About Us | Contact Us |

শুধু সঙ্গীতের জন্যই জীবন

শুধু সঙ্গীতের জন্যই জীবন


ঙ্গীত কি শুধু বিলাসিতার উপকরণ?..হালকা আমেজে একটু ফেসবুক লাইভে আসা?অথবা লাইভ কনসার্টে উত্তাল নাচের সাথে সঙ্গীতযাপন?নাকি এর বাইরে এসেও সঙ্গীতের অপর নাম লড়াই।অধিকারের লড়াইয়ে রাস্তায়,স্টেজে,মিছিলে, ফাঁকা পেটেও সঙ্গীত…মনের ভেতরে প্রশ্ন আসে অনেক।পুঁজিবাদের ধারায় বড় বড় রিয়ালিটি শো সঙ্গীতকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে? নাকি তাদের সেলিব্রিটি করে সঙ্গীতের আদিম ধারা শেষ করে দিচ্ছে? ভাবি।ভেবে যাই।
মানুষের যাপনে সঙ্গীত।সঙ্গীত পৃথিবীর কোণায় কোণায় লুকিয়ে আছে।সঙ্গীত সীমাহীন-সীমান্তহীন।সঙ্গীত ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারেন না।খুব কম মানুষই আছেন যারা সঙ্গীত ভালোবাসেন না।

     ঔপনিবেশিক শাসনের প্রথম পর্যায়ে যখন কালো মানুষদের কৃতদাস করে নিয়ে আসা হয়েছিল। দিন শেষে তারাও ফিরে যেত আফ্রিকায়…সেই কালো মানুষগুলোর পরিবার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল,বাড়ি-ঘর কেড়ে নিয়েছিল, কারও কারও জিভ কেটে নেওয়া হত,বিছিন্ন করে দেওয়া হত সকলকে কিন্তু সেই দিন সাম্রাজ্যবাদীরা শত চেষ্টা করে তাদের কাছে সঙ্গীত কেড়ে নিতে পারেনি।তাদের কাতর আর্তনাদ হয়তো জ্যাজ, ব্লুজ,গস্পেল…আমরা কি বাজানোর সময় এইগুলো উপলব্ধি করি?নাকি আমরা শুধু তাদের উপাদান নিয়ে বড় হওয়া শিল্পীদের তাবেদারি করি? আদতে সঙ্গীতকে বা তার ইতিহাসকে ভুলে যাই।

