About Us | Contact Us |

লক্ষ্যভেদী

লক্ষ্যভেদী


নির্বাচনের আগে ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ নির্বাচন কমিশনের একটি নিয়মিত কার্যক্রম। সেই অনুযায়ী, আসন্ন অক্টোবর মাসে বিহার রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা থাকায়, কমিশন একটি ব্যাপক অভিযান চালিয়ে ভোটার তালিকাগুলোর সংশোধন কাজ সম্পন্ন করেছে। গত মাসে রাজ্যের সব বিরোধী রাজনৈতিক দলকে আস্থায় নিয়ে এই প্রক্রিয়ার জন্য ১৮টি পয়েন্টে সম্মতি গৃহীত হয়েছিল। অথচ, হঠাৎ করেই, যেগুলোর মধ্যে উপরের ১৮টি বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই, তার ভিত্তিতে কমিশন ২৪ জুন একটি নির্দেশিকা জারি করে জানায় যে, রাজ্যের সমস্ত সংশোধিত ভোটার তালিকা বাতিল করে আগামী এক মাসের মধ্যে "বিশেষ নিবিড় পুনঃপর্যালোচনা" (Special Intensive Revision - SIR) করে নতুন ভোটার তালিকা প্রস্তুত করতে হবে।

প্রখ্যাত সমাজকর্মী ও নির্বাচন বিশ্লেষক যোগেন্দ্র যাদবের মতে, এই ফতোয়া কেবল বিস্ময়কর বা নজিরবিহীন নয়, বরং এটি কার্যকর করা প্রায় অসম্ভব এবং গণতান্ত্রিকতাবিরোধীও বটে। এর আগে দুর্নীতির নামে নোটবন্দি, তারপর লকডাউনের সময় দেশব্যাপী অবরুদ্ধতা, আর এখন নির্বাচনী তালিকায় নবনিবন্ধনের নামে বহু মানুষকে ‘তালাবন্দি’ করার মতো পদক্ষেপ। রাজ্যের বিরোধী দলগুলো তো একে নির্বাচন কমিশনের বড় কেলেঙ্কারি বলেই দাবি করছে।

২০০৩ সালে, যথাযথভাবে পূর্ব ঘোষণা দিয়ে, নির্বাচনের প্রায় এক বছর আগে ভোটার তালিকার এই ধরণের নিবিড় পর্যালোচনা সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু এবার দিল্লির কমিশনের কর্মকর্তারা ২৪ জুন একটি ১৮ পাতার নির্দেশিকা জারি করেন এবং ২৫ জুন থেকে ২৫ জুলাই—এই এক মাসের মধ্যে এই কাজ শেষ করার এক অসম্ভব সময়সীমা নির্ধারণ করেন। সাধারণত, ভোটার তালিকা সংশোধনের সময় তাতে গবেষণা বা অনুসন্ধান করা হয় না; বরং কেবল তালিকা আপডেট করা হয়। এবার অবশ্য পূর্ববর্তী তালিকা সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে সম্পূর্ণ নতুন তালিকা তৈরির নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এছাড়া, আগে যেখানে ভোটার নিবন্ধনের দায়িত্ব ছিল সরকারের, এবার সেই দায়িত্ব ব্যক্তিগত নাগরিকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিবন্ধনের সময় প্রথমবারের মতো প্রমাণপত্র জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা না করেই সরকার হঠাৎ করে এই নির্দেশিকা জারি করেছে।

২৪ জুন দিল্লির এই নির্দেশিকামতে, ২৫ জুন থেকেই শুরু হয়ে যায় ফর্ম ছাপা, ব্লক স্তরে হাজার হাজার কর্মীর প্রশিক্ষণ, প্রতিটি বাড়িতে ফর্ম পৌঁছে দেওয়া, কেউ বাড়িতে না থাকলে তিনবার গিয়ে চেষ্টা করা, ব্লক স্তরে রাজনৈতিক দলের এজেন্ট নিয়োগ, তাদের প্রশিক্ষণ, ঘরে ঘরে থেকে ফর্ম সংগ্রহ এবং পরে তা কম্পিউটারাইজ করার মত কাজ—সবকিছুই করতে হবে ২৫ জুলাইয়ের মধ্যে! এক মাসে এত বিশাল কাজ সম্পূর্ণ করার এই অসম্ভব সময়সীমা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের ইশারায় কমিশনের কিছু কর্মকর্তার মাথা থেকে বের হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এখানে মনে রাখতে হবে, কমিশনের পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে ভোটার তালিকার যাচাই করা উচিত—এতে আপত্তি নেই। তবে, এবার যে অযৌক্তিক এবং অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কাজটি বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেটাই জনগণের বিরোধিতার মুখে পড়েছে।

