গত ২০ জুলাই, শেষ হয়েছে অরণ্য সপ্তাহ। এই বিশেষ সময়ে আমরা প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি আমাদের দায়িত্বের কথা নতুন করে ভাবি। অনেকেরই মনে প্রশ্ন আসতে পারে, ১৪ থেকে ২০শে জুলাইয়ের মধ্যে কি আমি অন্তত একটিও গাছ লাগিয়ে তাকে বড় করার সংকল্প নিয়েছি কিনা ? একেবারেই সঠিক প্রশ্ন। এরকম ছোট্ট একটি উদ্যোগই কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিশাল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তন আজ আমাদের বিশ্বের এক চরম বাস্তবতা। বিশ্ব উষ্ণায়ন, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, আকস্মিক বন্যা এবং দীর্ঘস্থায়ী খরা - এ সবই প্রকৃতির ভারসাম্যহীনতার ফল। আর এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো নির্বিচারে বৃক্ষনিধন এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ। গাছপালা বায়ুমণ্ডল থেকে অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে এবং জীবনদায়ী অক্সিজেন ত্যাগ করে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে। তারা মাটির উর্বরতা রক্ষা করে, ভূগর্ভস্থ জলস্তর বৃদ্ধি করে এবং অসংখ্য বন্যপ্রাণীর আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। তাই যত বেশি গাছ থাকবে, আমাদের পৃথিবী তত বেশি সুস্থ থাকবে, এবং আমরা ভবিষ্যতের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারব।
কামারপুকুরে বেড়াতে গিয়ে, "কামারপুকুর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট"-এর এই অসাধারণ সবুজায়নের কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। এই সমাজসেবী সংগঠনটি সবুজায়নের লড়াইয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তাঁদের সদস্যরা শুধু অরণ্য সপ্তাহেই নয়, বরং সারা বছরই বৃক্ষ সৃজনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এই বছরও শুভ রথযাত্রার দিন মেহগনি চারা বিতরণের মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের সংকল্পের শুভ সূচনা করেছিলেন। এই উদ্যোগের মাধ্যমে তাঁরা শুধু নতুন গাছ লাগিয়েই ক্ষান্ত হননি, বরং প্রতিটি চারাগাছকে বড় করে তোলার অঙ্গীকার নিয়েছেন, যা সত্যিই প্রশংসনীয়। অরণ্য সপ্তাহের শেষ দিনে, এই সংগঠনের সদস্যরা কামারপুকুর প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সকাল ৯টা থেকে সবুজায়নের কাজে লেগে পড়েছিলেন। এই স্থানটি বেছে নেওয়ার কারণ হলো, একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চারপাশে সবুজ পরিবেশ রোগীদের মানসিক শান্তি দিতে পারে এবং আরোগ্য লাভে সহায়তা করতে পারে। তাঁদের এই উদ্যোগ শুধু স্থানীয় পরিবেশের উন্নতিই সাধন করছে না, বরং একটি বার্তা দিচ্ছে যে পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তোলার দায়িত্ব আমাদের সকলের, এবং এই দায়িত্ব পালনে আমাদের নিরলসভাবে কাজ করে যেতে হবে।
এ বছর অরণ্য সপ্তাহে উল্লেখযোগ্য কিছু উদ্যোগ
২০২৫ সালের অরণ্য সপ্তাহও পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ এবং কর্মসূচির সাক্ষী হয়েছে। সরকার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা সম্মিলিতভাবে পরিবেশ সুরক্ষায় এগিয়ে এসেছে:
