About Us | Contact Us |

পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষকদের বিএলও নিয়োগ: ভোটার তালিকা সংশোধন না কি এনআরসি-র আড়াল?

লিখেছেন : পাশারুল আলম
পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষকদের বিএলও নিয়োগ: ভোটার তালিকা সংশোধন না কি এনআরসি-র আড়াল?

বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে একটি বিশেষ নিবিড় সংশোধন (Special Intensive Revision - SIR) প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, যার মূল উদ্দেশ্য ভোটার তালিকা সংশোধন। তবে এই প্রক্রিয়া নিয়ে রাজ্যজুড়ে রাজনৈতিক বিতর্ক, শিক্ষক সমাজের উদ্বেগ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ছে। এই প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে রয়েছেন রাজ্যের সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা, যাঁদের নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে বুথ লেভেল অফিসার (BLO) হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য করা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়াকে ঘিরে উঠছে এক প্রশ্ন—এটি কি নিছক ভোটার তালিকা সংশোধন, না কি এনআরসি চালুর এক সূক্ষ্ম ভূমিকা?


প্রক্রিয়ার সারসংক্ষেপ:

নির্বাচন কমিশন অফ ইন্ডিয়া (ECI) এবং রাজ্য সরকারের সহযোগিতায় ২০২৫ সালের জুলাই মাস থেকে রাজ্যজুড়ে শুরু হয়েছে ভোটার তালিকা পরিশোধনের বিশেষ অভিযানের কাজ। এই অভিযানের লক্ষ্য মূলত নকল ও দ্বৈত ভোটার চিহ্নিত করে তালিকা থেকে অপসারণ করা। এই কাজে মাঠ পর্যায়ে নিযুক্ত করা হয়েছে শিক্ষক সমাজকে, যাঁদের ‘Designated Officer cum Custodian and Booth Level Officer’ (BLO) হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে।

শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ইতিমধ্যেই আলিপুর ডিএম অফিসে শুরু হয়েছে, এবং জেলার অন্যান্য অংশেও তা সম্প্রসারিত হচ্ছে। রাজ্যের অন্যান্য জেলার BLO দের ট্রেনিং হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। 

রাজনৈতিক বিতর্ক ও এনআরসি সংশয়:

রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস সহ একাধিক বিরোধী রাজনৈতিক দল এই প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র স্পষ্টভাবেই বলেছেন, এটি গরিব, কাগজপত্রবিহীন মানুষের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার কৌশল হতে পারে। এই আশঙ্কা একেবারে ভিত্তিহীন নয়—কারণ আসামে এনআরসি প্রক্রিয়ার পরে বহু বাঙালি হিন্দু-মুসলিম মানুষের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়েছিল। অন্য দিকে বিহারের চলমান ঘটনাবলী সাধারণ মানুষকে চিন্তিত করেছে।
নির্বাচন কমিশন যদিও দাবি করেছে এটি শুধুই একটি স্বাভাবিক সংশোধন প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক বাস্তবতা অন্য ইঙ্গিত দিচ্ছে।

 শিক্ষক সমাজের ভূমিকা ও নীরবতা:

শিক্ষকদের প্রধান দায়িত্ব হল শিক্ষাদান। কিন্তু ভোটার তালিকা সংশোধনের মতো প্রশাসনিক কাজে তাঁদের নিযুক্ত করা হয়েছে। এতে তাঁদের উপর বাড়তি চাপ পড়েছে এবং শিক্ষার মানেও প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হল—এই নিযুক্তির বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত কোনও শিক্ষক সংগঠন সুস্পষ্টভাবে প্রতিবাদ জানায়নি। এটি কি শিক্ষক সমাজের নীরব সমর্থন, না কি প্রশাসনিক চাপ ও ভয়ের ফল? সেই প্রশ্ন আজ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

একদিকে নির্বাচন কমিশনের দাবি অনুযায়ী এটি একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া, অন্যদিকে রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের একটি অংশ আশঙ্কা করছে এটি একটি বৃহত্তর পরিচয় যাচাই প্রক্রিয়ার সূচনা। এই দোটানার মধ্যে শিক্ষক সমাজ জড়িয়ে পড়েছে এক অদ্ভুত প্রশাসনিক দ্বিধাদ্বন্দ্বে—তাঁরা নাগরিকদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করছেন, না কি তাঁদের বঞ্চিত করার যন্ত্র হয়ে উঠছেন?

পরিশেষে বলা যায়, শিক্ষকদের বিএলও হিসেবে নিয়োগ এবং বিশেষ সংশোধন প্রক্রিয়া কেবল একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং তা একটি রাজনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক প্রশ্ন তুলে ধরেছে। ভোটার তালিকা বিশুদ্ধিকরণ অবশ্যই একটি জরুরি কাজ, তবে তার নাম করে যদি এনআরসি-র মতো বিতর্কিত পদক্ষেপ বাস্তবায়নের পথে এগোনো হয়, তবে গণতন্ত্রের ভিত্তিই নড়ে যাবে। শিক্ষক সমাজ, নাগরিক সমাজ ও সংবাদ মাধ্যমের সম্মিলিত নজরদারি এবং প্রতিবাদই পারে এই প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও মানবিক রাখতে।

পাশারুল আলম
পাশারুল আলম

সমাজকর্মী