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো—যাদের নাম নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই, তাদেরও এই ফর্ম পূরণ করতে হবে। যেমন, যদি ২০০৩ সালের তালিকায় আপনার নাম থাকে এবং একই নামে ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসের তালিকায়ও আপনার নাম থাকে, তাহলেও আপনাকে ফর্ম পূরণ করতে হবে। নিজের সাম্প্রতিক ছবি ও ২০০৩ সালের তালিকায় আপনার নাম যে পাতায় আছে সেই পাতার ফটোকপিও জমা দিতে হবে।

যাঁদের নাম ২০০৩ সালের তালিকায় থাকা উচিত ছিল, কিন্তু হয়নি—তাদেরও নবনিবন্ধনের সময় জন্মস্থান ও জন্মতারিখের প্রমাণপত্র জমা দিতে হবে। যাদের বয়স ২০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে, তাদের নিজেদের এবং মা-বাবার অন্তত একজনের প্রমাণপত্র জমা দিতে হবে। আর যাদের বয়স ২০ বছরের নিচে, তাদের নিজেদের এবং মা-বাবা উভয়ের জন্মস্থান ও জন্মতারিখের প্রমাণ দিতে হবে। যদি মা-বাবার নাম ২০০৩ সালের তালিকায় থাকে, তবে সেটি প্রমাণ হিসেবে চলবে; তবে নিজের প্রমাণপত্র জমা দিতেই হবে।

কমিশনের যেসব প্রমাণপত্র গ্রাহ্য বলে বিবেচিত, তার মধ্যে বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের কাছে নেই। উদাহরণস্বরূপ: বিহারে প্রায় ৮৮ শতাংশ মানুষের কাছে থাকা আধার কার্ড, আয়কর প্যান কার্ড, ভোটার আইডি কার্ড, রেশন কার্ড বা এমজিএনআরইজিএ জব কার্ড—এই সবকিছুই অগ্রহণযোগ্য। অথচ কমিশন যেসব ১১টি প্রমাণপত্রকে গ্রহণযোগ্য বলেছে, তার মধ্যে অনেকগুলো বিহারে সচরাচর পাওয়া যায় না। উদাহরণস্বরূপ—পাসপোর্ট (২.৪%), জন্ম সনদ (২.৮%), সরকারি চাকরি বা পেনশনধারীদের পরিচয়পত্র (৫%), জাতি সনদ (১৬%)। শুধুমাত্র মাধ্যমিক পাস সার্টিফিকেটই প্রায় ৫০% মানুষের কাছে রয়েছে। এই তালিকা স্পষ্ট করে দেয় যে, যাঁরা শিক্ষিত ও চাকুরিজীবী, কেবল তাঁরাই সহজে এই প্রমাণপত্র দিতে সক্ষম হবেন। যাঁরা শিক্ষার সুযোগ পাননি—বিশেষত নারী, স্থানান্তরিত শ্রমিক, গ্রামীণ দরিদ্র, দলিত, আদিবাসী ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর মানুষেরা—তাঁরা এই প্রক্রিয়ায় পিছিয়ে পড়বেন এবং চিরতরে ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়ার ঝুঁকিতে থাকবেন।

সংবিধান রচনার সময় শিক্ষাকে ভোটাধিকার পাওয়ার শর্ত করা হয়নি। অথচ এখন সেটিকেই চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এটা যেন একধরনের কৌশলে নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়ারই প্রচেষ্টা।

এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাস্তবে "ঘুষপেটিয়া" বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে, বিশেষ করে মুসলিমদের। অথচ তাদের অধিকাংশ এই দেশেরই নাগরিক। এই প্রক্রিয়ায় কার্যত NRC বা নাগরিকপঞ্জি চাপিয়ে দেওয়ার পথ সুগম করা হচ্ছে।

মূল লেখাটি হিন্দি ভাষায়। বাংলায় অনুবাদ করেছেন পাশারুল আলম।

ড. সঞ্জয় মঙ্গলা গোপাল
ড. সঞ্জয় মঙ্গলা গোপাল

শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী