বাংলার ইতিহাসে যখন নারীরা ছিল পর্দার অন্তরালে, তখনই এক নারীর কলম আর সংগ্রাম অন্ধকার ভেদ করে আলো ছড়িয়ে দিয়েছিল। তিনি ছিলেন বেগম রোকেয়া। তাঁর সাহসী পদক্ষেপ, সমাজ সংস্কারের অঙ্গীকার আর নারীদের শিক্ষার জন্য নিরলস লড়াই আজও আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায়। এক জমিদার পরিবারে জন্ম নিয়েও তিনি সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। জীবনের প্রতিটি ধাপে বাঁধা, তবু দমে যাননি তিনি। কলমকে করেছেন হাতিয়ার, গড়ে তুলেছেন নারী জাগরণের মশাল।
বাঙালি মুসলমান নারী জাগরণের তিনি ছিলেন অন্যতম একজন পথিকৃৎ। সালটা ১৮৮০,৯ই ডিসেম্বর বর্তমান বাংলাদেশের রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। জমিদার পরিবার হলেও বাড়তি কোনো সুযোগ সুবিধা পায়নি সেই ছোট্ট মেয়েটি তথা আজকের নারী জাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ । শৈশব থেকেই শিক্ষার প্রতি তার প্রবল আগ্রহ এবং অজানাকে জানার ইচ্ছে । কিন্তু এই শিক্ষার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় তার পরিবারের রক্ষণশীলতা। কারণ সেই সময় তাঁদের পরিবারে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর কোন চল ছিল না।আর তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় ঘরের বাইরে গিয়ে মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভেরও কোন সুযোগ ছিল না। তবে ইচ্ছে থাকলে যে কোনো বাধাই কাউকে থামাতে পারেনা তার প্রমাণ দিয়েছিল পাঁচ বছর বয়সেই বেগম রোকেয়া। তখনও অবশ্য সাখাওয়াত হোসেন হয়ে ওঠেনি সেই একরত্তি মেয়েটি। যার দুচোখে পাহাড় সমান স্বপ্ন আর অজেয়কে জয় করার অদম্য মনোবল। তার দুই দাদা ইব্রাহিম ও খলিল পড়াশোনা করতেন আর গোপনে দাঁড়িয়ে তা শুনে শুনেই মুখস্থ করা শুরু করলো রোকেয়া । অবশ্য দাদার স্নেহেই পরবর্তীতে বাংলা ও ইংরেজি রপ্ত করেন তিনি।রোকেয়ার জীবনীকার সামসুন নাহারের কথায় "গভীর রাত্রে পৃথিবী অন্ধকারে ঢাকিয়া যায় আর সেই সঙ্গে জ্বলিয়া উঠে দুটি কিশোর-কিশোরীর শয়নকক্ষে স্তিমিত দীপ শিখা। চোখ মুছিয়া সেই নিরব নিশিথে দুই ভাইবোনে মোমবাতির পাশে বসেন। জ্ঞান দান করেন ভাই আর বালিকা ভগ্নি সেই জ্ঞান সুধা আকন্ঠ পান করেন।" রোকেয়া এভাবেই শিক্ষা গ্রহণ করেন। তবে শুধুমাত্র বাংলা ও ইংরেজি নয়। পাশাপাশি উর্দু,আরবি, ফারসি ভাষাও শেখেন। তবে তখন কে জানতো যে তার জন্য আরও অনেক বড় কিছু দায়িত্ব অপেক্ষা করছে। একটা অধ্যায়ের সূচনা হবে তার কলমেই। অবশ্য সেই অধ্যায়ের শুরুটা একটু অন্যভাবে হলো। মাত্র ষোলো বছর বয়সে
বিহারের ভাগলপুরে এক অভিজাত পরিবারে বিয়ে হয় রোকেয়ার, বিপত্নীক সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। শিক্ষালাভে বড় দুভাই ও বড় বোনের ভূমিকা থাকলেও রোকেয়ার আসল লেখাপড়া শুরু হয়েছিল বিয়ের পর স্বামীর সাহচর্যে। রোকেয়া অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের জন্য। সাখাওয়াত ছিলেন উদার মনের মানুষ। স্বামীর সাহচর্যেই এতদিনে ইংরেজিটাও দারুণ দখলে এনেছিলেন রোকেয়া। বেগম রোকেয়ার সাহিত্যচর্চ্চার সূত্রপাতও হয়েছিল স্বামীর অনুপ্রেরণায়। তাঁর সাহিত্যজীবন শুরু হয় ১৯০২ সালে 'পিপাসা' নামে একটি বাংলা গদ্য রচনার মধ্যে দিয়ে। কিন্তু ১৯০৯ সালের ৩ রা মে স্বামী সাখাওয়াত হোসেন এর মৃত্যুর পর স্বামীর আগের পক্ষের মেয়ে ও জামাইয়ের অত্যাচারে তিনি কলকাতা চলে আসেন এবং নারী জাগরণে নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে নিয়োজিত করেন। স্বামী বিয়োগের যন্ত্রণা, ভাগলপুরের স্মৃতি, বিভিন্ন সামাজিক ও আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যে তিনি ১৯১১ সালের ১৬ই মার্চ কলকাতার ১৩ নং ওয়ালিউল্লাহ লেনের একটি বাড়িতে শুরু করলেন 'সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল'। মাত্র
