বিহার পুলিশের ডিজিপি বিনয় কুমার এবং এডিজি (সদর দপ্তর) কুন্দন কৃষ্ণন সম্প্রতি এক বিস্ফোরক মন্তব্য করে রাজ্য-রাজনীতিতে ঝড় তুলেছেন। তাঁদের দাবি, এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত, যখন চাষবাসের কাজ কম থাকে—অর্থাৎ কৃষকদের 'লিন সিজন' বা 'অলস সময়'—সেই সময় নাকি রাজ্যে অপরাধমূলক ঘটনা বহুগুণ বেড়ে যায়। আর এই অপরাধ বৃদ্ধির জন্য তাঁরা সরাসরি কৃষকদেরই দায়ী করছেন! তাঁদের মতে, সামগ্রিক অপরাধ বৃদ্ধির সঙ্গে কৃষকদের এই "অলস সময়" কাটানোর নাকি সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। পুলিশের এই ভিত্তিহীন ও দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা (এসকেএম)। এসকেএম এই উক্তিকে "কৃষকদের প্রতি বৈষম্যমূলক অপবাদ" এবং "ঔপনিবেশিক মানসিকতার প্রতিফলন" হিসাবে চিহ্নিত করেছে। এই ঘটনা বিহারের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। প্রশ্ন উঠছে, ভোটের আগে অন্নদাতাদের এই চরম অসম্মান কি শাসক জোটের জন্য 'বুমেরাং' হয়ে দেখা দেবে?
বিহারের নাওয়াদা জেলার ওয়ারিসালিগঞ্জের এক মহিলা কৃষক, চিন্তা দেবী, পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। তিনি বলেন, তাঁর স্বামী শহরে কাঠের কাজ করেন এবং তিনি দুই ছেলেকে নিয়ে তাঁদের পারিবারিক কৃষিকাজ সামলান। সারা বছরই তাঁদের চাষের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। বিভিন্ন সময়ে জমিতে ছোলা, সরিষা, ধান, এবং সবজি চাষ হয়। ছোট ছেলে সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা করছে এবং বড় ছেলে সময় পেলে কাঠের কাজ করে। বাড়িতে চারটি গরুও আছে, সেগুলোর দেখভালও তাঁদেরই করতে হয়। এই পরিস্থিতিতে চুরি-ডাকাতির মতো অপরাধে জড়িত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না বলে তিনি জোর দিয়ে বলেন।
চিন্তা দেবী আক্ষেপ করে বলেন, “আমার বাড়িতে গরু রয়েছে ৪ টে তাদের দেখভাল রয়েছে। চাষ, গরুর দেখভাল সংসারের অন্যান্য কাজ করার পর সময় কোথায়? চুরি ডাকাতি করতে যাবো!! পুলিশ অপরাধ দমনে ব্যর্থ। দায় চাপিয়ে দিচ্ছে গরিব চাষিদের উপর। আসলে দেশের গরিব চাষীরা সমাজের দুর্বল অংশ, তাদের উপর দোষ দিলে তাদেরও কিছু করার থাকে না, সমাজের উঁচু তলার মানুষরাও খুব একটা এর প্রতিবাদ করে না। অবাক লাগে, দেশের সব খারাপের জন্য আমাদের মতো গরিবরাই দায়ী! অথচ আমরাই সবার খাবারের যোগান দিই। কিছু বলার নেই।”
তিনি মনে করেন, পুলিশ অপরাধ দমনে ব্যর্থ হয়ে দায় চাপিয়ে দিচ্ছে গরিব কৃষকদের ওপর। কিন্তূ ভোটের বাক্সে এর প্রভাব পড়বে কিনা জানতে চাওয়া হলে তিনি নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারেননি, তবে জানান যে কৃষকেরা এই বিষয়টি ভালোভাবে নেননি।
ঔপনিবেশিক ভূত, নাকি প্রশাসনিক ব্যর্থতার আড়াল?
