ন্যায়বিচারের মুখোশে পক্ষপাতের ছায়া:
ভারতের সংবিধান তার প্রতিটি নাগরিকের জন্য ন্যায়বিচার, সমতা এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনের অধিকারের প্রতিশ্রুতি দেয়। তবু, এই ঘোষণার পেছনে একটি করুণ বাস্তবতা লুকিয়ে আছে—বিশেষ করে মুসলিম সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে। সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে মুসলিম যুবকদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে চলা বিচার-প্রহসনের ইতিহাস শুধু আইনি ব্যর্থতার গল্প নয়, বরং এটি রাষ্ট্রযন্ত্র, পুলিশি স্বেচ্ছাচারিতা, গোদি মিডিয়ার একপেশে প্রচারণা এবং সমাজের গভীর পক্ষপাতের সম্মিলিত প্রকাশ। ২০২৫ সালের ২১ জুলাই বম্বে হাইকোর্টের এক ঐতিহাসিক রায়—২০০৬ সালের মুম্বাই লোকাল ট্রেন বিস্ফোরণ মামলায় ১২ জন মুসলিম যুবকের খালাস—এই অন্ধকার ইতিহাসের একটি নগ্ন প্রমাণ। এই রায় আমাদের প্রশ্ন তুলা ধরার সময় ও সুযোগ করে দিয়েছে।
ভারতের বিচারব্যবস্থা কতটা নিরপেক্ষ?
একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রে এই বিচারহীনতা আর কতদিন চলবে? এই প্রশ্ন আজ দেশের সেক্যুলার শক্তিকে ভাবিয়ে তুলেছে।
মুম্বাই ট্রেন বিস্ফোরণ: একটি প্রহসনের ১৯ বছর
২০০৬ সালের ১১ জুলাই মুম্বাইয়ের সাতটি লোকাল ট্রেনে ধারাবাহিক বিস্ফোরণে ১৮৭ জন প্রাণ হারান, ৮২৪ জন আহত হন। এই ভয়াবহ ট্র্যাজেডি মুম্বাইয়ের হৃদয়ে গভীর ক্ষত তৈরি করে। তদন্ত শুরু হয় মহারাষ্ট্রের অ্যান্টি-টেররিজম স্কোয়াডের (ATS) নেতৃত্বে। তবে, তদন্তের লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে মুসলিম যুবকরা। পাকিস্তানের আইএসআই, ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন—এই নামগুলোর ছায়ায় ১৩ জন মুসলিম যুবককে গ্রেফতার করা হয়। তাঁদের জীবন, স্বপ্ন, পরিবার—সবকিছু যেন সন্দেহের তালিকায় পরিণত হয়।
২০১৫ সালে বিশেষ আদালত পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং সাতজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। মিডিয়ায় এই রায়কে 'সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা' হিসেবে উদযাপন করা হয়। কিন্তু ২০২৫ সালে বম্বে হাইকোর্টের রায় এই মুখোশ খুলে দেয়। আদালত স্পষ্ট জানায়: মামলায় প্রমাণ ছিল না, স্বীকারোক্তি পুলিশি নির্যাতনের মাধ্যমে আদায় করা হয়েছিল, বিস্ফোরকের প্রকৃতি নির্ধারণে ব্যর্থতা ছিল, এবং সাক্ষীদের বয়ান ছিল অবিশ্বাস্য। আদালতের ভাষায়, “এই মামলার ভিত্তিই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।” ১৯ বছর একটি যুবকের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়। এই সময়ে পরিবার ভেঙে যায়, স্বপ্ন মুছে যায়, সম্মান ধূলিসাৎ হয়। কিন্তু এই ১৯ বছরের অপমান কে ফিরিয়ে দেবে?