কলকাতা পৌরনিগম এই অরণ্য সপ্তাহে শহরজুড়ে প্রায় ২০ হাজার গাছ লাগানোর এক ambitious পরিকল্পনা নিয়েছে। শহরের ১৪৪টি ওয়ার্ডেই উদ্যানবিদরা রূপরেখা তৈরি করেছেন, কোথায় কোন গাছ লাগানো হবে এবং কীভাবে তার রক্ষণাবেক্ষণ হবে। এর মধ্যে ফল গাছ, নিম, দেবদারু, টেকোমা, করবী, ফুরুস, পলাশ, মহুয়া, রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া, বকুল, অশোক এবং জারুলের মতো বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রয়েছে। ফলের গাছের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে যাতে পাখিরা আশ্রয় ও খাবার পায়। এটি শহুরে সবুজায়ন এবং ঘূর্ণিঝড়ে ভেঙে পড়া গাছের ক্ষতিপূরণে বড় ভূমিকা রাখবে।
বন দফতর একটি নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে যেখানে নিছক নিয়মরক্ষার বৃক্ষরোপণ না করে, নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় "স্মৃতিবন" গড়ে তোলা হচ্ছে। এখানে মানুষ তাদের প্রয়াত প্রিয়জনদের স্মরণে গাছ লাগাতে পারবেন। এটি একদিকে যেমন স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি, তেমনই বনায়ন প্রক্রিয়াকে দীর্ঘস্থায়ী ও অর্থবহ করে তুলছে। এর মাধ্যমে রাজ্যের বনভূমি বাড়ানোই মূল লক্ষ্য।
পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ ওয়েলফেয়ার কমিটি পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ লাইনে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির মাধ্যমে অরণ্য সপ্তাহের উদ্বোধন করেছে। মেদিনীপুরের সাংসদ জুন মালিয়া, কলকাতার পুলিশ অফিসার সান্তনু সিনহা বিশ্বাস, এবং জেলা পুলিশ সুপার ধৃতিমান সরকার সহ বিশিষ্টজনেরা এতে অংশ নেন। এটি সরকারি সংস্থাগুলোর পরিবেশ সুরক্ষায় অংশগ্রহণের একটি চমৎকার উদাহরণ।
রামনগর কলেজ এবং আনন্দ মোহন কলেজের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অরণ্য সপ্তাহ পালনে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে। এনএসএস (NSS) ইউনিট এর স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, সেমিনার এবং আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। এ বছর মেদিনীপুরের বিভিন্ন কলেজে ৩০ জুন থেকে ৬ জুলাই পর্যন্ত অরণ্য সপ্তাহ পালিত হয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা পরিবেশ সুরক্ষায় গাছের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করছে এবং বৃক্ষরোপণ করছে।
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, মেদিনীপুরের কিছু কলেজ কেন সরকারি ঘোষিত দিনের (১৪-২০ জুলাই) আগে (৩০ জুন থেকে ৬ জুলাই পর্যন্ত) অরণ্য সপ্তাহ পালন করেছে। আসলে, "অরণ্য সপ্তাহ" মানুষকে বৃক্ষরোপণ এবং পরিবেশের প্রতি সচেতন করার একটি প্রচেষ্টা। এর মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষকে বৃক্ষরোপণে উৎসাহিত করা এবং পরিবেশ সুরক্ষায় তাদের দায়িত্ব মনে করিয়ে দেওয়া। এই নির্দিষ্ট সরকারি সময়সীমার বাইরেও যেকোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সবুজায়নের জন্য কাজ করতে পারে এবং করা উচিত। পরিবেশ বাঁচানোর দায়িত্ব আমাদের সকলের, এবং এর জন্য কোনো নির্দিষ্ট দিনের অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব একাডেমিক ক্যালেন্ডার এবং সুবিধার উপর ভিত্তি করে এই ধরনের সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিজস্ব সময়ে পালন করতেই পারে।
এই বছর অরণ্য সপ্তাহের নতুনত্ব হলো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ও সুর করা গান - "সবুজ বাঁচাও, সবুজ দেখাও। সবুজের মাঝে, বিবেক জাগাও…" এই গানের সাহায্যে বনসৃজন ও পরিবেশ বাঁচানোর বার্তা দেওয়া হয়েছে।
