About Us | Contact Us |

কাঁটাতারে ঝুলন্ত ফেলানী এবং ন্যায়বিচার

লিখেছেন : কিরীটি রায়
কাঁটাতারে ঝুলন্ত ফেলানী এবং ন্যায়বিচার

৭ই জানুয়ারি ২০১১, সেদিন পশ্চিমবঙ্গের তখনকার দিনহাটা থানা, বর্তমানে সাহেবগঞ্জ থানার অন্তর্গত চৌধুরীহাট এলাকার কাঁটাতারের বেড়া টপকে যাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট লাইনম্যান কে যথাযথ টাকা দিয়েছিল ওর বাবা নূর খান।

সেই দিন ৭/১/১১ সকালবেলা খুব কুয়াশা পড়েছিল এবং মোট ৪০ জন মানুষকে ভারত থেকে বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য উপরোক্ত লাইনম্যান ব্যবস্থা করেছিল। সর্বত্রই এপার ওপার করার জন্য লাইন ম্যানদের একমাত্র অবলম্বন দুপারের সীমান্তরক্ষী বিএসএফ এবং বিজেপি ভারতের বা পশ্চিমবাংলার পুলিশ এবং বাংলাদেশের পুলিশ, স্থানীয় মাতব্বর, রাজনৈতিক নেতারা। সেদিন ঐ পয়েন্টের দুপাশে দুটো মই লাগানো ছিল। একটা মই দিয়ে কাঁটাতারের ওপর ওঠা এবং অপর মই দিয়ে কাঁটাতারের ওপারে চলে যাওয়া। কাঁটাতারের ওপারটি কিন্তু বাংলাদেশ নয়, ওটাও ভারতের ভূখণ্ড। কারণ ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতার বসিয়েছে ভারতীয় ভূখণ্ডের অনেক ভিতরে, গ্রামবাসীদের জমির ওপর। তাই সেদিন বিএসএফ ফেলানীকে গুলি না চালিয়ে ধরতে পারত, আইন ভাঙ্গার জন্য আদালতে বিচার হতো, কিন্তু তা হয়নি; কারণ বিএসএফ সীমান্তে পাহারা দেয় না, তারা কাঁটাতারের এপাশে সিপিডব্লু রাস্তায় থাকে।

নুর খান কাঁটাতারের বেড়া টপকে যাওয়ার পরে ফেলানি কাঁটাতার টপকানোর জন্য মইতে ওঠে, ওপারের মই দিয়ে যখন নামতে যাবে, সেই সময় কাঁটাতারের কাঁটায় তার কামিজ আটকে যায়। ফলে সে আর নামতে পারেনি। ওই অবস্থায় বিএসএফের সেপাই তাকে দেখে এবং গুলি চালায়।

গুলিটি চালিয়েছিল শ্রী অমিয় ঘোষ নামে এক সিপাই। গুলি খেয়ে সেখানেই সে আটকে থাকে বহুক্ষণ। রক্ত গড়িয়ে পড়তে থাকে এক ঘণ্টার ওপর। বিএসএফরা তাকে বাঁচানোর বা চিকিৎসা করার কোন বন্দোবস্ত করেনি। কুচবিহার এম জে এন হাসপাতালে ময়নাতদন্ত হয় দিনহাটা থানার ইউ ডি গ্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে (পিএম নং ২৩/১১ তাং ৭/১/১১)।

ওই মৃতদেহ বাংলাদেশে ফেরত দেওয়ার পর কুড়িগ্রাম হাসপাতালে পুনরায় ময়নাতদন্ত হয় (ইউ ডি মামলা নং ১/১১ এবং ময়নাতদন্ত হয় ৯/১১ তারিখে)। দুটি ময়না তদন্ত রিপোর্টে বলে যে, ফেলানির বাঁদিকের বুকের সপ্তম পাঁজরের হারে গুলি লাগে যা, হৃৎপিণ্ড ভেদ করে ডান দিকের কাঁধ দিয়ে বেরিয়ে যায়, যার ফলে তার মৃত্যু হয়। -

