About Us | Contact Us |

স্বর্গের দাস না, নরকের রাজা

স্বর্গের দাস না, নরকের রাজা


ঢাকা আর কলকাতা এক থাকলে বাঙালি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যেত। বাঙালি হিন্দু হত সংখ্যালঘু। ১৯৩২ সালে র‍্যামসে ম্যাকডোনাল্ডের সেপারেট ইলেক্টরেট যে ভোট ব্যবস্থার জন্ম দেয়, তা ছিল একরকম সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের প্রতিফলন। এর প্রথম রাজনৈতিক প্রতিধ্বনি শোনা যায় ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে। নির্বাচনের ফলাফলে স্পষ্ট হয়—বাংলায় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব মানেই মুসলিম লীগের আধিপত্য নয়। বরং সেটা ছিল নিম্ন বর্ণ মুসলমান কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। আর এই সম্ভাবনাটাই ছিল হিন্দু ভদ্রলোক সমাজের সবচেয়ে বড় আতঙ্ক।

তারা বুঝে যায়, বাংলা যদি অখণ্ড থাকে, তাহলে একদিন শ্রেণি কাঠামো ভেঙে পড়বে। বাংলাকে ভাগ করতেই হবে। না হলে রাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্য চলে যাবে ‘তাদের’ হাতে। এই আশঙ্কা থেকেই বাংলা ভাগের পেছনে জোরাল হয়ে ওঠে শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার এক ‘শুদ্ধতাবাদী’ যুক্তি। “আমরা” আর “ওরা”—এই বয়ান তৈরি হয়। সেল্ফ-আদার স্টাইলে।

আর আদাররাই হল সেই শ্রেণি—যাদের শরীর ও শ্রমে গড়ে ওঠে সভ্যতা, অথচ যাদের মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যায় না। সুনীলের অরণ্যের দিনরাত্রি অবলম্বনে সত্যজিৎ যে ছবি বানান, তাতে এক চকচকে জ্যোৎস্নার রাতে সাঁওতাল রমণীকে ভোগ করার দৃশ্যটি আজও সেই ‘ভদ্রলোক সভ্যতা’র নরম অভিপ্রায় ফাঁস করে দেয়। এভাবেই এক আদার নির্মিত হতে থাকে।

১৯০৫ সালে যে বাঙালি কার্জনের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল, সেই একই বাঙালির একটি বড় অংশ ১৯৪৭-এ বাংলা ভাগের পক্ষে দাঁড়ায়। প্রশ্ন জাগে—এতোদিন যারা বাংলা জাতীয়তাবাদের কথা বলছিল, তারা হঠাৎ এই বিভাজনের পক্ষে কেন?

কারণ ছিল। বাংলাভাগ মানে হিন্দু বাঙালির জন্য একটি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঙ্গরাজ্য। যেখানে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার কথা ছিল, সেখানে তারা বেছে নেয় রাজনৈতিক আরাম। এক টুকরো রাজ্য। নিরাপদ। হেজেমনির জন্য উপযোগী।

স্বর্গের দাস হয়ে থাকার চেয়ে নরকের রাজা হওয়া ভালো—এই প্রবচনটাই বাংলা ভাগের দর্শন হয়ে দাঁড়ায়।

হলও তাই। পশ্চিমবঙ্গ জন্ম নিল। সাতচল্লিশ থেকে আজ পর্যন্ত, এই লেখাটি যখন লিখছি তখন পর্যন্ত, তারা সেই হেজেমনির বৃত্ত থেকে বেরোতে পারেনি। বরং নিজেরাই আজ অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। রাষ্ট্র, পে-লোডারে চাপিয়ে, ঠেলে দিচ্ছে বর্ডারের ওপারে। ঠিক যেন থার্ড গ্রেডের কমার্শিয়াল সিনেমা। এর থেকে বাল্যকালে গ্রামীণ ভিডিওতলায় লুকিয়ে লুকিয়ে বসে বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না দেখা ভালো ছিল।