বিচার-প্রহসনের ধারাবাহিকতা:
মালেগাঁও থেকে হাসিমপুরা মুম্বাই ট্রেন বিস্ফোরণ মামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি একটি ধারাবাহিক প্যাটার্নের অংশ, যেখানে মুসলিম যুবকরা সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে সহজ লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে। ২০০৬ মালেগাঁও মসজিদ বিস্ফোরণে ৪০ জন নিহত হন। এটিএস নয়জন মুসলিম যুবককে গ্রেফতার করে, তাঁদের 'জিহাদি' তকমা দিয়ে হাজতে পাঠায়। দশ বছর পর, ২০১৬ সালে এনআইএ প্রকাশ করে, এই হামলার পেছনে ছিল হিন্দু জঙ্গি সংগঠন। অভিযুক্তরা মুক্তি পান, কিন্তু তাঁদের জীবনের দশটি বছর আর ফিরে আসেনি।
২০০১ সালের সুরাট সিমি মামলায় ১২৭ জন মুসলিম ছাত্র-যুবককে গ্রেফতার করা হয়, শুধুমাত্র একটি সেমিনারে অংশ নেওয়ার 'অপরাধে'। ২০২১ সালে, ২০ বছর পর, আদালত জানায়, এই মামলায় কোনো প্রমাণ ছিল না। ১৯৯৪ সালে ভুসাওয়ালের জামিল আহমেদ খানের ক্ষেত্রে ১১ জন মুসলিম যুবককে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিশোধ নেওয়ার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। ২৫ বছর পর, ২০১৯ সালে তাঁরা খালাস পান। ১৯৯৬ সালের রাজস্থানের সমলেটি বিস্ফোরণ মামলায় ছয়জন মুসলিম, যাঁদের মধ্যে পাঁচজন কাশ্মীরি, ২৩ বছর কারাগারে কাটান। ২০১৯ সালে তাঁরা নির্দোষ প্রমাণিত হন।
সবচেয়ে নৃশংস উদাহরণ হাসিমপুরা গণহত্যা। ১৯৮৭ সালে উত্তরপ্রদেশের মিরাটে পুলিশ ৪২ জন মুসলিম যুবককে গুলি করে হত্যা করে। ২৮ বছর পর, ২০১৫ সালে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা 'প্রমাণের অভাবে' খালাস পান। এই ঘটনাগুলো শুধু সংখ্যা নয়—এগুলো হারানো যৌবন, ভেঙে পড়া পরিবার, এবং অপূরণীয় মানসিক আঘাতের গল্প।
রাষ্ট্র, মিডিয়া ও সমাজের ভূমিকা:
মিডিয়ার বিষবৃক্ষ ও তার ফল ডালে ডালে, পাতায় পাতায় ভরে গেছে। মুসলিম মানেই 'সন্দেহ'
১৯৯৩ সালের মুম্বাই বিস্ফোরণের পর থেকে ভারতীয় মিডিয়া একটি বিষাক্ত আখ্যান তৈরি করে: 'ইসলামিক টেরর'। 'ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন', 'সিমি', 'আইএসআই এজেন্ট'—এই শব্দগুলো মিডিয়ার মুখে মুখে ঘুরতে থাকে। ২০০০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এই অপপ্রচার তার চরমে পৌঁছায়। মুসলিম যুবকদের 'সন্ত্রাসবাদী' তকমা দেওয়া যেন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়ায়। এই একপেশে প্রচারণা শুধু ব্যক্তির জীবন নয়, গোটা সম্প্রদায়কে সন্দেহের চোখে দেখার সংস্কৃতি তৈরি করে। এই প্রচারণার রাজনৈতিক ফসল কাটে উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তি, যারা মুসলিমদের 'জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি' হিসেবে চিত্রিত করে সামাজিক বিভাজনকে আরও তীব্র করে। মুসলিম সমাজ এই বিষয়ে প্রতিকার ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। তার কারণ কিছু কিছু মুসলিম, সমাজ বর্হিভূত ক্রিয়াকর্মের যুক্ত থাকে। তাদেরকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিজের কাজে ব্যবহার করে। তার দায় সমগ্র মুসলিম সমাজের উপর বর্তায়। এরা শুধু ভোট ব্যাংকের রাজনীতির শিকার হয়।
পুলিশ ও রাষ্ট্রযন্ত্র:
সহজ লক্ষ্যের খেলার শিকার একটি সম্প্রদায়।পুলিশি তদন্তে একটি প্যাটার্ন স্পষ্ট । সন্ত্রাসবাদের মামলায় মুসলিম যুবকদের সহজ লক্ষ্যবস্তু করা। অমানবিক নির্যাতন, জবরদস্তিমূলক স্বীকারোক্তি, জাল প্রমাণ গড়ে তোলা—এগুলো যেন তদন্তের আদর্শ পদ্ধতি হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক চাপে দ্রুত 'সমাধান' দেখানোর তাগিদে প্রকৃত তদন্ত উপেক্ষিত হয়। আসল অপরাধীদের ধরার পরিবর্তে মুসলিম যুবকদের বলির পাঁঠা বানানো হয়। এই প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রযন্ত্রের ভূমিকা শুধু নিষ্ক্রিয় নয়, প্রায়শই সক্রিয়ভাবে পক্ষপাতমূলক।