বিহারের এই ঘটনা ব্রিটিশ আমলের এক কালো অধ্যায়কে মনে করিয়ে দেয়—'ক্রিমিনাল ট্রাইবস অ্যাক্ট', যেখানে নির্দিষ্ট কিছু সম্প্রদায়কে 'জন্মগত অপরাধী' তকমা দেওয়া হয়েছিল। এসকেএম স্পষ্টতই এই মন্তব্যের মধ্যে সেই ঔপনিবেশিক প্রেতাত্মার উপস্থিতি দেখছে। তারা মনে করিয়ে দিয়েছে, ভারতের স্বাধীনতার পর ১৯৫২ সালে এই আইন বাতিল হলেও, কিছু 'বিমুক্ত জাতি' আজও সেই কলঙ্কের বোঝা বয়ে চলেছে। আজ, যখন আধুনিক ভারতে 'সবকা সাথ, সবকা বিকাশ'-এর স্লোগান দেওয়া হয়, তখন একটি রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের এমন পিছিয়ে পড়া ও অন্যায় মন্তব্য কেবল নিন্দনীয়ই নয়, এটি প্রশাসনের মূল দর্শনকেই প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলে দেয়।
প্রশ্ন উঠেছে, পুলিশের এই মন্তব্য কি শুধুই একটি ভুল বোঝাবুঝি, নাকি বিহারে ক্রমবর্দ্ধমান অপরাধের হার নিয়ন্ত্রণে নিজেদের চরম ব্যর্থতা ঢাকার এক মরিয়া চেষ্টা? গত ২৫ দিনে রাজ্যে ৫১ জনের খুন, যার মধ্যে কেবল রাজধানী পাটনাতেই ১৪টি হত্যাকাণ্ড—এই পরিসংখ্যানগুলি নীতীশ কুমারের নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের আইনশৃঙ্খলার ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলছে। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে অন্নদাতাদের ঘাড়ে অপরাধের দায় চাপানো পুলিশের অযোগ্যতারই প্রমাণ, এমনটাই মনে করছে সমালোচকরা।
যেখানে কৃষকের আয় নেই, অভাবের তাড়নায় তারা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন, সেখানে তাদের দুর্দশা লাঘবের কোনো সুনির্দিষ্ট প্রতিকারের ব্যবস্থা নেই। উল্টে, তাদের অলসতার দোহাই দিয়ে অপরাধীর তকমা সেঁটে দেওয়া হচ্ছে, যা চরম অমানবিক এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন। বছরের পর বছর ধরে কৃষকরা ফসলের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে, ঋণের জালে জড়িয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বাজারের অস্থিরতা এবং সরকারি সহায়তার অভাব—এসবই তাদের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তোলে। এই কঠিন বাস্তবতার মুখে দাঁড়িয়ে যখন তাদের প্রয়োজন প্রকৃত সমাধান এবং সমর্থন, তখন প্রশাসনের উচ্চপদস্থদের কাছ থেকে এমন ভিত্তিহীন অভিযোগ তাদের ক্ষতকে আরও গভীর করে তুলছে।
ভোটের বাক্সে মূল্য চোকাতে হবে ?
বিহার একটি কৃষিপ্রধান রাজ্য, এবং কৃষকরা সেখানকার এক বিশাল ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভোটব্যাঙ্ক। ভোটের আগে কৃষকদের ‘অলস’ এবং ‘অপরাধপ্রবণ’ বলে দাগিয়ে দেওয়া কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষেই মঙ্গলজনক হতে পারে না। এই মন্তব্য সরাসরি লক্ষ লক্ষ কৃষকের সম্মান ও আত্মমর্যাদাকে আঘাত করেছে। স্বাভাবিকভাবেই, আরজেডি, কংগ্রেসের মতো বিরোধী দলগুলি এই ইস্যুকে লুফে নিয়েছে। তারা এই ঘটনাকে সরকারের কৃষক-বিরোধী মানসিকতা এবং আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে তাদের ব্যর্থতার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরবে। শাসক জোট, বিশেষ করে জেডি(ইউ) এবং বিজেপি, এমন মন্তব্যের পর অস্বস্তিতে পড়েছে। মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার বা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নীরবতাও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। ভোটের আগে এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে মুখ না খোলা কৃষকদের মধ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা (এসকেএম) ইতিমধ্যেই, ২২ জুলাই, ২০২৫ তারিখে, বিহার জুড়ে এডিজি কুন্দন কৃষ্ণন এবং মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের কুশপুতুল দাহ করা হয়েছে। তা রাজ্যের রাজনৈতিক তাপমাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এই প্রতিবাদগুলি আসন্ন নির্বাচনের আগে কৃষকদের অসন্তোষকে স্পষ্ট করে তুলবে। এসকেএম এই মন্তব্যকে “ঔপনিবেশিক মানসিকতার প্রতিফলন” হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং ১৮৭১ সালের অপরাধী উপজাতি আইনের সাথে এর তুলনা টেনেছে। নির্বাচনের আগে এমন একটি স্পর্শকাতর তুলনা শাসক দলের “জনদরদি” ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। সব মিলিয়ে, বিহারে কৃষকদের অপরাধী বলার ঘটনাটি নির্বাচনের আগে একটি বড় রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হবে এবং আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে এর একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলি এই ঘটনাকে তাদের প্রচারণার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ব্যবহার করবে বলে আশা করা যায়।
কেন এই মন্তব্য বিপজ্জনক?
কৃষকরা আমাদের অন্নদাতা—এই সত্যটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। প্রমাণ ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা কেবল অন্যায় নয়, এটি সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সকলের সমান অধিকার ও সম্মান পাওয়ার কথা। যখন পুলিশি প্রশাসন, যারা জনগণের সুরক্ষার দায়িত্বে, তারাই একটি বৃহৎ ও অপরিহার্য গোষ্ঠীকে ঢালাওভাবে অপরাধী হিসেবে ঘোষণা করে, তখন তা গণতন্ত্রের মৌলিক মূল্যবোধকেই ক্ষুণ্ণ করে। এডিজি কুন্দন কৃষ্ণন শেষ পর্যন্ত ক্ষমা চাইলেও, যে মানসিকতা থেকে এই মন্তব্য এসেছে, তা কি সত্যিই মুছে গেছে?
আসন্ন বিহার বিধানসভা নির্বাচনে এই 'অপরাধী' তকমা কতটা প্রভাব ফেলে, তা দেখতে হলে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে, একথা স্পষ্ট, অন্নদাতাদের প্রতি এমন নেতিবাচক মনোভাব ভোটের রাজনীতিতে শাসক জোটের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। প্রশ্ন এটাই, সরকার কি এই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে, নাকি এই বিতর্কই তাদের নির্বাচনী ভরাডুবির কারণ হবে?