About Us | Contact Us |

প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ রক্ষার আবেদনে একটি রূপক নাটিকা

লিখেছেন : সন্তোষ সেন
প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ রক্ষার আবেদনে একটি রূপক নাটিকা

[দারুন আগ্নিবানে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়া একজন আদ্যপান্ত ভোগবাদী মধ্যবিত্ত মানুষ-এর সাথে এক আজব প্রাণীর কথোপকথন। এই প্রাণীর মগজেও ব্যারাম দেখা দিয়েছে।]

[নিজের কথা: এ নাটিকা নেহাতই আনাড়ি লোকের কাঁচা হাতের প্রাণের তাগিদ থেকে একটা চেষ্টা মাত্র। তবুও বন্ধুরা পড়ুন প্লীজ। মতামত দিন। দেখুন এটাকে কোনো রূপ দেওয়া যায় কিনা। কোন নাট্যগোষ্ঠী বা সামাজিক সংগঠন চাইলে প্রয়োজনমত সংযোজন, সম্পাদনা করে এটিকে শ্রুতি নাটক বা পথ নাটিকার রূপ দিতে পারেন।]


#ভোগী: ধ্যুত তেরি, আর পারা যাচ্ছে না। ৪০- ৪৫-৫০ ডিগ্রি। কোথায় থামবে কে জানে? গরমে সেদ্ধ হওয়ার হাত থেকে বাঁচতে সব ঘরে একটি করে এসি, সাকুল্যে চার জনার জন্য দুটি গাড়িতে দুটি এসি, হলঘরে দুটো এসি, ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল সব খাবার ও পানীয় পেতে নতুন দুটো ঢাউস ফ্রিজ লাগিয়েছি। বিদ্যুতের বিল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, ভাবতেই পারছি না। এখন তো আবার স্মার্ট মিটার। যত খুশি টাকা কেটে নিতে সে ভীষণ স্মার্ট।
#প্রাণী: চিন্তা কি মশায়? এখন শহরে দেদার টাকা উড়ছে। একটু বুদ্ধিসুদ্ধি খাটিয়ে, দাদা দিদিদের ধরে আর কটা বাড়তি পয়সা উপার্জন করলেই তো হয়?

#ভোগী: বেশ বলেছেন দাদা। আচ্ছা, এই জ্বলুনি ধরানো, অসভ্য অভদ্র গরমের কি কোনো ভালো দিক নেই?
#প্রাণী: আছে তো। বিদ্যুতের বিল লাগামছাড়া হলেও, এই দাবদাহে চা বানিয়ে নিন অতি সহজে। ট্যাংকের জল গ্লাসে ভরে খানিক চা-পাতা দিয়ে দুই মিনিট ভিজিয়ে রাখুন। ব্যাস, ৩-৪ জনের চা তৈরি। কি খুশি তো? 

#ভোগী: দারুন, দারুন। দাদা আরও কিছু টিপস্ দিন না প্লিজ।
#প্রাণী: আছে, আছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, গরম আরও বাড়বে, দাবদাহে পুড়ে সব ছারখার হবে। তখন ট্যাংকের জল হাঁড়িতে ধরে চাল ডাল আলু কুমড়ো ছেড়ে দিলে মিনিট কুড়ি পর খিঁচুড়ি হয়ে যাবে। আহা কি মজা, তাই না?
আজ তো প্রকৃতি বুড়ো র জন্মদিন।

#ভোগী: কে প্রকৃতি বুড়ো? 
#প্রাণী: আপনাদের রবি ঠাকুর ..তাঁর জন্মদিন তো আজ। আমার বন্ধুরা রবি ঠাকুরের জন্মদিন পালন করছে। চুন্নুমুন্নুদের কথা উনি খুব বুঝতে পারতেন আর বুঝতেন প্রকৃতির কথা। 
আপনারা তো ওনার কথা বুঝতে পারলেন না, শুধু ওনার গান গাইলে হবে? মানে বুঝতে হবে তো। উনি কি বলতে চেয়েছেন তা বুঝে দেখতে হবে। আমার বন্ধুদের গলায় ওনার কথা শুনুন।

