআই অর্থাৎ জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার প্রধান এ বি এফ সফদার আমাকে জানিয়েছিলেন, মওলানা একটি প্রতিক্রিয়া বা বক্তব্য দিয়েছিলেন। তখনকার বদ্ধ পরিস্থিতিতে মোশতাক সরকার তা প্রচারিত হতে দেননি।
এ্যাডভোকেট গাজীউল হক মওলানা ভাসানীর বক্তব্য থেকে তার জবানীতে বলেছেন, “আমি মুজিবকে বার বার সাবধান করে দিয়েছি। মুজিব তাঁর ছেলে কামালকে পাঠিয়েছিলো আমার কাছে। আমি ওকে বললাম, তোমার বাবাকে বলো সাবধানে থাকতে। ওর অনেক শত্রু। আমি স্বপ্নে দেখেছি, ওর লাশ নিয়ে যাচ্ছে আমার সামনে দিয়ে। কখন কি হয় আল্লাহ জানে।” জীবনের শেষ পনেরো মাস তিনি প্রায় একই অনুভূতি প্রকাশ করেছেন সকলের কাছে। এসবই প্রমাণ করে ভাসানীর নেতৃত্বের বিশালত্ব। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে ওই সময় সন্তোষে গৃহবন্দী করে রেখেছিলেন।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরো কিছু আছে। আসলে এখন এগুলো একত্র করার সময় এসেছে— "বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতারাও তাঁকে গালি দিয়েছিল। তার পক্ষে কথা বলার কেউ ছিলনা কিংবা ভয়ে দেদিন কেউ কথা বলেনি। সেসময় ভাসানী টাঙ্গাইলে গেলে তাকে খুশি করতে সেখানের এক আওয়ামীলীগ নেতা শেখ মুজিবকে গালি দিয়ে কথা বললে ভাসানী তাৎক্ষণিক উপস্থিত জনতার সামনে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল, "চুপ কর, আমার মুজিব নিয়া আরেকটা বাজে কথা বলবেনা।"
আসলে যারা এসব বাজে কথা বলেন তারা বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও ঐক্যের কফিনে পেরেক ঠুকে নিজেদের ফায়দা হাসিল করতে চায়। এবার তোরা খামুস হ।