ধ্বংসের মূল্য:
ব্যক্তি ও সমাজের ক্ষতি, এই মামলাগুলোর প্রভাব শুধু আইনি নয়, গভীরভাবে সামাজিক ও মানবিক। ডা. ফারুখ মাগদুমি, মালেগাঁও মামলার অভিযুক্ত, এক সময়ের সম্ভাবনাময় চিকিৎসক। দীর্ঘ কারাবাস তাঁর পেশা, আর্থিক স্থিতি এবং সামাজিক মর্যাদা ধ্বংস করে দেয়। মোহাম্মদ আব্দুল হাই, সুরাট সিমি মামলার শিকার, সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে মশলা বিক্রেতা হয়ে বেঁচে আছেন। হাসিমপুরা গণহত্যার ৪২ নিহতের পরিবার ২৮ বছর ধরে বিচারের অপেক্ষায় প্রজন্ম হারিয়েছে। এই ব্যক্তিরা শুধু কারাগারে সময় কাটাননি; তাঁদের পরিবার, সম্মান, এবং মানসিক স্বাস্থ্য চিরতরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকে মানসিক ট্রমা, দারিদ্র্য, এবং সামাজিক বহিষ্কারের শিকার। এই ক্ষতি কেবল ব্যক্তির নয়, একটি সম্প্রদায়ের উপর রাষ্ট্র-সমর্থিত উৎপীড়নের নিদর্শন।
মানবাধিকারের দাবি:
শূন্য বাস্তবায়ন থেকে গেছে, মানবাধিকার সংগঠনগুলো—যেমন PUCL, Amnesty International, এবং Human Rights Watch—বারবার এই বিচার-প্রহসনের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। তাঁরা দাবি করেছে, ক্ষতিপূরণ, দায়ী পুলিশ ও তদন্তকারীদের শাস্তি, এবং স্বচ্ছ তদন্তের জন্য স্বাধীন কমিশন গঠন। কিন্তু এই দাবিগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভারতের রেকর্ড প্রায় শূন্য। প্রশাসনিক জটিলতা, রাজনৈতিক অনীহা, এবং এদের প্রতি একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি উঠেছে। তবে বাস্তবে এই দাবিগুলো উপেক্ষিত হয়েছে।
শিকার পরিবারের প্রশ্ন:
আজকের বারবার প্রশ্ন উঠছে ন্যায়বিচার কোথায়?
মুম্বাই ট্রেন বিস্ফোরণে নিহত ১৮৭ জনের পরিবার আজও জানতে পারেনি—কারা আসল দোষী। বম্বে হাইকোর্টের রায় অভিযুক্তদের মুক্ত করলেও, প্রকৃত অপরাধীদের ধরা পড়েনি। এই ব্যর্থতা শুধু অভিযুক্তদের জীবন নষ্ট করেনি, নিহতদের জন্যও ন্যায়বিচার অধরা রয়ে গেছে। রাষ্ট্রের তদন্ত প্রক্রিয়া যেন মুসলিম যুবকদের সহজ লক্ষ্যবস্তু বানানোর উপর কেন্দ্রীভূত ছিল, প্রকৃত অপরাধীদের ধরার প্রতি সদিচ্ছার অভাব ছিল স্পষ্ট।
পরিশেষে বলা যায়, একটি গণতান্ত্রিক বিবেকের প্রশ্ন মালেগাঁও থেকে মুম্বাই—এই বিচার-প্রহসনের ইতিহাস ভারতের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের উপর গভীর প্রশ্ন তুলে। এই মামলাগুলো শুধু ব্যক্তির জীবন ধ্বংস করেনি, একটি সম্প্রদায়কে সামাজিকভাবে প্রান্তিক করে তুলেছে। হারানো যৌবন, ভেঙে পড়া পরিবার, এবং অপূরণীয় মানসিক আঘাত—এই ক্ষতির দায় কে নেবে? মুসলিম মানেই 'সন্ত্রাসী'—এই বিষাক্ত আখ্যান কবে থামবে?
বম্বে হাইকোর্টের রায় একটি আশার আলো, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। ন্যায়বিচার শুধু খালাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি দাবি করে ক্ষতিপূরণ, দায়ীদের শাস্তি, এবং একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা। ভারতের প্রতিটি নাগরিকের, বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের, এই প্রশ্ন তুলতে হবে: আমরা কি এমন একটি সমাজ চাই, যেখানে ধর্মের ভিত্তিতে নির্দোষ মানুষের জীবন ধ্বংস হয়? ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই শুধু আদালতের নয়, সমাজের বিবেকেরও। এই প্রহসনের অবসান না হলে, ভারতের গণতন্ত্রের ভিত্তি ক্রমশ দুর্বল হবে। এখন সময় এসেছে—আইনের শাসন, স্বচ্ছ বিচার, এবং মানবাধিকার রক্ষার জন্য একটি নতুন ভারত গঠনের দাবি।