এসব দৃশ্য দেখে একদল উজবুক মজা পায়। আরেকদল তথাকথিত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন “বুজুর্গ” মমতাকে সম্প্রীতির দেবী বলে মানে। ভক্তরা খায় গড়াগড়ি, দেবী বিলায় বাতাসা।

এই পশ্চিমবঙ্গে, সমগ্র বাঙালির লাভ কী? চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, বৈষ্ণবধামগুলো  কীভাবে আরএসএস-এর কার্যালয়ে রূপ নিচ্ছে। নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের আওয়াজে হিন্দুত্ববাদ মূলধারার রাজনীতিকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। আনন্দবাজারীয় সংস্কৃতিতে ফলবতী সাহিত্যিকের ঢেঁকুরে মন টেকে না। এই সময়েই ছড়ানো হচ্ছে “রোহিঙ্গা” আতঙ্ক।

প্রশ্ন জাগে—রোহিঙ্গা কারা? বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার) থেকে বিতাড়িত হয়ে তারা বাংলাদেশ হয়ে পশ্চিমবঙ্গে এসেছে। বলা হচ্ছে, এদের সংখ্যা ১.৫ কোটি! এই কথাটাই এখন ঢাল। অথচ এই “রোহিঙ্গা” শব্দের আড়ালে আসলে কারা টার্গেট হচ্ছে, তা গোপন নয়।

রোহিঙ্গা = বাঙালি মুসলমান—এই ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করতে লক্ষ লক্ষ টাকার ক্যাম্পেইন চলছে। সেই তালিকায় আজ যোগ হয়েছে বিশ্বাস, শীল, মতুয়া—লোয়ার কাস্ট হিন্দুরাও। বোঝা যায়, টার্গেট মূলত ভাঙা ভাষা, ভাঙা বর্ণ, ভাঙা শরীর।

এখন প্রশ্ন—বাঙালি কি এক হতে পারবে? নাকি মোদীর হিন্দুত্ব আর মমতার হিন্দুত্বে ভাগ হয়ে যাবে? বিহারে যেখানে এখনও আরজেডি, সিপিআই(এমএল)-এর মতো শক্তিশালী বিরোধী দল আছে, সেখানেও S.I.R হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে ঠেকানো যাবে?

এখানেও হবে—S.I.R। বিরোধীরা চিৎকার করছে, কিন্তু শেষমেশ নির্বাচন কমিশনের কাঁধে ভরসা রেখেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচছে। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী রোড শো করছেন। আইনের জায়গায় নীরবতা। “বাঙাল খেদাও” অভিযানের বিরুদ্ধে তিনি নাকি ভাষা আন্দোলন করছেন, অথচ আদালতে ওবিসি ঝুলে আছে।

ওয়াকফ নিয়ে ট্যাফু করা যাবে না। সামসেরগঞ্জসহ মালদা-মুর্শিদাবাদের গঙ্গা-পদ্মা তীরবর্তী অঞ্চলগুলো প্রতি বছর ভাঙনের শিকার হচ্ছে। গঙ্গা পদ্মা আর রাষ্ট্রীয় শক্তি মিলে একে একে গিলে খাচ্ছে ভূতনীর চর, আরও অনেক জনপদ। সেসব নিয়ে কেউ কথা বলে না।

ভোট হয়। নদীর জল কুলকুল করে। ধারে ধারে কাশবন দোলে। তবু প্রশ্ন রয়ে যায়—এই সার্বর্ণ হিন্দুদের লালিত হেজেমনির কাঠামো কি অপরিবর্তিত থাকবে? নাকি সময়ের সাপেক্ষে পশ্চিমবঙ্গ একদিন ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতরে সম্পূর্ণভাবে বিলীন হয়ে যাবে?

আলিউজ্জামান মুদ্রা
আলিউজ্জামান মুদ্রা

কবি, প্রাবন্ধিক