ফেলানী হত্যার পরে সমগ্র বাংলাদেশ উত্তাল হয়; নানান বিক্ষোভ কর্মসূচি ও পোস্টারে পোস্টারে বাংলাদেশ ছেয়ে যায়। এপার বাংলাতেও যথেষ্ট আলোড়ন হয়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিএসএফের গৌহাটি সেক্টর একটি আদালত গঠন করে। বিএসএফের আদালত মানে অভিযুক্ত বিএসএফ, প্রসিকিউশন বিএসএফ এবং বিচারক ও বিএসএফ। যেখানে অভিযুক্ত অমিয় ঘোষ নির্দোষ বলে চিহ্নিত হয়। উক্ত তথাকথিত রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে আবার উত্তাল হয়ে ওঠে দুই বাংলা। সংবাদমাধ্যমেও বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য প্রকাশিত হতে থাকে; যা বিএসএফের পক্ষে বা কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে সুখকর ছিল না।

এরপর বিএসএফ পুনরায় একটি আদালত গঠন করে। তখনকার বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় হেডকোয়ার্টারের ডিজি ছিলেন শ্রী বিডি শর্মা; যিনি এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেছিলেন, এই হত্যার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন এবং ন্যায় বিচার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ততসত্ত্বেও আপীল আদালত যথারীতি অমিয় ঘোষ কর্তৃক ফেলানী হত্যাকে ভুল বলেনি বরং মনে করে এই হত্যা যথাযথ হয়েছে। ইতিমধ্যে ২০১৩ সালের ১৭ই অক্টোবর ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ফেলানী হত্যার বিষয়ে রায় দিয়ে জানায় একটি নিরস্ত্র কিশোরী মেয়েকে খুন করেছে বিএসএফ, যা মানা যায় না; ভারতের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের প্রতি নির্দেশ দেয় যে বাংলাদেশের ভারতীয় দূতাবাস থেকে ফেলানীর পরিবারের হাতে যেন পাঁচ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। যে নির্দেশ কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র দপ্তর মানেনি।

মনে রাখা দরকার ২০১১ জানুয়ারি মাস তখন রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায়। তার পুলিশ ফেলানী হত্যাকাণ্ডের তদন্তে বিএসএফকে দোষী মনে করেনি। সেই সময় দিল্লিতে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেসের সরকার তারাও বিএসএফের বক্তব্যে সহমত পোষণ করেছে। ২০১৩ তে এন এইচ আর সি-র সুপারিশের প্রতি সম্মান তৎকালীন কংগ্রেস সরকার দেয়নি। ২০১৪ পরবর্তীতে ভারতের রঙ্গ মঞ্চে পালাবদল হয়েছে। আরো কট্টর হিন্দুত্ববাদী সরকার ভারতে এখন ক্ষমতায়; এবং ২০১১ মে মাস থেকে তৃণমূল সরকার এ রাজ্যে ক্ষমতায়। তারা কেউই এই হত্যাকাণ্ডের বা দৈনন্দিন ঘটে যাওয়া বিএসএফের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কার্যকরী কোন পদক্ষেপ নেয়নি।

আমরা বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম) এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের কুড়িগ্রামে গিয়ে ফেলানীর পরিবারের সাথে দেখা করে তার পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিই। সেই মোতাবেক ভারতের সুপ্রিম কোর্টে ফেলানীর বাবা নূর খানের সাথে মাসুম একটি রিট মামলা করে যার নম্বর  WP (CRL) No. 141/2015, ৭/০১/২০২৫ ফেলানী হত্যার ১৪ বছর পূর্ণ হচ্ছে। আমাদের তদবিরের ফলে সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে এই মামলার শুনানি হওয়ার কথা ছিল কিন্তু তা অজ্ঞাত কারষণ আবার পিছিয়ে গেছে। প্রায় পাঁচ বছরের অধিক সুপ্রিম কোর্টে এই মামলাটি ফাইনাল হিয়ারিং এর জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। সকল বিবাদী পক্ষ তাদের বক্তব্য এফিডেফিট জমা দিয়েছে।

আর কতোদিন ন্যায়বিচারের জন্য অপেক্ষা করলে তবে আইনের শাসন মানা নাগরিক বলা যাবে! জানা নেই।

ফিচার ছবি সংগৃহীত

ঋণ : সোশাল জাস্টিস

কিরীটি রায়
কিরীটি রায়

মানবাধিকার কর্মী