আর বিশেষত্ত্ব হল, রাজভবন ফ্রি প্রাইমারি স্কুলের ( এটি একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, যা রাজভবন চত্বরের কাছাকাছি অবস্থিত। যেখানে রাজভবনের স্টাফ কোয়ার্টারের শিশুদের পাশাপাশি আশেপাশের বস্তির এবং কঠিন পরিস্থিতিতে থাকা শিশুদের শিক্ষা দেওয়া হয়) ছোট্ট পড়ুয়াদের গাছ লাগানো। এ বারের অরণ্য সপ্তাহে এই প্রাথমিক স্কুলের বাচ্ছারা রাজভবনের বাগানে ১০১টি গাছ লাগিয়ে পরিবেশ সচেতনতায় অংশ নিয়েছে।
সরকার, স্কুল ও কলেজের করণীয়
যদিও এই বছর অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তবুও জলবায়ু পরিবর্তনের বিশাল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর আরও অনেক কিছু করার আছে।
সরকারের উচিত কেবলমাত্র অরণ্য সপ্তাহে সীমাবদ্ধ না থেকে সারা বছর ধরেই একটি দীর্ঘমেয়াদী বনায়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা। এই পরিকল্পনায় শুধু গাছের চারা রোপণ নয়, তার নিয়মিত পরিচর্যা এবং বেড়ে ওঠার বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। ১০০ দিনের কাজের কর্মীদের অভাবে গাছের পরিচর্যায় যে সমস্যা দেখা গেছে, তার একটি স্থায়ী এবং কার্যকর সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। একইসাথে, বেআইনি গাছ কাটা এবং বনভূমি দখলের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। বনাঞ্চল বৃদ্ধি সংক্রান্ত তথ্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং গবেষণার জন্য রিমোট সেন্সিং ডেটা সর্বজনীনভাবে প্রকাশ করা উচিত, যাতে গবেষকরা সঠিক চিত্র বিশ্লেষণ করতে পারেন। বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন উৎসাহ ও সচেতনতামূলক প্রচার বাড়ানোর দিকেও সরকারকে নজর দিতে হবে।
অন্যদিকে, স্কুল ও কলেজগুলোর দায়িত্ব হলো পরিবেশ সচেতনতা বাড়াতে পাঠ্যক্রমে পরিবেশ শিক্ষাকে আরও নিবিড়ভাবে যুক্ত করা, যাতে ছোটবেলা থেকেই শিক্ষার্থীরা এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে। শিক্ষার্থীদের জন্য নিয়মিত কর্মশালা, সেমিনার এবং পরিবেশ সচেতনতামূলক ফিল্ড ট্রিপের আয়োজন করা উচিত, যেখানে তারা স্থানীয় পরিবেশ সমস্যাগুলো সরাসরি দেখতে পারবে এবং সমাধান নিয়ে ভাবতে শিখবে। প্রতিটি স্কুল-কলেজে সক্রিয় "সবুজ ক্লাব" গঠন করা দরকার, যা সারা বছর ধরে পরিবেশ সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবুজায়নের মনোভাব গড়ে তুলবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত তাদের ক্যাম্পাসকে আরও পরিবেশবান্ধব করে তোলা, যেমন - বৃষ্টির জল সংরক্ষণ, সৌরশক্তির ব্যবহার, বর্জ্য পৃথকীকরণ এবং কম্পোস্ট তৈরি ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা।
আমাদের ব্যক্তিগত করণীয়
অরণ্য সপ্তাহ কেবল একটি প্রতীকী উদযাপন নয়, এটি আমাদের সকলের জন্য একটি আহ্বান - পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হতে এবং নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য একটি সবুজ পৃথিবী গড়ে তুলতে। আসুন, এই সংকল্পকে আমরা প্রতিদিনের জীবনে প্রতিফলিত করি।
আমাদের প্রত্যেকের উচিত দায়িত্বশীল নাগরিক হওয়া। এর মানে শুধু গাছ লাগানো নয়, গাছকে বড় করে তোলার দায়িত্ব নেওয়া এবং নিজের বাড়িতে বা আশেপাশে লাগানো গাছের নিয়মিত পরিচর্যা করা। নিজের পরিচিত মহলে বৃক্ষরোপণ এবং পরিবেশ সংরক্ষণের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা এবং অন্যদের উৎসাহিত করা জরুরি। এছাড়াও, প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো, বর্জ্য পুনর্ব্যবহার করা এবং কম বর্জ্য তৈরি করার অভ্যাস গড়ে তোলা আমাদের সকলের দায়িত্ব।