     অনেক সঙ্গীত শিল্পীদের ( বিশেষ করে ব্যান্ড) বড় বড় চুল, কানে দুল অথবা স্রোতের বিপরীতে কিছু দেখতে পাই…কিন্তু প্রশ্ন কি করি কেন এগুলো, কোন ধারা থেকে এই সব জিনিস এসেছে? আমরা কি শুধু অনুকরণ করে যাচ্ছি,ইতিহাস কে অনুসরণ করতে ভুলে যাচ্ছি।সব ধরনের সঙ্গীতের উপর যুগে যুগে আঘাত আসে।আগামী দিনেও আসবে।মৌলবাদ থেকে সাম্রাজ্যবাদ শিল্প, সংস্কৃতিকে আঘাত করে। পৃথিবীর সমস্ত জায়গায় এটা আমরা দেখতে পাই।যেমন সুফি,মুসলিম বিয়ের গানের উপরেও আঘাত আসে প্রতিনিয়ত। কিন্ত আমরা এই সব শিল্পীদের পাশে থাকিনা।আমরা শুধু বাণিজ্যিক ভাবে সফল শিল্পীদের পাশে থাকি।যাই হোক আজ এতো কথা বলার অন্যতম কারণ হল আজ ‘বিশ্ব সঙ্গীত দিবস’। প্রতিটি মিউজিশিয়ান থেকে গায়ক বড় বড় পোস্ট দেবেন, লাইভে আসবেন। আবার অন্যদিকে যারা সারাজীবন সঙ্গীতের জন্য লড়াই করছেন। তারা আজও একই ভাবে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
     এই লড়াই চালিয়ে যাওয়া শুধু বাংলায় নয় গোটা পৃথিবী জুড়ে চলছে।তা সে আজকে আমার কাছাকাছি এলাকার রাফিনা বিবি হোক বা অতীতের মহীন…লড়াই জারি আছে,লড়াই চলছে। যেমন একটা লড়াইয়ের ইতিহাস বলি। তুরস্কের লোকগানের একটি দল ১৯৮৫ সালে তৈরি হয়।সেই কুর্দিশ লোকগানের দলের নাম Grup Yorum…তুরস্কের দোলাচল পরিস্থিতিতে তারা ২৩ টি অ্যালবাম বের করেছেন।কয়েক বছরে তারা বেশ কিছু দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ইতালি,ফ্রান্স,জার্মানি,বেলজিয়াম সহ অনেক দেশে তারা লাইভ শো করেন।কমিউনিস্ট মতাদর্শের এই গানের দল শুধু গানের দল ছিলো তা ঠিক নয়।তাঁরা বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমের সাথেই যুক্ত ছিলেন। ‘তাভির’ নামে একটি ম্যাগাজিন বের করেছেন বহু দিন ধরে। তাঁদের প্রতিটি গান মানুষের জন্য… পুঁজিবাদের বিরোধিতা, রাষ্ট্রের অন্যায়ের সমালোচনা করা। এর ফলেই তুরস্কের ফ্যাসিস্ট সরকার তাঁদের প্রতিটি গান, লাইভ কনসার্ট নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছে।
     ২০১৬ সালের পরে তুরস্কের ফ্যাসিস্ট সরকার এই ব্যান্ডের সকল গান এবং কনসার্ট নিষিদ্ধ করে দেয় মার্ক্সবাদী বিপ্লবী সংগঠন DHKP-C এর সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে। শেষ দুইবছরে তুর্কি পুলিশ ইস্তাম্বুলে ব্যান্ডের কালচারাল সেন্টারে ১০বার অভিযান চালিয়েছে, ভেঙ্গে দিয়েছে তাদের বাদ্যযন্ত্র।বিভিন্ন সময়ে ব্যান্ডের ৭ সদস্য সহ অন্যান্য অর্গানের সদস্যদের গ্রেপ্তারও হতে হয়েছে।কিন্তু লড়াই তাঁরা ছেড়ে দেননি।সঙ্গীত তাঁদের সব কিছু।এই সঙ্গীতের জন্যই তাঁদের দাবি নিয়ে আমরণ অনশনে বসেন। দাবি ছিলো- ব্যান্ডের বিরুদ্ধে যাবতীয় মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।সমস্ত অ্যালবাম,কনসার্টের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে।সকল ব্যান্ড সদস্য সহ সকল রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দিতে হবে।এই দাবি নিয়ে অনশনের প্রায় ২৮৮ দিনের মাথায় হেলেন বুলেক শহীদ হন।হ্যাঁ,শহীদ… শুধু গান ভালোবেসে মৃত্যু… শুধুই সঙ্গীতের জন্য তাজা প্রাণ…কিছু দিনপরে ইব্রাহিম গোসিকও শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।আদতে এরাই সঙ্গীতের যোদ্ধা…শুধু সঙ্গীতের জন্য এতো ত্যাগ। নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন সঙ্গীতের জন্য…এরা অনায়াসে পারতেন সেলিব্রিটি ভাবে জীবনযাপন করতে কিন্তু তা করেননি। এই রকম পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এমন অনেকেই আছেন যারা সঙ্গীতের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।গ্রাম বাংলার অনেক শিল্পী আছেন যাদের গানবাজনা করার জন্য একঘরে করা হয়েছে।আসলে ফ্যাসিস্টদের বিপক্ষে সঙ্গীতের লড়াই আজকের নয়।কয়েকশো বছর আগে থেকেই…তা সে আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলের কৃতদাস হোক বা বাংলার সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ।সামন্ততান্ত্রিক পন্থার বিকল্প গানবাজনা তৈরি হয়েছিল বহু যুগ আগেই(আউল,বাউল,মুর্শিদি,ভাটিয়ালি,জারি,সারি,মর্শিয়া,একদিল পীর,কীর্তন, লেটো,আলকাপ,চারণ, বোলান)…আজকের দিনে যারা এই ধারা বহন করে চলেছে তারাও রিয়েল হিরো…রিয়েল হিরো চৈতন্য,সিরাজ সাঁই,লালন শা,দুদ্দুশা,কবীর,বাবা ফরিদ,নিজামুদ্দিন,মইনুদ্দিন থেকে আজকের দিনে Grup Yorum…আমার ইনকিলাবি খাজা থেকে Yorum সকলকে বিশ্ব সঙ্গীত দিবসে রক্তিম অভিনন্দন ।

মীর রাকেশ রৌশান
মীর রাকেশ রৌশান

কবি,প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী