About Us | Contact Us |

যুগে যুগে নিত্যনতুন রূপে ফ্যাসিবাদ

লিখেছেন : মিলি মুখার্জী
যুগে যুগে নিত্যনতুন রূপে ফ্যাসিবাদ

“ফ্যাসিজম যখন কমন ইউনিফর্ম প’রে আসে, তখন তাকে চেনা যায়, কিন্তু যখন স্যুট-বুট পরে আসে, তখন মানুষ একে উন্নয়ন ভেবে ভুল করে”- বলেছেন আর্জেন্টিনার লেখক এবং চিন্তাবিদ আর্নেস্তো সাবাতো।

     যখনই ফ্যাসিবাদের কথা বলা হয়, তখনই মানুষের মনে পরিষ্কার চিত্র তৈরি হয় — হিটলারের ইউনিফর্ম, মুসোলিনির সামরিক প্যারেড, জোরপূর্বক বন্দী করা মানুষ, সেন্সরশিপ, প্রকাশ্যে হিংসা ও যুদ্ধের উন্মাদনা। এই ফ্যাসিবাদ সরাসরি আক্রমণ করেছিল - ঘোষণা করেছিল যে, সে এক স্বৈরশাসক। এই ধরনের ফ্যাসিবাদকে চিহ্নিত করা সহজ ছিল। জনসাধারণের কাছে এর বিরুদ্ধে লড়াই করার, প্রতিরোধ করার সুযোগ ছিল। কিন্তু এখন ফ্যাসিবাদ উন্নয়ন, জাতীয়তাবাদ, গুড গভর্নেন্স- এইসব স্লোগানের ‘সিল্ক টাই’ প’রে নিয়েছে। এখন সে মিডিয়াকে বন্ধ করেনা, কিনে নেয়। সে সংসদকে জ্বালিয়ে দেয় না, সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা কিনে নেয়। সে বই পোড়ায় না, পাঠ্যসূচী বদলে দেয়। ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাসি.. 

     বিরোধীদের সে গুলি করে না, দেশদ্রোহী ঘোষণা করে। এটা ফ্যাসিবাদের বাজারমুখী সংস্করণ ,যা উন্নয়নের মোড়কে আসে, এবং গণতন্ত্রের আত্মাকে কর্পোরেট রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করে। যখন জনতা ফ্যাসিবাদকেই উন্নয়ন হিসেবে বোঝে, তখন প্রতিরোধকেও দেশদ্রোহ দেগে দেওয়াতে সুবিধা হয়। এই ভাবেই হয় আজকের স্যুট-বুট পরা ফ্যাসিবাদের সত্যিকারের জয়। ভয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ, কিন্তু বিভ্রমের বিরুদ্ধে লড়াই করা সবচেয়ে কঠিন। আর্নেস্তো সাবাতো এই বিপদের দিকটিকেই ইঙ্গিত করেছেন , যখন ফ্যাসিবাদ আপনার ভাষা, আপনার আকাঙ্ক্ষা এবং আপনার উন্নয়নের স্বপ্নগুলোর মধ্যে অনুপ্রবেশ করে, তখন তাকে চেনা যায় না , তখন তাকে চিহ্নিত করা যায় না। আর সেখান থেকেই সে সবচেয়ে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। যে বিপদের সংকেত প্রতিমুহুর্তে মানুষ উপলব্ধি করছে আজ। সত্যি কথা হলো, যারা প্রস্তাবনা থেকে 'সমাজতান্ত্রিক' এবং 'ধর্মনিরপেক্ষ' শব্দগুলো বাদ দেওয়ার কথা বলছেন, তারা আসলে এই শব্দগুলো দেখে বিরক্ত, ভীত এবং এর আসল অর্থ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাদের আশঙ্কা, যদি সংবিধানে 'সমাজতান্ত্রিক' শব্দটি থেকে যায়, তাহলে একদিন পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে আইনি ও নৈতিক আওয়াজ উঠবে। আর যদি 'ধর্মনিরপেক্ষতা' থাকে, তাহলে যারা ধর্মের নামে ভোট চায়, যারা দাঙ্গা উস্কে দেয়, যারা মন্দির-মসজিদের দেয়ালে রাজনীতি লেখে, তারা ধরা পড়বেই একদিন । এই কারণেই তারা এই শব্দগুলি মুছে ফেলতে চায় - ঠিক যেমন একজন অপরাধী কোনও অপরাধের প্রমাণ মুছে ফেলে। এই সব শব্দগুলো হঠাৎ করে সংযোজন হয় নি একথা ভাবার অবকাশ তখন আর জনগণের থাকে না , কেননা ওইসব মূল্যবোধের চেতনা সংবিধানে থেকেও জনগণ জীবন-যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পায় নি । তাই জনগণের দুরদর্শিতার অভাবের সুযোগ নিয়ে সংবিধানের ওই ভবিষ্যৎ দিশার শব্দগুলো মুছে ফেলা হোক ।  

