এ এক গভীর বিদ্রূপ যে, এদেশে কিছু রাজনৈতিক শক্তি বিশেষত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (RSS) ও হিন্দু মহাসভা, হঠাৎ করে আজ নিজেদের ‘সর্বাধিক জাতীয়তাবাদী’ বলে দাবি করে চলেছে। তারা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় কার্যত কোনো ভূমিকা রাখেনি। বরং তাদের আদর্শগত ভিত্তি ছিল সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, যা ব্রিটিশবিরোধী ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিপরীত। এই প্রবন্ধ RSS ও হিন্দু মহাসভার রাজনৈতিক অবস্থান, মতাদর্শগত উৎস এবং জাতীয় আন্দোলন থেকে তাদের ইচ্ছাকৃত দূরত্ব বজায় রাখার কারণ বিশ্লেষণের চেষ্টা।
বিদ্রূপ ও ঐতিহাসিক অন্ধকার:
ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস এক মহান গণ-সংগ্রামের ইতিহাস। যেখানে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টান, আদিবাসী, নারী, কৃষক, শ্রমিক সকলেই একত্রে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়েছেন। এই ইতিহাসের ভেতরে RSS ও হিন্দু মহাসভার অনুপস্থিতি আজ এক অস্বস্তিকর প্রশ্ন উত্থাপন করে: কেন এই তথাকথিত জাতীয়তাবাদীরা প্রকৃত জাতীয় সংগ্রাম থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখেছিল? এ প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে তাদের মতাদর্শের ভিতরে। যা একটি সংকীর্ণ, ধর্মনির্ভর জাতীয়তার ধারণা। এই মতাদর্শ ভারতের বহুত্ববাদী স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে মৌলিকভাবে অসঙ্গত।
আদর্শগত উৎস : হেডগেওয়ার, মুনজে ও সাভারকর
১৯২৫ সালে ড. কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার RSS প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর গুরু ছিলেন ড. বি.এস. মুনজে –একজন হিন্দু মহাসভা নেতা, যিনি ১৯৩০-এর দশকে ইতালিতে গিয়ে মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ অধ্যয়ন করেছিলেন। মুনজের ভাবনায় ছিল ফ্যাসিবাদী কাঠামো থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে হিন্দু সমাজকে “সামরিকীকৃত সংগঠন”-এ রূপান্তর করা (Casolari, In the Shadow of the Swastika, 2000)। অন্যদিকে, ১৯২৩ সালে প্রকাশিত ‘Hindutva: Who is a Hindu?’ গ্রন্থে বিনায়ক দামোদর সাভারকর
“পিতৃভূমি ও পুণ্যভূমি”-র ধারণা প্রচার করেন। যা আসলে ভারতীয় মুসলমান ও খ্রিস্টানদের জাতীয় পরিচয় থেকে বাদ দেওয়া। এইভাবে RSS ও হিন্দু মহাসভার জাতীয়তাবাদ হয়ে ওঠে এক ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ। যার মূল লক্ষ্য ছিল মুসলমান-বিরোধিতা, ব্রিটিশবিরোধিতা নয়।
স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে দূরে থাকা: কৌশল নাকি আনুগত্য?
RSS-এর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯২৫ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত কোন জাতীয় আন্দোলনে তাদের অংশগ্রহণের রেকর্ড নেই। সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলন (১৯২৮), পূর্ণ-স্বাধীনতার ঘোষণার পর ১৯৩০ সালের ‘স্বাধীনতা দিবস’ কিংবা ১৯৩০-৩২ সালের ‘সিভিল ডিসঅবিডিয়েন্স’ আন্দোলন – সবক্ষেত্রেই RSS অনুপস্থিত। RSS-এর প্রতিষ্ঠাতা হেডগেওয়ার ব্যক্তিগতভাবে কারাবরণ করলেও, সংগঠন হিসেবে তিনি RSS-কে দূরে রাখেন। এই বিচ্ছিন্নতাই প্রকাশ করে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান: আইনানুগ ও ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন থেকে আলাদা থাকা।
এমনকি Quit India Movement (১৯৪২)-এর সময় RSS নেতারা তাঁদের সদস্যদের “কংগ্রেসের বিশৃঙ্খলা থেকে দূরে থাকতে” নির্দেশ দেন [Home Department Report, 1942, File No. 28/8/42-Pol (I)]।
