About Us | Contact Us |

বিগত ১১ বছরে কেন্দ্রের ফ্যাসিস্ট শাসকশ্রেণী সংবিধান প্রদত্ত সমস্ত মৌলিক অধিকার হরণ করেছে

লিখেছেন : ড. শামসুল আলম
বিগত ১১ বছরে কেন্দ্রের ফ্যাসিস্ট শাসকশ্রেণী সংবিধান প্রদত্ত সমস্ত মৌলিক অধিকার হরণ করেছে

বাবাসাহেব আম্বেদকর এবং সংবিধান সভা ভারতীয় জনগনকে যে সাত দফা মৌলিক অধিকার দিয়েছিল, সে সবকে চুরমার করেছে ফ্যাসিস্ট মোদী সরকার বিগত ১১ বছর যাবত। মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য যে সকল রক্ষাকবচ দিয়েছে-

সংবিধান প্রদত্ত রক্ষাকবচ

সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ের প্রায় শুরুতে (১৩ ধারা) বলে দেওয়া হয়েছে যে ১. সংবিধান রচনার আগে যেসব আইনকানুন রয়েছে তা বাতিল হবে মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের কারণে। ২. সবচেযে গুরুত্বপূর্ণ হল যে যদি প্রজাতান্ত্রিক ভারতে যেসব আইন রচিত হচ্ছে বা হবে তাকে অবশ্যই মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সাযুজ্য রাখতে হবে, এবং যদি তা না হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট আইন বাতিল বলে গণ্য হবে। গোলকনাথ বনাম ভারত রাষ্ট্র (১৯৬৭) মামলায় সর্বপ্রথম সুপ্রীম কোর্ট স্পষ্টত এই ঐতিহাসিক রায় দেয় যে, সম্পত্তির অধিকার-সহ কোনও মৌলিক অধিকারকে ৩৬৮ ধারায় (সংবিধান সংশোধনী ধারা) রাষ্ট্র বা রাজ্য কর্তৃক হরণ করা যাবে না। এই রায়ে রেগে গিয়ে তৎকালিন ইন্দিরা সরকার ২৪ তম সংশোধনী এনে ঘোষণা করলো যে, সংসদ মৌলিক অধিকার-সহ যে কোনও ধারাকে সংশোধন করবে যেখানে শীর্ষ আদালতের কোন এক্তিয়ার নেই কোন সংবিধান সংশোধনীকে বাতিল করার। এরপর সুপ্রীম কোর্ট ১৯৭৩ সালে এযাবৎকালের সবচাইতে যুগান্তকারী রায় দিলেন কেশবানন্দ ভারতী বনাম কেরালা মামলায়, যেখানে সুপ্রীম কোর্ট সংসদের এক্তিয়ারের কথা বলে রায় দেন যে, সংসদ কোনও অবস্থাতে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে পরিবর্তন বা সংশোধন করতে পারবে না। সংবিধানের প্রস্তাবনার গণতন্ত্র (নাগরিকের মৌলিক অধিকার যুক্ত), প্রজাতন্ত্র, ন্যায়বিচার, ব্যক্তির মৌলিক স্বাধীনতা, সাম্য, বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা (বিচার পর্যালোচনা) প্রভৃতি হল মৌলিক কাঠামো যাকে পার্লামেন্ট পরিবর্তন করতে পারবে না। প্রকারান্তরে ২৪তম সংবিধান সংশোধনের (যেখানে সরকার পার্লামেন্টকে সার্বভৌম বলেছিল) অবস্থান বাধাপ্রাপ্ত হল কেশবানন্দ মামলায়। এরপর শীর্ষ আদালত মিনার্ভা মামলায় (১৯৮০) রায় দেন যে, বিচার বিভাগের পর্যালোচনা ক্ষমতা হল নিরঙ্কুশ। এই কারণে ইন্দিরা গান্ধীর ৪২তম সংশোধনী পদক্ষেপকে শীর্ষ আদালত কর্তৃক অসাংবিধানিক বলা হয় ঠিক সেই বিপজ্জনক জায়গায় যেখানে ৩৬৮ ধারার সঙ্গে যোগ দেওয়া হয়েছিল যে সংসদই সার্বভৌম যার এক্তিয়ারে সুপ্রীম কোর্ট থাকবে না। এর প্রেক্ষিতে আদালত আবারও বলেন যে, পার্লামেন্টের ক্ষমতা সীমাবদ্ধতা এবং বিচারব্যবস্থার পর্যালোচনা-এ দুটিও হল মৌলিক কাঠামো। এই রায়ের পর ২০১৩ সাল পর্যন্ত কোনও কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রীম কোর্টকে চ্যালেঞ্জ জানায়নি। সম্প্রতি উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনকর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাখঢাক না করে মন্তব্য করে বলেন যে সুপ্রীম কোর্ট সার্বভৌম নয়, বরং পার্লামেন্ট সার্বভৌম। অর্থাৎ নাৎসীবাদী সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদকে তিনি নকল করলেন। বিচারবিভাগীয় পর্যালোচনা (Judicial Review) কে তিনি বাড়াবাড়ি বলতে কসুর করেনি। এটার ১৮০ ডিগ্রি বিপরীতে সম্প্রতি দেশের মহামান্য প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না সোজাসুজি জানিয়ে দিলেন যে পার্লামেন্ট বা সুপ্রীম কোর্ট নয়, বরং সার্বভৌম হল সংবিধান যার ব্যাখ্যা করা এবং জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা করার দায়িত্ব হল সংবিধানের অভিভাবক স্বয়ং সর্বোচ্চ আদালতের।