     অথচ এটা ছিল ১৯৭৬ সালের সেই সময়, যখন ভারতে জরুরি অবস্থা চলছে। সেই সময় যখন সংবিধানের প্রস্তাবনায় 'সমাজতান্ত্রিক', 'ধর্মনিরপেক্ষ' , 'জাতীয় ঐক্য ও অখণ্ডতা' শব্দগুলো যুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু আজকের ফ্যাসিবাদী রাজনীতি আক্রমনের জন্য মাত্র দুটি শব্দ বেছে নিয়েছে - 'সমাজতান্ত্রিক' এবং 'ধর্মনিরপেক্ষ' - কারণ তৃতীয় শব্দ 'অখণ্ডতা' তাদের জাতীয়তাবাদী বক্তব্যকে খাদ্য-জল দেয়। এটা তো ইতিহাসের নির্মম ধর্ষণ, নয় কি ! যদি আপনি সত্যিই গণপরিষদের চেতনার কথা বলেন, তাহলে 'অখণ্ডতা' শব্দটি নিয়ে কেন কোনও নৈতিক অস্বস্তি নেই? কারণ উদ্দেশ্য সংবিধানের পবিত্রতা নয়, বরং ক্ষমতার সুবিধা, ক্ষমতার পরিসর বৃদ্ধি তাই “অখন্ডতা” শব্দটি নিয়ে আপত্তি নৈব নৈব চঃ । ইতিহাসকে এইভাবে কাটাছেঁড়া করে উপস্থাপন করা বিপজ্জনক, যা শুধুমাত্র সংবিধানের সঙ্গে নয়, পুরো গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে প্রতারণা। তাই ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হলে চাই সঠিক চেতনালব্ধ তথ্য যা জানতে সাহায্য করবে যে, এ এমন এক ব্যবস্থা তৈরি করে ,যেখানে নৈতিকতা মুনাফা দ্বারা নির্ধারিত হয়, যার প্রত্যেকটি ইমারতের পিছনে একটি করে অবহেলিত বস্তি থাকে।  সত্যিটা হ’ল , এই শ্রেণী, যারা নিজেদের জাতির মেরুদণ্ড বলে মনে করে, আসলে তারা সেই একই অসুস্থতার (ফ্যাসিজম) প্রতীক, যা থেকে সমাজের প্রত্যেকটি অসুস্থ জীবন্ত কোষ রক্ষা পেতে চায়।

     ফ্যাসিজম হচ্ছে , এমনই এক ব্যবস্থা যা যুগে যুগে সংশোধিত হয়ে সংস্কৃত হয়ে নিত্যনতুন উপায়ে মানুষের সহমত আদায় করে ক্ষমতায় টিকে থেকে পাহাড় প্রমাণ পুঁজির আকাঙ্খাকে চরিতার্থ করে চলেছে পুঁজির সঙ্কটমুক্তির উপায় হিসেবে । তাই পুঁজি বেছে বেছে প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রকে বাছাই করে , যেখানে তার বশংবদ হয়ে কাজ করে কোন কোন শাসক গোষ্ঠী ।

মিলি মুখার্জী
মিলি মুখার্জী

সমাজকর্মী