“১৯৩৯ সালের এপ্রিলে সুভাষচন্দ্র বসু গোপাল মুখুন্দ হুদ্দার নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেন, যিনি RSS প্রতিষ্ঠাতা হেডগেওয়ারের পুরানো সহকর্মী ছিলেন। বসুর অনুরোধ ছিল –তিনি যেন হেডগেওয়ারের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেন। হুদ্দার এই অনুরোধ জানাতে দেনোলি যান, যেখানে হেডগেওয়ার একজন ধনী সঙ্গীর সঙ্গে ছিলেন। পরে হুদ্দার জানান যে “ডক্টর সাহেব” (যেমন করে হেডগেওয়ারকে সবাই সম্বোধন করতেন) সুস্থই ছিলেন; কারণ তিনি তখন কয়েকজন তরুণ ভক্তের সঙ্গে হাসি-আড্ডায় মেতে ছিলেন। তবু তিনি অসুস্থতার অজুহাতে সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করেন। স্বাভাবিকভাবেই, “হিন্দুত্ববাদী নেতাদের জাতীয়তাবাদী ভূমিকা নতুন করে পুনর্গঠনের যে প্রচেষ্টা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চলছে, তাতে এই ঘটনার কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না” (ড: মৃদুলা মুখার্জি, The Wire, 02-10-2025)।
১৯৪০ সালের জুলাইয়ে তাঁর গ্রেপ্তারের কিছুদিন আগে, সুভাষচন্দ্র বসু সাভারকার এবং জিন্নাহর সাথে দেখা করেছিলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য একটি যৌথ ফ্রন্ট তৈরি করার প্রচেষ্টায়। কিন্তু তাঁর স্মৃতিকথায় (The Story of My Struggle, Part 2) সুভাষচন্দ্র লিখেছেন – “জিন্নাহ তখন শুধু চিন্তা করছিলেন কীভাবে ব্রিটিশদের সাহায্যে তাঁর পাকিস্তানের পরিকল্পনা (ভারত বিভাগ) বাস্তবায়ন করা যায়”। এবং সাভারকার মনে হচ্ছিল “আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে উদাসীন এবং শুধু চিন্তা করছিলেন কীভাবে হিন্দুরা ভারতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে প্রবেশ করে সামরিক প্রশিক্ষণ পেতে পারে”।
এইসব প্রমাণ স্পষ্ট করে যে RSS-এর মূল লক্ষ্য কখনোই ছিল না স্বাধীনতা অর্জন। বরং ব্রিটিশ বিরোধিতার পরিণতিতে যে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হতো, তা এড়ানোই ছিল তাদের লক্ষ্য।
হিন্দু মহাসভার সহযোগিতা ও সাভারকারের ভূমিকা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, যখন কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের যুদ্ধনীতির প্রতিবাদে পদত্যাগ করে, তখন সাভারকারের নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভা “ব্রিটিশদের বন্ধু হওয়ার” আহ্বান জানায়। সাভারকার ঘোষণা করেন, “হিন্দুদের উচিত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ অর্জন করা”। ভাবখানা এই যে, ব্রিটিশ যুদ্ধপ্রচেষ্টার অংশ হয়েই যাতে ভবিষ্যতের হিন্দু শক্তি গঠন করা যায়। অন্যদিকে, ১৯৪০ সালে যখন মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রস্তাব পাশ করে , বাংলায় শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি তখন ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ সরকারে মন্ত্রী। এই জোট রাজনীতিতে অংশ নেওয়া প্রমাণ করে –তাদের প্রধান শত্রু ছিল কংগ্রেস, ব্রিটিশ নয়।
দ্বি-জাতি তত্ত্ব: সাভারকর থেকে জিন্নাহ
সাভারকার ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন (১৯২৩) যে, “হিন্দু ও মুসলমান দুটি পৃথক জাতি”। যে ব্যক্তি ভারতকে পিতৃভূমি ও পবিত্র ভূমি উভয়ই মনে করে, কেবল সেই ব্যক্তি হিন্দু –সাভারকারের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল এমনটাই। অর্থাৎ মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের ক্ষেত্রে তিনি বলেন, তাঁদের ধর্মীয় পবিত্র ভূমি (মক্কা বা জেরুজালেম) ভারতের বাইরে; তাই তাঁরা প্রকৃত অর্থে ‘হিন্দু জাতি’র অংশ নন। এই ভাবনা থেকেই তিনি প্রথম প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন যে, হিন্দু ও মুসলমান দুটি পৃথক জাতি। যা পরে জিন্নাহর Two Nation Theory-এর ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায় (১৯৩০)। ধর্মের ভিত্তিতে জাতি নির্ধারণের বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি প্রথম সাভারকারই স্থাপন করেন। তাই ইতিহাসবিদেরা যথার্থই বলেন, ভারতের বিভাজনের বীজ এক অর্থে হিন্দু মহাসভার চিন্তায়ই নিহিত ছিল।
সাম্প্রদায়িকতা ও রাজনৈতিক পুনর্গঠন
১৯৪৬ সালের দাঙ্গা ও দেশবিভাগের সময় RSS হঠাৎ সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা নিজেদের “হিন্দু রক্ষক” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করে। স্বাধীনতার পরে তাদের বক্তৃতা এবং RSS-এর মুখপত্র ‘Organiser’-এর নিবন্ধসমূহে মুসলিম-বিরোধী বিষ ছড়ায়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের Organiser-এ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি লেখেন –তেরঙ্গা “একটি অশুভ চিহ্ন”, প্রকৃত পতাকা হবে “ভাগোয়া”। এই মনোভাবই ব্যাখ্যা করে কেন RSS ২০০২ সাল পর্যন্ত জাতীয় পতাকা উত্তোলন থেকে বিরত ছিল। Organiser -এর লেখায় ছিল: “ভারতের জন্য ভাগোয়া পতাকা ছাড়া অন্য কোন পতাকা গ্রহণযোগ্য নয়; ত্রিবর্ণ পতাকা বিভেদের প্রতীক।”
মহাত্মার হত্যাকাণ্ড ও আত্মসমালোচনার অনুপস্থিতি
১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারী নাথুরাম গডসে মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেন। গডসে তরুণ বয়সে RSS-এর সক্রিয় সদস্য ছিলেন, পরে হিন্দু মহাসভার রাজনীতিতে যুক্ত হন। তিনি ১৯৩০-এর দশকের শেষের দিকে RSS থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে আলাদা হয়ে যান। কিন্তু RSS-এর “হিন্দু জাতি” ধারণার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। এই হত্যাকাণ্ড ছিল সেই মতাদর্শের চূড়ান্ত পরিণতি, যা মানবিক ও ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাকে ‘দুর্বলতা’ হিসেবে দেখেছিল। গডসে ও তাঁর সহযোদ্ধারা বিশ্বাস করতেন, গান্ধীর অহিংস নীতি ও মুসলমানদের প্রতি ‘অতিরিক্ত সহানুভূতি’ ভারতের বিভাজন ঘটিয়েছে এবং পাকিস্তানের পক্ষে গান্ধী ও কংগ্রেসের নীতি হিন্দু স্বার্থের পরিপন্থী। অর্থাৎ হত্যাকাান্ডটি, ধর্মনির্ভর জাতীয়তাবাদের প্রেক্ষিতে, বলা যায় যে রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত প্রতিশোধের রূপ নেয়।
তবু, আজও RSS বা তাদের উত্তরসূরী রাজনৈতিক শক্তিগুলির মধ্যে কোন আত্মসমালোচনার চিহ্ন দেখা যায় না। বরং স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর ‘ঘরে ঘরে তেরঙ্গা’ প্রচারের মাধ্যমে তারা নিজেদের ইতিহাস পুনর্লিখনের চেষ্টা করছে –যেন তারা এই সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু ছিল।
জাতীয়তাবাদ বনাম ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ
RSS-এর ‘জাতীয়তাবাদ’ আসলে ছিল এক ধরনের সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় ঐক্যবাদের দর্শন, যা ব্রিটিশ বিরোধিতা বা গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার আন্দোলনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই আদর্শে ‘জাতি’ মানে কেবল হিন্দু সমাজ, ‘দেশ’ মানে তার পবিত্র ভূমি।
অন্যদিকে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ছিল অন্তর্ভুক্তিমূলক, বহুত্ববাদী ও মুক্তির সংগ্রামমুখী। যার প্রতীক গান্ধী, নেহরু, তিলক, সুভাষচন্দ্র, আজাদ, ভগৎ সিং প্রমুখ। এর সঙ্গে উল্লেখযোগ্যভাবে যুক্ত হবে শ্রমিক-কৃষক- আদিবাসী আন্দোলনগুলি, ১৮৫৭’র সিপাহী বিদ্রোহ থেকে স্বাধীনতা পূর্বলগ্নে বোম্বাই নৌ-বিদ্রোহ ও আজাদ হিন্দ বাহিনীর মুক্তি অভিযান। তাদের লক্ষ্য ছিল ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল ভাঙা; RSS-এর লক্ষ্য ছিল এক ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ নির্মাণ, যা এই মুক্তির চেতনার সঙ্গে সম্পূর্ণ সংঘর্ষপূর্ণ। এইসব জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম যে শেষ অবধি দ্বি-জাতিতত্ত্বের শরবিদ্ধ হলো আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতায়, তাকে ইতিহাসের নিয়তি বলে অনেকে মনে করেন। অনেকেই বলেন ‘গ্রেট বিট্রেয়াল'।
ইতিহাসের পুনর্লিখন ও জাতীয় স্মৃতির লড়াই
আজকের রাজনৈতিক পরিবেশে RSS ও তার উত্তরসূরী শক্তিগুলি নিজেদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিক অংশ হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় –তারা কেবল তখনই সক্রিয় হয়েছে যখন জাতীয় ঐক্য ভাঙতে সাম্প্রদায়িকতার প্রয়োজন ছিল।
ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির প্রকৃত ইতিহাস তাই সেইসব অগণিত মানুষের –যারা ধর্ম, জাত, ভাষার বিভাজন পেরিয়ে ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিল।
যারা আজ ‘সবচেয়ে জাতীয়তাবাদী’ দাবি করে, তাদের অনুপস্থিতিই সেই সংগ্রামের নৈতিক শক্তিকে উজ্জ্বল করে তুলেছে।
তথ্যসূত্র :
1. M.S. Golwalkar, Bunch of Thoughts, Bangalore: Sahitya Sindhu, 1966.
2. V.D. Savarkar, Hindutva: Who is a Hindu?, Nagpur: Veer Savarkar Prakashan, 1923
3. Bipan Chandra et al., India’s Struggle for Independence, Penguin, 1989.