আটজন ছাত্রীকে নিয়ে শুরু হয়েছিল কলকাতায় সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের যাত্রা। সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গালর্স হাই স্কুল কয়েকবার স্থান বদল করে এখন কলকাতার লর্ড সিনহা রোডে প্রথম সারির সরকারি মেয়েদের স্কুল। যদিও স্কুলটি তিনি প্রথম শুরু করেন ভাগলপুরে ১৯০৯ সালের পয়লা অক্টোবর। এই পথেও এসেছে অজস্র বাধাবিপত্তি। কিন্তু কোনো কাঁটাই তার পথ আটকাতে সফল হয়নি। অজস্র প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে তিনি "সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল" এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এরপর মুসলিম সমাজের কুসংস্কার তথা নারী শিক্ষায় উদ্যোগী হন তিনি। মুসলিম মহিলাদের ঐক্যবদ্ধ করে সমাজে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ১৯১৬ সালে শুরু করেন "আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম"নামে একটি সমিতি। এই সমিতি " ক্যালকাটা মোহামেডান লেডিস এসোসিয়েশন "নামে পরিচিতি লাভ করে। এই সমিতির লক্ষ্য ছিল নারীরা যাতে স্বাবলম্বী হয়। সেই সময় সমাজের বেড়াজাল টপকে সভা সমিতিতে নারীদের যোগ দেওয়া প্রায় দুঃস্বপ্নের মতো ছিল কিন্তু রোকেয়ার অদম্য মনোবলে তা সম্ভব হয়। আজীবন তিনি বলে গেছেন মহিলারা যদি পিছিয়ে থাকে তবে সমাজ ও দেশের উন্নতি হবেনা। নারীর এগিয়ে চলার জন্য শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা এবং নারী পুরুষের মধ্যে সমতার পক্ষে তিনি যুক্তি তুলে ধরেছেন তাঁর লেখা ও কাজে। নারী সচেতনতার মর্মস্পর্শী প্রকাশ বার বার তার কলমে ফুটে উঠেছে। মুসলিম নারী সমাজের দুঃখ দূর্দশা ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতার চিত্র রোকেয়ার রচিত ছোটগল্প,উপন্যাস,কবিতা ও প্রবন্ধগুলিতে ধরা দিয়েছে। তিনি অন্তঃপুর বন্দিনী নারীদের মুক্তির জন্য আজীবন লড়াই করেছেন তার শক্তিশালী কলমের মধ্য দিয়ে।যার ফলে তার রচনা সহজেই সাহিত্য জগতে জায়গা করে নিয়েছে। তার রচিত মতিচূর(প্রথম খন্ড) প্রবন্ধ সংকলনটি ১৯০৫ সালে প্রকাশিত হয় এবং দ্বিতীয় খন্ডটি প্রকাশিত হয় ১৯২১ সালে। এই প্রবন্ধে রোকেয়া মুসলিম নারীদের জাগাতে চেয়েছিলেন। তাদের প্রকৃত অর্থে স্বশিক্ষিত হয়ে ওঠার আহবান জানিয়েছেন। তার পদ্মরাগ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯২৮ সালে। এই উপন্যাসে পুরুষশাসিত সমাজে নারীরা চরম অত্যাচার নিপীড়নের শিকার হয়েছে। তারই ক্ষতবিক্ষত ছবি তুলে ধরেছেন পদ্মরাগে। এই উপন্যাস তাকে কালজয়ী সাহিত্যের শিরোপা দেয়।অবরোধবাসিনী প্রকাশিত হয় ১৯৩১ সালে।তৎকালীন সমাজের নারীদের দূর্দশার অন্যতম দলিল এটি। পর্দার বেড়াজালে নারীর যন্ত্রণার ছাপ এই গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে। যদিও ব্যক্তিগত জীবনে রোকেয়া নিজেও বোরখা ব্যবহার করতেন। সমাজ থেকে তিনি কখনোই পর্দাকে তুলে দিতে চাননি। যখন পরনারীর সামনেও পর্দা রাখতে হয়েছে তখনই তিনি প্রতিবাদী হয়েছেন তার বিরুদ্ধে। এছাড়া তার উল্লেখযোগ্য রচনা ‘সুলতানার স্বপ্ন’(অনুদিত)। এছাড়াও ‘পরী-ঢিবি’, ‘তিনকুড়ে’, 'বিয়েপাগলা বুড়ো’ ইত্যাদি। প্রবন্ধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ‘চাষার দুক্ষু, ‘এন্ডিশিল্প’, ‘লুকানো রতন’ ইত্যাদি। এছাড়া তিনি লিখেছেন ৬টি ছোট গল্প ও রস-রচনা এবং ৭টি কবিতার বই। সুলতানার স্বপ্ন ১৯০৫ সালে প্রকাশিত হয়। যেটিকে বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যে একটি মাইলফলক ধরা হয়। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবার আগে তার লেখাগুলো নবনূর, সওগাত, মোহাম্মদী ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়াও তার অজস্র প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তিনি নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আর লিঙ্গসমতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। তবে নারীদের জন্য যে সমাজ ও পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছেন তিনি আজীবন। তা বোধহয় আজও অধরাই থেকে গেছে। এখনও সমাজে বহু জায়গায় মেয়েদের শিক্ষাকে ভালো চোখে দেখা হয়না। এমনকি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে আজও সরকারকে আইন প্রয়োগ করতে হয়! তাই বেগম রোকেয়া আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। শিক্ষা সংস্কৃতি ও নারী জাগরণের আলোকে হিন্দু মুসলিম উভয় ক্ষেত্রেই তিনি নারী জাগরণের অন্যতম অগ্রদূত। মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তবে বেগম রোকেয়া আজও বাঙালির হৃদয়ে সমানভাবে বিরাজমান। এমন মাইল ফলকদের কখনও মৃত্যু হয়না বোধহয়।