চ্যালেঞ্জের সূত্রপাত অবশ্য হয়েছিল বাজপেয়ী আমলে যেখানে ওই সরকার নাগরিকতার নতুন আইন (NRC, NPR) চালু করে বৃহৎ জনগোষ্ঠী-সহ মাইনরিটি, দলিত, আদিবাসী এবং সর্বোপরি শ্রমজীবী জনতার নাগরিকত্ব হরণ করা হয়েছে উদ্ভট কতগুলো শর্ত চাপিয়ে- যা ব্যাপক জনগণ পূরণ করতে পারবে না, যথা পূর্বপুরুষের জমির রেকর্ড, জন্ম সার্টিফিকেট, জন্মস্থান সার্টিফিকেট প্রভৃতি। ২০১৪ সাল থেকে মোদী সরকার সমস্ত বৈধ নাগরিকের জীবনের অধিকারকে (২১ ধারা) হরণ করতে এগিয়ে আসে যার নিকৃষ্টতম সংস্করণ হল ২০১৯ সালের CAA নামক ফ্যাসিস্ট আইন। যেখানে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের বাদ রেখে অন্য ছয় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষদের বৈধতা নিশ্চিত করার কথা বলা হল। যার প্রতিধ্বনি শোনা গেছে গত লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদী সংখ্যালঘু সমস্ত মানুষকে অনুপ্রবেশকারী বলে দেগে দেওয়ার মধ্য দিয়ে।

মৌলিক অধিকার আজ ভুলুণ্ঠিত

শুধু রাজবন্দী কয়েক হাজার সারা দেশে যাদের অপরাধ হল তারা মোদী জমানার সমালোচক। ১৯ ধারার বাক স্বাধীনতাকে নৃশংসভাবে হরণ করল। একনায়কতন্ত্রী জমানায় দু'তিনটি মাত্র দৃষ্টান্ত তুলে ধরলে দেখা যাবে, ২০১৮ সালের গোড়ায় ভীমা কোঁরেগাঁওতে ১৬ জন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীকে অনির্দিষ্টকাল আটক রাখা হল কালা কানুন ইউএপিএ-তে- মোদীকে হত্যার ষড়যন্ত্রের মিথ্যা মামলায়। ২০২০তে দিল্লি দাঙ্গায় দাঙ্গাবাজেরা অবাধে বিচরণ করলেও কোপ এসে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদী ছাত্রদের উপর, যার মধ্যে প্রায় পাঁচ বছর যাবত ইউএপিএ-এর ছোবলে আটকে আছেন ড. ওমর খালিদ, সার্জিল ইমাম প্রমূখ। এরও আগে সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান। হাতরাসের গনধর্ষণ ও পুড়িয়ে মারার ঘটনার খোঁজখবর করতে গেলে তাকেও ইউএপিএতে আটক রাখা হল সাড়ে তিন বছর যাবত। পহেলগাঁও-র জঙ্গী হামলার ক'দিন বাদে কালাকানুনে আটক করা হল অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রধান ড. আলি মাহবুদাবাদকে। বলা বাহুল্য, এই নিরাপরাধ প্রথিতযশা অধ্যাপকের অপরাধ ছিল এটা যে তিনি দাবি করেছিলেন রাষ্ট্র ও সরকার যেন সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেয়।