প্রথম ব্যক্তি: “এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ। তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে।” পাতা ঝরে পড়ে, গাঁথা মালা ম্লান হয়ে যায়। জনহীন পথে মরীচিকা, শুষ্ক ধূলায় ফুলদল খসে পড়ে, হৃদয় হয় তৃষায় ব্যথিত –“নাই, রস নাই, দারুন দহনবেলা।”

#ভোগী: আরে এ তো সেই গরম হাওয়ার ঝলক। শুনে তো গরম গেল বেড়ে। কী জ্বালা!
#প্রাণী: দহন জ্বালার শেষে বাদল ধারা আনতে আবার সেই মানুষটির কাছেই যান। এই সুর ভেসে আসছে মেঘের রাজ্য থেকে।

#দ্বিতীয় ব্যক্তি: “এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে, এসো করো স্নান নবধারা জলে। এসো শ্যামলসুন্দর, আনো তব তাপহরা, তৃষাহরা সঙ্গসুধা।” 
#তৃতীয় ব্যক্তি: “বাজিবে কঙ্কন, বাজিবে কিঙ্কণী, ঝঙ্কারিবে মঞ্জির রুণুরুণু। ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে, জল সিঞ্চিত ক্ষিতি সৌরভ ভরসে, ক্ষণগৌরবে নবযৌবনা বরষা, শ্যামগম্ভীর সরসা।”

#ভোগী: মাথা চুলকোতে চুলকোতে বিড়বিড় করে বলছে –লহ প্রণাম কবি। তোমার এসব ভাবনাও আমাদের মগজে কেন হাতুড়ি পেটায় না? কেন? কেন?
#প্রাণী: ঐ প্রকৃতি পূজারীর কথা ছাড়ান দেন কত্তা। ঐসব ভুলে মহা উৎসাহে গাছ কাটতে থাকুন। ম্যাজিকের মতো ভ্যানিশ করে দিন বন জঙ্গল। যন্ত্রের ধারালো কোপে সব ঘ্যাচাং ফু!
পুকুর খাল বিল নদী বুজিয়ে আকাশচুম্বী বহুতল ফ্ল্যাট, অফিস, কাছারি হোক না কেন, সমস্যার কী আছে? সব খারাপের কিছু ভালো দিকও তো আছে, ঠিক কি না?

#ভোগী: মাথা চুলকিয়ে আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করলেন: কী যে বলেন দাদা! এভাবে সব বড় বড় গাছ মেরে ফেললে, জলাভূমি ভরাট করে দিলে তাপমাত্রা তো আরও বাড়বে, তখন তো গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে যমালয়ে যেতে হবে?  
#প্রাণী: বালাই ষাট! যমালয়ে যাবেন কেন এত তাড়াতাড়ি? ভোগ, আরও ভোগ করুন মশায়।  ভগবান মেহেরবানী করে ধরাধামে পাঠিয়েছেন তো সবকিছু লুটেপুটে খেতে। 

# ভোগী: ভোগ তো করেই চলেছি। কিন্তু ছাতার মাথা এই গুমোট গরম আর দাবদাহে যে ঘেমে নেয়ে একসা হয়ে যাচ্ছি। প্রাণ যে ওষ্ঠাগত। খানিক শীতল বাতাস দাও না কেন বইয়ে।
#প্রাণী: গরমে ঘেমে-নেয়ে তিতি-বিরক্ত হয়ে গেলে চলবে? এমন দিন আসছে, যখন কয়লা, পেট্রোলিয়ামের ভাঁড়ার যাবে শেষ হয়ে। বেশিরভাগ সময়ই বিজলি থাকবে না। তখন এসি-ডিসি কিছুই কাজ করবে না। 

#ভোগী: বিদ্যুৎ না থাকলে খাব কী, বাঁচবো কী করে?
#প্রাণী: গরম মাথায় নামি দামী কোম্পানির কুল কুল ঠান্ডা তেল লাগান। ঠান্ডা মাথায় কলকাতা- কল্যাণী-রানাঘাট-দুর্গাপুর-বাঁকুড়া হয়ে নাক বরাবর সিধে চলে যান মানস সরোবরে কিম্বা মেরুপ্রদেশ গ্রিনল্যান্ডে। ঠান্ডা ঠান্ডা বরফে বেদম গড়াগড়ি খান। 

#ভোগী: ধ্যুর, এইভাবে সুদূর মেরুপ্রদেশে যাওয়া যায় নাকি?
#প্রাণী: না, আসলে জ্বালানি তেলের ভাঁড়ার তো যাবে ফুরিয়ে। তখন তো উড়োজাহাজও হবে নট নড়ন চড়ন। তাই এই শর্টকার্ট পথ বাৎলে দিলাম, এই আর কি? কত সহজ পথ, তাই না মশায়?

#ভোগী: আচ্ছা দাদা, শুনছি নাকি, কে এক শক্তিশালী ডন ক্ষমতার জোরে ঐ গ্রিনল্যান্ড কিনে নিতে চায়। আপনি কিছু জানেন?
#প্রাণী: হ্যাঁ, গন্ধটা বেশ সন্দেহজনক। গেছো দাদা দেখে এসেছে, ওখানে বরফের নিচে প্রচুর বিরল খনিজ টনিজ আছে। এসব কব্জা করতে না পারলে ওদের প্রযুক্তি কুযুক্তি সব জলে যাবে যে।

#ভোগী: কিন্তু এইভাবে চলতে থাকলে, আগামীদিনে তো আমাদের ছেলেমেয়ে, নাতিপুতিরা বেঁচে থাকার প্রধান রসদ অক্সিজেনটুকুও পাবেনা। জলের সংকট ও দূষণ নিয়ে হাহাকার তো দিকে দিকে। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গেলেও, পকেটে হাজার টাকা নিয়ে ঘুরলেও বোধহয় জল পাওয়া যাবে না হাতের কাছে। কী যে হবে, কে জানে?
#প্রাণী: আমাদের বন্ধুদেরও ছাতি ফেটে যাচ্ছে জল, গাছের আশ্রয় না পেয়ে। তবে আমরা তো আবার বিশ্ব নাগরিক। হেথায় হোথায় চরে বেড়াই। ঠিক কিছু একটা জুটে যাবে অন্তত আরও কিছুটা কাল।

#ভোগী: তা বেশ। পরম কল্যাণময় প্রকৃতি আপনাদের ভালো রাখুন। কিন্তু, আমাদের হবেটা কী?
#প্রাণী: আরে মশায় অত গভীরে গিয়ে তলিয়ে ভাবছেন কেন? সব কিছুরই তো সমাধান আছে, ঠিক কি না? গাঁটের কড়ি একটু বেশি খসিয়ে বাচ্চাগুলোর পিঠে একটা করে অক্সিজেন সিলিন্ডার ঝুলিয়ে দেবেন। হ্যাঁ, তবে পকেটের পয়সা অনেক বেশি খসিয়েও জলের ব্যবস্থা হবে কিনা, তা বলতে পারিনে।

#ভোগী: বাচ্চাগুলো জল, অক্সিজেন না পেয়ে বাঁচবে তো ভাই? টাকা দিয়েও এইসব পাওয়া যাবেনা?
#প্রাণী: টাকা দিয়েও পাবেন না। আর টাকা- ডলার চিবিয়ে তো পেট ভরবে না, পেট্রোল- ডিজেল দিয়ে পিপাসাও মিটবে না। তা হলফ করেই বলতে পারি।

#ভোগী: প্রচণ্ড রোদের তাপে তো চুন্নুমুন্নুরা ভাজা ভাজা হয়ে যাবে!
#প্রাণী: আপনি খুব বোকা মশায়। রোদের তাপ থেকে ছেলেপুলেদের বাঁচাতে মাথার সামনে ‘ফাদানি’ বাবুর তৈরি সৌরশক্তি চালিত একটা ফ্যান লাগিয়ে দেবেন। সাথে আছে মিনি সাইজের এয়ার কুলার, স্মার্ট টুপি, আরও কত কী! 

#ভোগী: সত্যি কালে কালে আরও কতকিছু যে দেখব! বাজার আর শুধুই বাজার।
#এইটুকুতেই চমকে উঠলেন? আপনাদের স্মার্টফোন সহ এইসব নয়া যনতর গরম হয়ে গেলে তা ঠান্ডা করার মনতরও বাজারে হাজির।
আর তেমন বুঝলে আপনাদের বাজার-বাবুরা  কলাপাতা, পদ্মপাতা, শালপাতা দিয়ে  জামাকাপড়ও বানিয়ে দেবেন। ল্যাঠা যাবে চুকে।

#ভোগী:  কিন্তু যা দিনকাল পড়লো, এ তো দেখছি –তীব্র তাপপ্রবাহ, দাবানল, খরা, বন্যা বা ঝড়ঝঞ্ঝার জন্য স্কুল কলেজ বছরে ৬-৭ মাস বন্ধই থাকবে, পড়াশোনা হবে কেমনে? 
দমবন্ধ হয়ে যাওয়া এই দুর্বিপাকে বুক সমান জল ঠেলে বাজার হাট, ব্যাংক, অফিস আদালতেই বা যাই কীভাবে?
#প্রাণী: কী বলছেন মশায়? আপনাদের বড়দা আর মেজো ছোট দাদা দিদিরা সেসবের ব্যবস্থা তো প্রায় করেই ফেলেছেন। 

#ভোগী: গন্ধটা এবার আমারও সন্দেহজনক লাগছে! একটু ঝেড়ে কাশুন তো দাদা।
#প্রাণী: ব্যাপারটা ঠিক বুঝলেন না, তাই তো? বুঝিয়ে দিচ্ছি সহজ করে। আরে, এবার আর পড়াশোনা করার জন্য স্কুলে, কিম্বা টাকাপয়সা লেনদেনের জন্য ব্যাংকে, অথবা কেনাকাটার জন্য বাজারে বা শপিং মলে যাওয়ার প্রয়োজনই পড়বে না। 
বদ্ধ ঘরের কুল কুল চার দেওয়ালের মধ্যে বা বরফ শীতল গাড়ি, কিম্বা অফিসে বসেই আঙ্গুলের টোকায় আপনাদের ঐ চারচৌকো বাক্সেই তো সবকুছ হো যায়েগা। 
গেছোদাদা বলছিল –এইসব যন্তরপাতি চালানোর জন্যই কিসব বিরল খনিজ নিয়ে তো যত্তসব ঝামেলা। দেশে দেশে যুদ্ধ। ধর্ম বর্ণ জাতপাত নিয়ে মারামারি।
#(ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে ভেসে আসে রবি ঠাকুরের ভারততীর্থ কবিতার কটি লাইন):
“হে মোর চিত্ত, পুণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।
হেথায় দাঁড়ায়ে দু বাহু বাড়ায়ে নমি নরদেবতারে,
উদার ছন্দে পরমানন্দে বন্দন করি তাঁরে।
ধ্যানগম্ভীর এই-যে ভূধর, নদী-জপমালা-ধৃত প্রান্তর,
হেথায় নিত্য হেরো পবিত্র ধরিত্রীরে
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।”