২০২২ সালে মোদী জমানা আদিবাসীদের জল জঙ্গল জমির অধিকার কেড়ে নিয়ে সেগুলি আদবানী আম্বানী-সহ কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিয়েছে খনিজ সম্পদ লুঠ করার লক্ষ্যে। ঠিক একইভাবে ২০২৪ সালে মোদীরাজ সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওয়াকফ রক্ষণাবেক্ষণের (২৬ ধারা) অধিকারকে কেড়ে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে আদানী আম্বানী এবং বিদেশি বহুজাতিক সংস্থাকে দিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। এমনকি সুপ্রিম কোর্টে ওয়াকফ আইন সংক্রান্ত মামলা মুলতুবি রাখা অবস্থাতেও মোদীরাজ বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে যার নির্দেশিকা হল। রেজিস্টর্স্টশেন না করার অজুহাতে প্রায় ৯ লাখ ওয়াকফ এস্টেট এবং লাখ লাখ বিঘায় বিস্তৃত মসজিদ- দরগা-ঈদ গাহ-এতিম খানা- দাতব্য স্কুল-মাদ্রাসাকে আত্মসাৎ করে দেশীবিদেশী কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া। এটা শুধু সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি অবমাননা তাই নয়, এটা একদিকে যুক্তিসংগত শ্রেণীবিভাগ না করা এবং অপরদিকে, ১৪,১৯,২১ ধারার মধ্যেকার ন্যায়বিচার হরণ করা। সুপ্রীম কোর্ট যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন মানেকা গান্ধি বনাম ভারতরাষ্ট্র মামলায় যেখানে আদালত স্পষ্টত বলে দিয়েছে যে ন্যায়বিচারের বিরোধী কোনও সংসদীয় আইন পাশ হলে তা বাতিল হবে। আদালত উক্ত তিনটি ধারাকে সোনালি ত্রিভুজ আখ্যা দিয়েছেন। যার আলোকে পরবর্তীকালে শীর্ষ আদালত জীবন, ব্যক্তি স্বাধীনতা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কাজ, পরিবেশ প্রভৃতি অধিকারকে ২১ ধারার মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত করার পথনির্দেশ দিয়ে রাখলেন। কিন্তু ফ্যাসিস্ট রাজ সোনালি ত্রিভুজকে ছাইগাদায় নিক্ষেপ করেছে।

এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হল ক) কৃষকরা ঐতিহাসিক লড়াই করে যে তিন দানবীয় আইনকে প্রত্যাহার করতে সরকারকে বাধ্য করেছিল, সেই আইন পেছন দরজা দিয়ে আনা হয়েছে যা কৃষি বিপননকে আদানী-আম্বানীদের ফাটকা পুঁজির স্বর্গ করে তুলবে। এই লক্ষ্যে কেন্দ্র কৃষিপণ্যের নূন্যতম সহায়ক মূল্য ধার্য করছেন। স্বামীনাথন কমিশনের পুরোপুরি খেলাপ। পাশাপাশি মোদী জমানার গত ৮ বছরে এক লক্ষাধিক কৃষক আত্মহত্যা করেছে ঋণশোধ করতে না পেরে। এটা ২১ ধারার জীবনের অধিকারকে উপহাসে পরিণত করেছে। তাইতো দেখা যাচ্ছে মোদী জমানায় প্রায় ১৪ কোটি কৃষক কৃষিকাজ থেকে সরে এসেছেন। ৩৫ কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে নেমে গেছেন। সব মিলিয়ে কৃষি উৎপাদন গভীর সঙ্কটে পড়বেই যার পরিণামে প্রায় তিন কোটি খেতমজুর এবং ৩৫ কোটি গরীব মানুষ জীবনের অধিকার (২২ ধারা), পেশার অধিকার (১৯ ধারা) বিলুপ্তির পথে ধাবিত হবে। এই কারণেই ভারত ক্ষুধার সূচকে বাংলাদেশ, নেপাল প্রভৃতি প্রতিবেশী দেশের পেছনে। ১০০ কোটির বেশি মানুষের অপুষ্টির হাহাকার জীবন জীবিকার গভীর সংকটের ইঙ্গিতবাহী। প্রসঙ্গত, জীবনের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে প্রায় ৬ কোটি পরিযায়ী শ্রমিক শুধু ডিক্টেটর মোদীর লাগাম ছাড়া লকডাউনের কারণে। এছাড়া ২৯ কোটি অসংগঠিত শ্রমিক যারা জিডিপির ৪৫ শতাংশের উৎপাদক, অথচ তারা সমস্ত সামাজিক বীমা থেকে বঞ্চিত। এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, এই বঞ্চনা জীবন ও কাজের মৌলিক অধিকারকে কেড়ে নেবার সূচক এবং সংবিধানের চতুর্থ অধ্যায়ের ৩৯ ধারাকে চূড়ান্ত অবজ্ঞা করছে। অথচ এই অধ্যায়ে বর্ণিত সমস্ত ধর্মীয় সম্প্রদায়কে নিয়ে অভিন্ন পরিবার বিধি তৈরিতে মরীয়া এই সরকার। যার লক্ষ্য হল এক দেশ-এক ধর্ম-এক ভাষা-এক নেতা-একদল ভিত্তিক মনুবাদী মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র গঠন করা।

ঋণ : সোশাল জাস্টিস

ড. শামসুল আলম
ড. শামসুল আলম

প্রাবন্ধিক