#ভোগী: আহা! মন প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। তীব্র গরমে যেন একরাশ টাটকা বাতাস।
#প্রাণী: হ্যাঁ, প্রকৃতি পরিবেশ উচ্ছনে যায় যাক। মানুষ জাহান্নামে যায় যাক। প্রাণ প্রজাতি যাদুঘরে স্থান নেয় নিক। সব ভুলিয়ে মানুষে মানুষে লড়াই লাগিয়ে দেবে ওরা। কবিগুরুর মানবতার বানী শুধু নীরবে নিভৃতে চার দেওয়ালের মাঝে ডুকরে ডুকরে কাঁদে। আমাদেরকে শুধু যন্তর-মন্তর দিয়ে বেঁধে দেওয়ার খেলা। রোম পুড়লেও নিরোর বাঁশি যে থামে না বন্ধু!

#ভোগী: তা, যা বলেছেন! প্রকৃতির সন্তান মানুষকে গাছপালা নদী পুকুর খালবিল থেকে, এমনকি সমাজ থেকে দূরে সরিয়ে যন্ত্রের দাস করে দেওয়া হচ্ছে। কবে, আর কবে আমাদের মান-হুঁশ ফিরবে, কে জানে?
#প্রাণী: ওসব ভাবার সময় কই মানুষের? জীবনটা কত সহজ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন, তাই না? আমাদের গেছোদাদা বলে –কিসব বুদ্ধিমত্তা নাকি সব কাজ করে দেবে চোখের পলকে।
শুধুমুদু প্রকৃতি বাঁচাও, একটি গাছ অনেক প্রাণ, পৃথিবী মানুষের একার নয়: এইসব জ্ঞানগর্ভ চর্চা করে মাথা নষ্ট করে কী আর হবে?

#ভোগী: হিসেব যে সব গুলিয়ে যাচ্ছে দাদা।
#প্রাণী: সবকিছুই তো কত সহজ করে বুঝিয়ে দিলুম। সাত দুগ্গুনে চোদ্দ। হিসেব মিললো না? এ'তো একেবারে জলবৎ তরলং মশায়। ভাবুন, ভাবুন, ভাবা প্র্যাকটিস করুন। আমি এখন যাই, মেলা কাজ আছে পড়ে।

#ভোগী: আর একটু থাকুন না ভাই। আপনার কথাগুলো বেশ ভালো লাগছে, হৃদয়ে খানিক দোলা লাগছে, মরমে কিছু প্রবেশও হয়তো করছে। 
এই বটবৃক্ষের শীতল ছায়ায় খুব ভালো লাগলো আপনার সাথে কথা বলে। আবার দেখা হবে তো? কথা দিন প্লীজ।
#প্রাণী: কথা কেউ রাখে না বন্ধু। আপনাদের যা যা করার, ভাবার কথা ছিল তা করেন নি। আমি এক ক্ষুদ্র প্রাণী আর কতটুকু কথাই বা দিতে পারি?

#ভোগী: তাহলে আর দেখা হবে না?
#প্রাণী: হবে, যদি আমাদের আস্তানা, গাছগুলো  টিকে থাকে উন্নয়ন আর ভোটবাবুদের করাতের কবল থেকে। ঐ কাজল কালো দীঘির জল যদি তখনো ছলাৎ ছলাৎ করে। যদি ওর বুক চিরে বহুতল গড়ে না তোলে আপনাদের পেয়ারের উন্নয়ন বাবুরা। তাহলে তো দেখা হবেই বন্ধু। নিশ্চয় দেখা হবে।

#ভোগী: যদি দেখা না পাই?
#প্রাণী: এখানে এসে গেছো-দাদার খোঁজ করবেন। গেছো-দাদা সব কৌতূহল মিটিয়ে দেবে জলের মতো সরল করে। 

#ভোগী: তার দেখা পাই কেমনে?
#প্রাণী: তার দেখা পাওয়া? হুঁ হুঁ বাপু, সে চাট্টিখানি কথা নয়। সে বহুত ঝকমারির ব্যাপার।

#ভোগী: তা কেমন?
#প্রাণী: আগে দেখে নিতে হবে কোথায় কোথায় দাদার থাকার সম্ভাবনা কম। তারপর দেখতে হবে দাদা কোথায় কোথায় থাকতে পারে।

#ভোগী:  আবার সব গুলিয়ে যাচ্ছে।
#প্রাণী: না না, ঘাবড়ানোর কিছু নেই। এখানে এসে যদি দেখেন তীব্র গরমে সব ঝলসে খাঁ খাঁ করছে, তাহলে সোজা চলে যান আলাস্কা বা গ্রিনল্যান্ডে। গেছো-দাদা শীতে জুবুথুবু হয়ে সেখান থেকে উড়ে যেতে পারে সাহারা বা থর মরুভূমিতে। সেখানেও দেখা না পেলে ঘুরে ফিরে আসুন ঐ দীঘির ঘটে। ঠিক পেয়ে যাবেন তার দেখা। ও মশাই, বুঝলেন কিছু?

#ভোগী: (খানিকক্ষণ মাথা চুলকে) আমার মাথায় যে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। সব কেমন ঘেঁটে ঘ। পোকাগুলো বোধহয় কিলবিল করছে। যেন বলছে –এগিয়ে যাও। তুমি পারবে। তোমরা পারবে। কর, কিছু একটা কর। এক্ষুনি শুরু কর।
#প্রাণী: ওসব ছাইভস্ম ভেবে কী আর লাভ? আপনার গিন্নি গরমাগরম বিরিয়ানি আর মাটন কষা নিয়ে আপনার অপেক্ষায় এসি চালিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। যান যান, দৌড় লাগান। 

#ভোগী: (জড়ানো গলায়) বলে –দাদা। ও দাদা। কিছু তো বলুন।
#প্রাণী: পথে নামুন। পথই আপনাদের রাস্তা ঠিক বাৎলে দেবে।
#কোরাস: পথে এবার নামো সাথী, পথই হবে পথ চেনা (২বার)।

#প্রাণী: এবার যে আমায় যেতে হবে বন্ধু মানস সরোবরের তীরে। গাছে গাছে, ডালে ডালে আমাদের বন্ধু হাঁস-সারস-বক-শালিক-টিয়া- কোকিল-দোয়েলদের খোঁজে। দেখি গিয়ে, গাছের কোটরে লেপ্টে থাকা ছোট ছোট পোকামাকড়, অণুজীব, লতাগুল্মরা সব কেমন আছে। আদৌ থাকবে তো আরও কয়েকটা বছর টিকে?

#ভোগী: আমরা পারব। নিশ্চয় পারব সবকিছু টিকিয়ে রাখতে। সুন্দরভাবে গুছিয়ে নিতে।
#প্রাণী: দেখুন মশায় –আমাদের, আপনাদের, আর আমাদের প্রাণের চেয়ে প্রিয় সব ছেলেমেয়েগুলোর বাঁচা মরা, সবকিছুর চাবিকাঠি আপনাদেরই হাতে। যা ভালো বোঝেন, করুন। আমারও তো মাথা খারাপ! কাকে কি বলি? বিদেয় বন্ধু।
(আজব প্রাণীটি প্রস্থান করে)।

#ভোগীঃ (নিচুস্বরে) বলে ওঠে –নিজেদের এবং আমাদের অত্যন্ত আদরের প্রিয় ছেলেমেয়েদের কী ভয়ানক ক্ষতি করে চলেছি কেবলই ভোগ আর উন্নয়নের নেশায়। আগে তো এইভাবে ভেবে দেখিনি। 
রবি ঠাকুর আর এই বন্ধুটি আমার চোখ খুলে দিয়ে মানস সরোবর, না কোথায় যেন চলে গেল। টাকার পিছনে অন্ধভাবে ছুটতে ছুটতে, মুনাফাখোরদের স্বার্থে ওদেরই তৈরি করা ভোগবাদী সংস্কৃতির আমরা শিকার। কবে যেন আমাদের অজান্তেই ওদের এই পথের শরিকও হয়ে পড়েছি।
পৃথিবীর সব ছেলেমেয়েরা, বন্যপ্রাণ, পাখ-পাখালি, গাছেদের দল আমাদের ক্ষমা করো।
(ভোগী প্রস্থান করে)।

#ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে ভেসে আসে কচিকাঁচাদের সম্মিলিত আওয়াজ: 
১। এ কী ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছ তোমরা? এ কোন বিষাক্ত দূষিত কলুষিত পৃথিবী রেখে যাচ্ছ আমাদের জন্য?
২। আমাদের বুক ভরে শ্বাস নিতে দাও, বিশুদ্ধ  জলের সরবরাহ ফিরিয়ে দাও। আমাদের আসল শরীর –পাহাড় জল জঙ্গল নদী সব ফিরিয়ে দাও।
৩। আমরা সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে চাই। শুধুমাত্র কিছু মানুষের ভোগবিলাস ও মুনাফার জন্য প্রকৃতির ধ্বংস নয়। 
৪। সকলের বেঁচে থাকার স্বার্থেই চাই প্রকৃতির মেরামতি। আমাদের ভালোর জন্যই চলো সকলে মিলে কিছু করি।
৫। এসো প্রকৃতিকে রক্ষা করি। টিকিয়ে রাখি হিমালয়কে। বাঁচিয়ে রাখি জীববৈচিত্রকে।
৬। গঙ্গা-সিন্ধু-ব্রহ্মপুত্র-যমুনা-কাবেরীকে অবিরল ধারায় বইতে দাও। শস্য-শ্যামলা, সুজলা-সুফলা হোক আমার বাংলা, আমাদের দেশ। 
৭। অঞ্জনা চূর্ণী জলঙ্গি সরস্বতী সহ গ্রামবাংলার সব নদী, জলাশয়কে দূষণমুক্ত করে ব্যবহারের উপযোগী করে দাও। বসবাসযোগ্য পৃথিবী তো সবেধন নীলমণি এই একটাই। 

#রবীন্দ্র কাব্য (২/৩ জন মিলে): 

“আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা
আমাদের এই নদীর নাম অঞ্জনা
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচ জনে 
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা।”

#সাতজন মিলে: আমরা বাঁচতে চাই। আমাদের সুস্থভাবে বাঁচতে দাও। এ আমার, তোমার, সকলের অধিকার। 
#(দর্শক ও সাতজন মিলে আবার বলবে) – আমরা বাঁচতে চাই। ….সকলের অধিকার।

# সাতজনের সমবেত কণ্ঠে: এসো মানব-সভ্যতা সহ সমস্ত প্রাণ প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখতে সকলে পথে নামি। এখনই এখনই। এসো জোট বাঁধি। জয় আমাদের হবেই হবে।

#রবীন্দ্র রচনা থেকে পাঠ (ব্যাকগ্রাউন্ডে): 

প্রথম ব্যক্তি: “সমগ্র বিশ্বচরাচরের সঙ্গে আমরা একই ছন্দে বসানো। এই ছন্দের যেখানে যতি পড়ছে, সেখানেই প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে।”

দ্বিতীয় ব্যক্তি: “আমরা অন্যায় ভাবে প্রকৃতিকে জড়পদার্থ বলে থাকি। কিন্তু এই জড়ের সঙ্গে আমাদের চেতনার একটা গভীর যোগাযোগের গোপন পথ আছে। নইলে কখনোই নিজের প্রতি, জীবনের প্রতি অন্তরের এমন একটা অনিবার্য ভালোবাসার বন্ধন থাকতেই পারে না।”

#এরপর স্টেজে সকলে মিলে গেয়ে ওঠে: 
“এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি। সে যে আমার জন্মভূমি…।” (দুইবার)

সন্তোষ সেন
সন্তোষ সেন

বিজ্ঞান ও পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও প্রাবন্ধিক